ছাত্রলীগের সম্মেলনে ভোটের প্রস্তুতির পাশাপাশি সমঝোতার আওয়াজ

>
  • ছাত্রলীগের ২৯তম জাতীয় সম্মেলন কাল শুক্রবার।
  • সভাপতি পদে ১১১, সা. সম্পাদক পদে ২১২ জন মনোনয়ন ফরম কিনেছেন।
  • শেষ সময়েও বেহিসাবি অনেক পদ দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন।
  • প্রার্থীরাও ভোটার সংখ্যা জানেন না।
  • আগের তিনটি সম্মেলনে ভোট নেওয়া হয়।
  • এবারে সমঝোতার আওয়াজ।
  • প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই কমিটি চূড়ান্ত করবেন।

বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ২৯তম জাতীয় সম্মেলন কাল শুক্রবার। এই সম্মেলনে ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই পদে লড়ছেন ৩২৩ প্রার্থী। সংগঠনের নতুন নেতা নির্বাচনে ভোটের প্রস্তুতি থাকলেও ভোটার তালিকা প্রকাশ না করায় বিপাকে প্রার্থীরা। ছাত্রলীগের নেতৃত্ব নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতা ও ছাত্রলীগের সাবেক নেতাদের চলছে শেষ মুহূর্তের দৌড়ঝাঁপ। তবে সবাই বলছেন, এবারের কমিটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই চূড়ান্ত করবেন।

কাল বেলা তিনটায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রধানমন্ত্রী ছাত্রলীগের সম্মেলনের উদ্বোধন করবেন। এরপর থেকে শুরু হবে নেতা নির্বাচনের প্রক্রিয়া। ছাত্রলীগের নেতা নির্বাচনে আগের তিনটি সম্মেলনে ভোট নেওয়া হলেও এবারে সমঝোতার কমিটির কথা বলা হচ্ছে। তবে গোপন ভোটের প্রস্তুতিও আছে।

ভোটের প্রস্তুতি হিসেবে শেষ সময়ে নতুন করে বেহিসাবি অনেক পদ দেওয়া হয়েছে। গত এক সপ্তাহে ঢাকায় বসে অন্তত ৯টি জেলা কমিটির অনুমোদন হয়েছে। এর আগে গত মাসের শেষ সপ্তাহে ৭টি জেলা কমিটি হয়েছে, যেখান থেকে ৩০ জনকে কেন্দ্রীয় কমিটির সহসম্পাদক ও সদস্য করা হয়েছে।

ছাত্রলীগ নেতাদের একটি অংশের অভিযোগ, নতুন এসব কমিটির মাধ্যমে নিজেদের অনুসারীদের ভোটার বানানো হয়েছে। ১৫১ সদস্যের জেলা কমিটি থেকে ২৫ জনকে ভোটার হিসেবে বাছাই করার নিয়ম থাকায় সেখানেও নিজেদের অনুসারীদের রাখা হয়েছে। এর বাইরে কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের কর্মকর্তা, সদস্য ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যরা ভোট দিতে পারেন। কিন্তু ইতিমধ্যেই তিন দফায় কেন্দ্রীয় কমিটির আকার বাড়ানো হয়েছে। শেষ সময়েও পদ দেওয়া হচ্ছে। মূলত কতজন ভোটার, সেটাও নিশ্চিত হয়নি।

জানতে চাইলে সম্মেলনের প্রধান নির্বাচন কমিশনার আরিফুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ভোটার তালিকা চূড়ান্ত করা হয়েছে। তবে সেটা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা পাওয়ার পর প্রকাশ করা হবে। তিনি জানান, ৩২৩ প্রার্থীর মধ্যে সভাপতি পদে ১১১ জন ও সাধারণ সম্পাদক পদে ২১২ জন মনোনয়ন ফরম কিনেছেন। প্রতিটি ফরমের মূল্য ছিল তিন হাজার টাকা।

ছাত্রলীগের প্রার্থীদের একটি অংশের অভিযোগ, গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আসতে ২০০৬ সালে ছাত্রলীগের সম্মেলনে ভোটের প্রক্রিয়া যুক্ত হয়। কিন্তু একটি কথিত সিন্ডিকেট ভোট নিয়ন্ত্রণ করে নিজেদের অনুগতদের নেতা নির্বাচন করত। এবারের যে সমঝোতার কমিটির কথা বলা হচ্ছে, তা সেই ধারা থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা। তবে এই সমঝোতা কাদের সঙ্গে হবে, কারা সেখানে প্রভাব রাখবে, তা নিয়ে এখনো অনেক জল্পনা-কল্পনা রয়েছে।

ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ‘সিন্ডিকেট’ শব্দটির সঙ্গে সংগঠনের প্রায় সব নেতা-কর্মীই কমবেশি পরিচিত। তাঁদের দাবি, আধিপত্য বিস্তার, টেন্ডারবাজি ও বিভিন্ন ব্যক্তিগত স্বার্থের কারণে সাবেক ছাত্রলীগ নেতাদের একটা অংশ তাঁদের ‘অনুসারীদের’ ছাত্রলীগের নেতৃত্বে আনতে এ সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে। আর ছাত্রলীগ সারা দেশে আওয়ামী লীগের স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে কাজ করে। ছাত্রলীগের শীর্ষস্থানীয় নেতারা যাঁদের অনুগত, মূল দলে তাঁদের প্রভাবই থাকে বেশি। এ জন্যই আওয়ামী লীগের নেতারাও নিজেদের প্রভাব রাখতে পছন্দের প্রার্থীর জন্য কাজ করেন।

