পাহাড়ে সহিংসতায় হুমকিতে স্বজনেরা, মামলা হয়নি

শক্তিমান চাকমা
শক্তিমান চাকমা

রাঙামাটির নানিয়ারচরে এক দিনের ব্যবধানে পাহাড়ের দুই আঞ্চলিক দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাসহ নিহত ছয়জনের স্বজনেরা আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। নানা মহল থেকে মামলা না করতে হুমকি-ধমকি দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন তাঁরা। এ কারণে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমাসহ ছয় খুনের ঘটনায় মামলা বিলম্বিত হচ্ছে। ঘটনার চার দিন পার হতে চললেও এখনো কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। পুলিশ জানিয়েছে, আসামিদের ধরতে যৌথ অভিযান চলছে।

গত বৃহস্পতিবার নানিয়ারচর উপজেলা পরিষদের সামনে গুলি করে হত্যা করা হয় জনসংহতি সমিতির (এম এন লারমা) সহসভাপতি উপজেলা চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমাকে। এর পরদিন শুক্রবার তাঁর শেষকৃত্যে যাওয়ার সময় মাইক্রোবাসে এলোপাতাড়ি গুলিতে নিহত হন আরও পাঁচজন। এর মধ্যে ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক দলের আহ্বায়ক তপন জ্যোতি চাকমাও রয়েছেন।

দুটি ঘটনার কোনোটিতে গতকাল রোববার বিকেল পর্যন্ত মামলা হয়নি। মামলা না করতে পরিবারগুলোকে চাপ সৃষ্টির অভিযোগ উঠেছে। ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক দলের সদস্যসচিব শ্যামল চাকমা প্রথম আলোকে বলেন, ‘মামলা না করার জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে। এ নিয়ে বেশি মাতামাতি করতে নিষেধ করা হচ্ছে। তবু আমরা মামলা করব। তপনদার পরিবার মামলা করবে।’
এক প্রশ্নের জবাবে শ্যামল চাকমা বলেন, ‘এই ঘটনা ইউপিডিএফ করেছে। তারাই হুমকি দিচ্ছে। যদি বাড়াবাড়ি করে তাহলে ফল ভালো হবে না।’

তবে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নিজেদের সম্পৃক্ততা এবং হুমকি-ধমকি দেওয়ার বিষয়টি পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন ইউপিডিএফের মুখপাত্র মাইকেল চাকমা। তিনি বলেন, ‘অনুমাননির্ভর বক্তব্য দিয়ে তদন্ত ব্যাঘাত করার জন্য এসব বলা হচ্ছে। আমরা জড়িত নই।’

শক্তিমান চাকমার পরিবার দীর্ঘদিন ধরে রাঙামাটি সদরের কল্যাণপুর এলাকায় থাকে। স্বামীর মৃত্যুর খবর শুনে নানিয়ারচরে ছুটে গিয়েছিলেন স্ত্রী জয়তী চাকমা ও একমাত্র সন্তান শ্রেয়া চাকমা। শেষকৃত্য শেষে ফিরে এসে রাঙামাটির বাসায় অনেকটা নিভৃতে রয়েছেন তাঁরা। স্বজন ছাড়া সবাইকে এড়িয়ে চলছেন তাঁরা। শক্তিমানের ঘনিষ্ঠ এক স্বজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মামলাসহ নানা বিষয়ে চাপের মধ্যে রয়েছে পরিবার।

মাইক্রোবাসে নিহত জনসংহতি সমিতির (এম এন লারমা) সহযোগী সংগঠন যুব সংহতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক সুজন চাকমার পরিবারও মামলা করতে আগ্রহী নয় বলে জানান সুজনের স্ত্রী জ্যোতিষী চাকমা।

জানতে চাইলে নানিয়ারচর থানার ওসি মো. আবদুল লতিফ প্রথম আলোকে বলেন, মামলা হয়নি। প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। আসামিদের ধরতে যৌথ অভিযান চলছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘হুমকি-ধমকির বিষয়ে কেউ আমাদের লিখিত অভিযোগ করেনি। তবে বিভিন্ন মাধ্যমে হুমকির বিষয়টি শুনেছি।’
প্রসঙ্গত, গত চার মাসে রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে ১৭ জন খুন হয়। এসব ঘটনায় মামলা হয়েছিল। হুমকি এবং আতঙ্ক তাড়া করছে জনসংহতি সমিতি (এম এন লারমা) খাগড়াছড়ি জেলার সহসাধারণ সম্পাদক প্রিয় কুমার চাকমাকেও। শুক্রবার নানিয়ারচরের বেতছড়িতে মাইক্রোবাসে এলোপাতাড়ি গুলির ঘটনায় ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান প্রিয় কুমার। খাগড়াছড়ির মহালছড়ির নিজের বাসায় এখন থাকেন না তিনি। অজ্ঞাত স্থানে গতকাল কথা হয় প্রথম আলোর প্রতিবেদকের সঙ্গে। প্রিয় কুমারের চোখেমুখে এখনো আতঙ্কের ছাপ। 

