টিফিন বক্স ছাড়াই কারখানায় আসেন তাঁরা

দুপুরে রান্না হয়েছে ৭ হাজার ৫০০টি ডিম, ১ হাজার ৫২৫ কেজি চালের ভাত, ১৫০ কেজি ডাল। ডিম, সবজি ও ডালসহ রান্নায় তেল লেগেছে ১০৪ কেজি। গত ২৬ এপ্রিল রান্নায় এক বেলায় খরচ হয়েছে ১ লাখ ৭৫ হাজার ১৭৭ টাকা। ঢাকার ধামরাইতে স্নোটেক্স আউটার ওয়্যার লিমিটেডের স্টাফ এবং শ্রমিকদের জন্য এই রান্না হয়। রান্না করা এই খাবার তাঁরা খান বিনা মূল্যে। স্টাফ ছাড়া কারখানাটিতে শুধু পোশাকশ্রমিকের সংখ্যা ৭ হাজার ৩০০।

২০১৫ সাল থেকে কারখানাটি খোলা থাকলে প্রতিদিনই দুপুরের চিত্র এটি। প্রথমে শুধু ডাল, ভাত এবং সবজি দেওয়া হতো। শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ও পুষ্টির কথা চিন্তা করে সম্প্রতি তাতে ডিম ও মুরগি যোগ হয়েছে। রান্নার জন্য নিয়োজিত জনবলের বেতন, সিলিন্ডার গ্যাসের খরচসহ কারখানামালিকের মাসে খরচ হয় প্রায় ৬০ লাখ টাকা। শ্রম আইনে শুধু দুপুরের খাবার বিরতি এক ঘণ্টা হবে বলে উল্লেখ থাকলেও বিনা মূল্যে খাবার দেওয়ার কথা বলা হয়নি।

ধামরাইয়ের ধুলিভিটায় অবস্থিত আটতলা ভবনের অষ্টম তলায় কারখানার যে ডাইনিং তাতে একসঙ্গে ১ হাজার ৪০০ শ্রমিক বসে খেতে পারেন। কারখানা ভবনের একটু দূরেই রয়েছে স্টোর ও বিশাল রান্নাঘর। বিশেষ লিফটে করে খাবার পৌঁছে যায় এই তলায়। আট হাজার মানুষের জন্য রয়েছে আলাদা প্লেট।

কারখানার শ্রমিকেরা জানালেন, অন্য কারখানার মতো এই কারখানায় তাঁদের টিফিন ক্যারিয়ার বহন করতে হয় না। দুপুরে রান্নার জন্য নারী শ্রমিকদের বাড়তি সময় ব্যয় করতে হয় না। বাসা থেকে আনা খাবার নষ্ট হয়ে গেল কি না, তা-ও চিন্তা করতে হয় না। দুপুরে হেঁটে বাসায় গিয়ে খাবার খাওয়া বা বাড়তি দাম দিয়ে দোকান থেকে খাবার কিনে খেতে হয় না। এক বেলা খাবারের টাকাটা সাশ্রয় হচ্ছে। গরম খাবার খাচ্ছেন বলে শ্রমিকেরা অসুস্থও হন কম।

ইউনাইটেড স্টেট গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল এবং অ্যাকর্ডের সনদপ্রাপ্ত কারখানাটির মালিক এস এম খালেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘খুব কমসংখ্যক কারখানা শ্রমিকদের দুপুরের খাবার দিচ্ছে। তবে অনেকেই বেতনের টাকা থেকে টাকা কেটে নিচ্ছে বা প্যাকেট খাবার দিচ্ছে। আমার কারখানায় শ্রমিকদের গরম খাবার দেওয়া হচ্ছে, রান্নার দায়িত্ব কোনো ঠিকাদারকে দেওয়া হয়নি। রান্নার মান ঠিক আছে কি না, তা জানতে এবং বুঝতে কারখানায় গেলে আমি নিজেও শ্রমিকদের জন্য রান্না করা খাবার খাই। খাবারের পেছনে আমার ভালোই খরচ হচ্ছে। তবে এতে শ্রমিকদের অন্য কারখানায় চলে যাওয়ার হার কমানো গেছে। আমার উৎপাদন খরচও কমে গেছে।’

