ঘটনাটি আইনের, ফায়দা রাজনীতির

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

গাজীপুর সিটি নির্বাচন স্থগিত করা নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদার তাৎক্ষণিক মন্তব্য ছিল, ‘(আমি) জানি না, হাইকোর্ট কেন গাজীপুরের সিটি নির্বাচন স্থগিত করেছে’। সিইসির এ ধরনের মন্তব্য বাংলাদেশ সংবিধানের ১২৫ অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন কি না, সে প্রশ্নই এখন উঠেছে।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) খুলনায় ৬ মে (নির্বাচন স্থগিতের দিন) বলেছিলেন, ‘আমি আদালতের আদেশের বিষয়ে টিভি থেকে খবর জেনেছি। বিষয়টি আগে জানি, তারপর মন্তব্য করব।’ তাঁর এই মন্তব্য সংবিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কারণ, বিদ্যমান সংবিধানের আওতায় তাঁর এই মন্তব্য করার সুযোগ নেই।

কেননা, ২০১১ সালে আনা সংবিধানের একটি সংশোধনীর পর সিইসি বা নির্বাচন কমিশনের তরফে শুধু গাজীপুর বলে কথা নয়, স্থানীয় বা জাতীয় সংসদ নির্বাচন যা-ই হোক না কেন, তফসিল ঘোষণার পর কোনো নির্বাচন স্থগিত হওয়ার আগেই নির্বাচন কমিশনের জানা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

সংবিধানের ১২৫ অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘কোনো আদালত, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হইয়াছে এইরূপ কোনো নির্বাচনের বিষয়ে, নির্বাচন কমিশনকে যুক্তিসংগত নোটিশ ও শুনানির সুযোগ প্রদান না করিয়া, অন্তর্বর্তী বা অন্য কোনোরূপে কোনো আদেশ বা নির্দেশ প্রদান করিবেন না।’ সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, কমিশন দীর্ঘকাল হঠাৎ নির্বাচন বন্ধের সমস্যায় ভুগেছে। এ থেকে বাঁচতেই ড. শামসুল হুদা কমিশন সংবিধানে ওই রক্ষাকবচ যুক্ত করতে সুপারিশ করেছিল, আওয়ামী লীগ যা গ্রহণ করেছিল। কিন্তু সিইসির কথায় মনে হচ্ছে, ইসিকে সংবিধান যে রক্ষাকবচ দিয়েছিল, তার লঙ্ঘন ঘটেছে।

সংবিধানের ১২৫ অনুচ্ছেদেই ইসিকে শুনানির আগে যুক্তিসংগত নোটিশ দেওয়ার কথা আছে। এই অবস্থায় সিইসির ‘জানি না’ বলাটায় সংবিধান কি রক্ষা পেল? অবশ্যই এর দুটি দিক আছে। এর একটি আইনগত, অন্যটি রাজনৈতিক। রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাসীন দল প্রকাশ্যে ঈষৎ হতাশা ব্যক্ত এবং আদালতের সিদ্ধান্তে সরকারের হাত নেই-ধরনের মন্তব্য করলেও গাজীপুরের ঘটনাও তাদের স্বস্তি দিয়েছে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। যেমনটি স্বস্তি দিয়েছিল ঢাকা উত্তর সিটি নির্বাচন স্থগিত হওয়ার ঘটনায়। কারণ, অনেকেই মনে করছেন, সরকার সম্ভাব্য পরাজয়ের গ্লানি হজম বা কোনো ঝুঁকি নিতে ইতস্তত বোধ করে থাকবেন।

ঢাকা উত্তর সিটির পর গাজীপুর সিটি নির্বাচন প্রায় একটা অভিন্ন প্রক্রিয়ায় স্থগিত হওয়ার ঘটনাকে অনেকে আর কাকতালীয় মানতে রাজি নন। অ্যাটর্নি জেনারেল কখন স্বতঃস্ফূর্ত কিংবা প্রগল্ভ হয়ে ওঠেন, কখন হাইকোর্টের আদেশে’ সংক্ষুব্ধ’ হয়ে চেম্বার জজের কাছে ছুটে যান, আর কখন অত্যন্ত সতর্ক ও রক্ষণশীল অবস্থান নেন, তা নিয়েও রাজনৈতিক মহলে যথেষ্ট আলোচনা আছে।