‘গাড়িটি পাহাড় থেকে নামার সময় প্রথমবার গুলিতে চমকে উঠি। দ্বিতীয়বার এলোপাতাড়ি গুলিতে চালক নিয়ন্ত্রণ হারায়। এরপর কাছে এসে গুলি করে পালিয়ে যায়। আমি হতাহতের নিচে চাপা পড়ি। যার কারণে শরীরে গুলি লাগেনি। এখন ভয়ে বাসায় থাকি না।’ প্রিয় কুমার এভাবে ঘটনার বর্ণনা দেন।
প্রিয় কুমার বলেন, ‘অস্ত্রধারীরা সংখ্যায় ছয়-সাতজনের বেশি নয়। আধা ঘণ্টারও বেশি সময় পর আমাদের উদ্ধার করা হয়।’

বাবার প্রতীক্ষায় প্রবারণা
জনসংহতি সমিতির (এম এন লারমা) সহযোগী সংগঠন যুব সংহতি সমিতির মহালছড়ি উপজেলার সাধারণ সম্পাদক সুজন চাকমা ওই মাইক্রোবাসে নিহত হন। তাঁর স্ত্রী জ্যোতিষী চাকমা ও একমাত্র সন্তান প্রবারণা এখনো তাঁর পথ চেয়ে থাকেন। সেদিন সকালে বাসা থেকে বের হওয়ার সময় সন্ধ্যায় ফিরবেন বলে জানিয়ে যান সুজন। কিন্তু দুপুরেই খবর আসে সুজন নেই।
‘নার্সারি পড়ুয়া মেয়েটি এখনো বসে থাকে বাবার প্রতীক্ষায়। সে বাবার ছবির দিকে তাকিয়ে থাকে। কী বলে তাকে সান্ত্বনা দেব। আমরা চলব কীভাবে।’ বলতে বলতে চোখ মুছতে থাকেন জ্যোতিষী চাকমা।

পাশে বসা সুজনের মা ঝনকবালা চাকমা বলেন, ‘তিন বছর আগে সুজনের বাবা মারা যান। ছেলেই একমাত্র উপার্জনক্ষম ছিল। এখন সেও চলে গেল। কী হবে আমাদের?’
মহালছড়ির মুবাছড়ি ইউনিয়নের হুল্লেংপাড়ার সুজনের ঘর থেকে রাঙামাটি ফেরার পথে নানিয়ারচরের বেতছড়ি বাজারের কাছাকাছি রাস্তার বাঁ পাশে চোখে পড়ে গাড়ির ভাঙা কাচ। পড়ে রয়েছে গাড়ির ছোট একটি সিট (আসন) ও কয়েকটি স্যান্ডেল। শুক্রবার এখানে মাইক্রোবাসে গুলি করা হয়েছিল। মাইক্রোবাসটি উদ্ধার করে রাখা হয়েছে কিছু দূরে বগাছড়ি এলাকায় পুলিশ তল্লাশিচৌকির পাশে। রক্তের দাগ মাইক্রোবাসজুড়ে।

ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিকের নতুন নেতা শ্যামল চাকমা
খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি জানান, তপন জ্যোতি চাকমা নিহত হওয়ার পর নতুন কমিটি ঘোষণা করেছে ইউপিডিএফ(গণতান্ত্রিক)। কমিটির সাধারণ সম্পাদক শ্যামল কান্তি চাকমা ওরফে জলেয়াকে সভাপতি ও উজ্জল কান্তি চাকমাকে সাধারণ সম্পাদক করে ১১ সদস্যের নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যায় শ্যামল কান্তি চাকমা স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ কমিটির কথা জানানো হয়েছে।

খাগড়াছড়িতে হরতালে পিকেটিং
খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি জানান, বাঙালি মাইক্রোবাস চালক হত্যা ও তিন বাঙালিকে অপহরণের প্রতিবাদে বাঙালি ছাত্র পরিষদের ডাকে গতকাল খাগড়াছড়িতে হরতাল পালিত হয়েছে। হরতালে দূরপাল্লার যান চলেনি। দোকানপাট বন্ধ ছিল। হরতালে শহরের চেংগী স্কয়ার, নারকেলবাগান, টার্মিনালসহ বিভিন্ন স্থানে পিকেটিং করেছে হরতালকারীরা।
খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপার আলী আহমদ খান বলেন, হরতালে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। বিভিন্ন স্থানে পুলিশ মোতায়েন ছিল। বাঙালি ছাত্র পরিষদ আজ সোমবার এবং কাল মঙ্গলবারের হরতাল প্রত্যাহার করেছে। তবে ওই দুদিন পার্বত্য বাঙালি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটি তিন পার্বত্য জেলায় হরতালের ডাক দিয়েছে।