কারখানাটির কার্যক্রম শুরু হয়েছে ২০১৪ সালে। সবুজ কারখানা হিসেবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ লিড গোল্ড স্বীকৃতিপ্রাপ্ত কারখানাটি চলতি বছরে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ‘পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেফটি উত্তম চর্চা পুরস্কার’ পেয়েছে। গত বছর বাংলাদেশে তৈরি পোশাক কারখানায় উত্তম চর্চার অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও যে পাঁচটি কারখানাকে স্বীকৃতি দেয় তাতেও কারখানার নাম আছে। চলতি বছরে পোশাক কারখানার খবর পরিবেশনকারী আরএমজি টাইমসের ‘আরএমজি টাইমস বেস্ট প্র্যাকটিস অ্যাওয়ার্ড’ও পেয়েছে কারখানাটি।

ঢাকার ধামরাইয়ে স্নোটেক্স আউটার ওয়্যার লিমিটেডের স্টাফ ও শ্রমিকদের জন্য এই রান্না হয়। শ্রমিকদের জন্য আছে আরও নানা সুবিধা। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমিন
ঢাকার ধামরাইয়ে স্নোটেক্স আউটার ওয়্যার লিমিটেডের স্টাফ ও শ্রমিকদের জন্য এই রান্না হয়। শ্রমিকদের জন্য আছে আরও নানা সুবিধা। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমিন

কারখানাটিতে শ্রমিকদের খাবার দেওয়ার জন্য সিভিল সার্জনের কাছ থেকে সনদ নেওয়া হয়েছে। এখানে রান্নাঘরের স্টোরের দায়িত্বে থাকা সাইদুল ইসলাম ২৬ এপ্রিলের বাজারের ফর্দ উল্লেখ করে জানালেন, ওই দিন সবজির জন্য পেঁপে ছিল ১৮৭ কেজি, চালকুমড়া ৫৮৫ কেজি, কাঁচা কলা ৬০ কেজি, চিচিঙ্গা ১০৬ কেজি এবং আলু লেগেছে ৩০০ কেজি। শুধু পেঁয়াজই লেগেছে ৮০ কেজি। কারখানায় উপস্থিতির ভিত্তিতে কেজির পরিমাণে কিছুটা হেরফের হয়। এ রান্নার দায়িত্বে আছেন ৬ জন মূল বাবুর্চিসহ মোট ১৮ জন বাবুর্চি। আর বাবুর্চিসহ রান্নার কাজে সহায়তা করা মোট জনবলের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৮ জন।

কারখানাটির ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার এ এইচ এম কামরুজ্জামান চৌধুরী (কমপ্লায়েন্স) বলেন, এ কারখানার নীতি হচ্ছে ‘সুখী হই সুখী করি’। শ্রমিক ও কর্মীদের পেছনে দুপুরের খাবার দিতে কারখানার যে খরচ হচ্ছে, তাকে বিনিয়োগ হিসেবেই দেখা হচ্ছে।

২৬ এপ্রিল সকালের দিকে কারখানায় পৌঁছে দেখা যায়, শ্রমিকেরা আপনমনে কাজ করছেন আর শ্রমিকদের বিনোদনের জন্য প্রতি ফ্লোরে গান বাজানো হচ্ছে। দুপুরের খাবারের সময় দেখা গেল, শ্রমিকদের কেউ মাঠে বসে চুল আঁচড়াচ্ছেন, কেউ ফোনে দরকারি কথা সেরে নিচ্ছেন। অনেকে নিজেদের মধ্যে গল্পে মেতেছেন। আর ডাইনিং রুমে একসঙ্গে খেতে বসেছেন ১ হাজার ৪০০ শ্রমিক। কোনো হুড়োহুড়ি নেই। লম্বা বেসিনে বিশুদ্ধ খাবার পানি ও হাত ধোয়ার পানির ব্যবস্থা আছে। লাইন করে সবজি এবং ডিমের তরকারি নিয়ে কয়েকজন কর্মী দাঁড়ানো। শ্রমিক প্লেট নিয়ে প্রথমে সবজি নিচ্ছেন পরে ডিমের ঝোল বা মুরগি থাকলে তা নিয়ে যেখানে খালি জায়গা পাচ্ছেন সেখানেই বসে যাচ্ছেন। টেবিলে গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত ও ডাল। যাঁর যতটুকু লাগছে নিজেরাই নিয়ে খাচ্ছেন। খাওয়া শেষে প্লেট ধোয়ার জন্যও আছে নির্দিষ্ট জনবল।

কারখানার অন্য কর্মকর্তা ও কর্মচারীরাও এই একই ভাত ও ডাল খাচ্ছেন, তবে এর পাশাপাশি নিজেরা মাসিক ৭০০ টাকা করে জমা দিচ্ছেন। কারখানা কর্তৃপক্ষের ডিম বা মুরগির জন্য দেওয়া বরাদ্দের সঙ্গে কিছু টাকা যোগ করে নিজেদের মতো করে একেক দিন একেক মেন্যু খাওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। তবে খাবারের মান ঠিক আছে কি না, তা যাচাইয়ের জন্য সপ্তাহে এক দিন শ্রমিকদের জন্য যে খাবার, তা খেতে হয় স্টাফদের।

কারখানার খাবার রুমে একসঙ্গে খেতে পারেন ১ হাজার ৪০০ শ্রমিক। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমিন
কারখানার খাবার রুমে একসঙ্গে খেতে পারেন ১ হাজার ৪০০ শ্রমিক। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমিন

কারখানাটি শ্রমিকদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য আইনের বাইরে নানান কার্যক্রম পরিচালনা করছে। শ্রমিকেরা মজুরি পাচ্ছে ওই মাসের শেষ কর্মদিবসে। নতুনদের কাজে সহায়তার জন্য শ্রমিকদের মধ্য থেকেই ‘সাহায্যকারী বন্ধু’, শ্রমিকদের প্রতিভা বিকাশে স্নোটেক্স বার্তা প্রকাশ, কর্মীরা কেমন আছেন, তার জন্য ‘সুখ’ জরিপ করছে। অন্তঃসত্ত্বা মায়েদের বিশেষ সহায়তা দেওয়ার জন্য তাঁদের হাতে লাগানো হয় বিশেষ রঙের কাপড়, দেওয়া হয় হালকা কাজ। নারী শ্রমিকদের কম মূল্যে প্রতি মাসে দেওয়া হচ্ছে স্যানিটারি ন্যাপকিন।

‘টাইগার’ নিয়ে লড়াই

কারখানার প্রতি ফ্লোরে একটি করে কাপড়ের তৈরি ‘টাইগার’ বা বাঘ বসে আছে। যে লাইন বা যে ফ্লোর সবচেয়ে ভালো কাজ করে, ‘টাইগার’ চলে যায় তাদের দখলে। এর জন্য লাইন বা ফ্লোর পাচ্ছে ৭০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে নানান অঙ্কের টাকা। এ টাকা সবার মধ্যে ভাগাভাগি হচ্ছে। কর্মীদের বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচানোর জন্য রেইনকোট এবং ইউনিফরম দেওয়া হচ্ছে বিনা মূল্যে। হাজিরা বোনাস, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কাজের সুবিধা, প্রভিডেন্ট তহবিলসহ মোট ২২ ধরনের প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। শ্রমিকেরা শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র, বাজারমূল্য থেকে কম মূল্যে পণ্য কেনার জন্য ক্যানটিন-ব্যবস্থা এবং ক্লিনিকে গিয়ে সেবা নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন।

কারখানাটির মালিক এস এম খালেদের মতে, এ সুবিধাগুলো হচ্ছে শ্রমিকদের জন্য ‘একটু বাড়তি’ দেওয়া। এই বাড়তি দেওয়ার কারণেই কারখানার আয়তন ১০ বিঘা থেকে ৩০ বিঘা করা সম্ভব হয়েছে। দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন কারখানার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকা সম্ভব হচ্ছে। তিনি জানালেন, কারখানায় আধুনিক রান্নাঘর তৈরির প্রস্তুতি চলছে। চলতি বছর থেকে কারখানার যে লাভ, তার ৫ শতাংশের অংশীদার হবে শ্রমিকেরা। যাতে শ্রমিকেরা নিজেকে কারখানার একজন বলে মনে করতে পারেন।