গাজীপুর নির্বাচন স্থগিত হওয়া নিয়ে অবশ্য অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, এখন বিষয়টি আপিল বিভাগে বিচারাধীন আছে। এখন আর মন্তব্য করা ঠিক হবে না। এ নিয়ে রাষ্ট্রের অবস্থান জানতে চাইলে তাঁর উত্তর, ‘আগ্রহী পক্ষ ইতিমধ্যে আপিল করেছে। আমাদের আর করার কী আছে? আমি এখন কী করে কথা বলব?’ তার মানে, এই বিষয়ে রাষ্ট্রের কোনো বক্তব্য থাকবে না? আবারও তিনি বললেন, প্রয়োজনে থাকবে, এখন তো নেই।

সার্বিকভাবে এ নিয়ে সংবিধানের লঙ্ঘন হয়েছে কি না, জানতে চাইলে সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা আইনজীবী আমীর-উল ইসলাম সরাসরি কোনো মন্তব্য করেননি। তবে তিনি প্রথম আলোকে স্পষ্টতই বলেন, ‘নির্বাচন স্থগিত করা-সংক্রান্ত কোনো রিট দরখাস্ত নিষ্পত্তির বিষয়ে সংবিধান যে পূর্বশর্ত আরোপ করেছে, তা বাধ্যতামূলক। এখন যদি তা অনুসরণ না করা হয়, তাহলে রিট গ্রহণযোগ্য (মেইনটেনেবল) নয়।’

তবে এ নিয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার গতকাল মুঠোফোনে বলেন, রিটের বিষয় হলে ১০২ ও ১২৫ অনুচ্ছেদকে মিলিয়ে পড়তে হবে। আর ১০২ অনুচ্ছেদে নির্বাচন বিষয়ে কোনো কথা উল্লেখ নেই।

প্রসঙ্গত, সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির রিট করার অধিকারকে ১৯৭২ সালের সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদে শর্ত সাপেক্ষে সুরক্ষা দেওয়া আছে। সেখানে ‘উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন ও জনস্বার্থের পক্ষে ক্ষতিকর’ কোনো রিটের বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেলকে ‘যুক্তিসংগত নোটিশ’ এবং তাঁর বক্তব্য শ্রবণ না করা পর্যন্ত হাইকোর্টকে কোনো আদেশ না দিতে বলা আছে। কিন্তু এই অনুচ্ছেদের কারণে ইসির স্বার্থ খর্ব হচ্ছিল বলেই ১২৫ অনুচ্ছেদে ওই শর্ত যুক্ত করা হয়। মূলত, ইসির সুপারিশে সংবিধানে কোনো সংশোধনী আনার নজির বিরল। অথচ এখন তারাই তাদের সাংবিধানিক অধিকার রক্ষায় উদাসীন।

নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার অন্য এক প্রশ্নের উত্তরে নিশ্চিত করেন যে ইসির অন্যতম প্যানেল আইনজীবী তৌহিদুল ইসলাম শুনানিতে অংশ নিলেও এই মামলায় তাঁর কোনো ওকালতনামা ছিল না।

নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, গাজীপুর বিষয়ে আপিল নিষ্পত্তি থেকে সংবিধানের ১২৫ অনুচ্ছেদের কার্যকরতা কী হবে, সে বিষয়টির বৈধতার প্রশ্নে ইসির এখন উচিত পৃথকভাবে এবং চূড়ান্তভাবে সর্বোচ্চ আদালতে ফয়সালা করে নেওয়া। কারণ, ঢাকা উত্তর সিটির পর গাজীপুরে অবিকল একই ঘটনা ঘটেছে। এর পুনরাবৃত্তি রোধ করা দরকার।