জানতে চাইলে ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছাত্রলীগে কখনোই কোনো সিন্ডিকেট কাজ করেনি। আমি এত দিন ধরে ছাত্রলীগের দায়িত্বে। আমিই বুঝলাম না সিন্ডিকেটের সদস্য কারা। এগুলো কেন বলা হয়, তা-ও বুঝি না। আমরা নেত্রীর সঙ্গে কথা বলে একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নেতা নির্বাচন করি।’

ছাত্রলীগ সভাপতি বিষয়টি অস্বীকার করলেও ইতিমধ্যেই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এক বক্তৃতায় সিন্ডিকেটের প্রসঙ্গ টেনেছেন। তিনি বলেছেন, কোনো সিন্ডিকেট দ্বারা ছাত্রলীগ চলবে না। কারও পকেটের কমিটি দিয়ে ছাত্রলীগের নেতৃত্ব হবে না।

আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের সূত্রগুলো বলছে, এবারও ছাত্রলীগের নেতৃত্ব নির্বাচনে সিন্ডিকেট জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এই প্রক্রিয়ারই একটি অংশ গোপনে ভোটের প্রস্তুতি। সংগঠনের সাবেক এক সভাপতিকে কেন্দ্র করে এই সিন্ডিকেট। তিনি নিজেও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের অনুসারী বলে পরিচিত। তাঁর সঙ্গে আছেন ছাত্রলীগে তাঁর পরবর্তী সময়ের ছয়জন সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের মধ্যে পাঁচজন। দীর্ঘদিনের এই সিন্ডিকেটে আওয়ামী লীগের একজন যুগ্ম সম্পাদক, একজন সাংগঠনিক সম্পাদক ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তা ছিলেন। যদিও এবারের সম্মেলন ঘিরে সবাই সিন্ডিকেটের সমালোচনা করছেন।

এই ৯ জনের ৪ জনের সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। তাঁরা বলেন, ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলমের বিতর্কিত কিছু কর্মকাণ্ডের কারণে কথিত সিন্ডিকেটের ওপর অপর অংশের ক্ষোভ রয়েছে। তাঁকে কেন্দ্র করে এই দ্বন্দ্বের ফলে নাজমুল ২৮ তম সম্মেলনের কিছুদিন পর থেকেই দেশের বাইরে ছিলেন। তিন বছর পর এবারের সম্মেলনের আগে তিনি দেশে এসেছেন। কথিত সিন্ডিকেটের বাইরের এই অংশ আলাদাভাবে নেতা নির্বাচনে প্রাধান্য রাখার চেষ্টা করছে। এই অংশটির বাইরেও ছাত্রলীগের সাবেক নেতাদের একটি অংশ যারা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পদে আছে, তারাও পরবর্তী নেতা নির্বাচনে ভূমিকা রাখার চেষ্টা করছে। তবে তাদের প্রত্যেকের বক্তব্য, এবার প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে ছাত্রলীগের নেতা নির্বাচন করা হবে।

জানতে চাইলে সাবেক সভাপতি লিয়াকত শিকদারও বললেন প্রধানমন্ত্রীর কথা। তিনি বলেন, ‘সিন্ডিকেট বলে কিছু নেই। এটি একটি কাল্পনিক টার্ম, যার ভিত্তি নেই। আমরা সাবেকরা যে যেখানে আছি, সবাই বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতি করি। নেত্রীর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কাজ করি।’

সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ছাত্রলীগের নেতৃত্বে বয়স ও ছাত্রত্বকে বিবেচনায় নেওয়া হবে। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, ছাত্রলীগের নেতৃত্বের বয়স সর্বোচ্চ ২৭। তাঁকে অবিবাহিত ও নিয়মিত ছাত্র হতে হবে। কিন্তু বয়সের এই নিয়ম কখনোই মানা হয়নি। কারণ হিসেবে বলা হয়, দুই বছর পরপর ছাত্রলীগের সম্মেলন হওয়ার কথা থাকলেও তা চার বছরে গিয়ে গড়ায়। ফলে এ সময়টুকুকে ছাড় দেওয়া হয়। এবার ছাত্রলীগের সম্মেলন তিন বছরের মধ্যে হওয়ায় সুনির্দিষ্ট ঘোষণা এখনো আসেনি। সব বয়সী নেতাই মনোনয়নপত্র কিনেছেন। ২৭ বছরের বেশি বয়সী নেতাদের আশা, সামনের জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দক্ষ নেতৃত্ব আনতে বেশি বয়সীদের আনা হবে।

সার্বিক প্রসঙ্গে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, ভোটার তালিকা সব সময়ই গোপন থাকে। নেত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করে সম্মেলনের সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে।