খুলনা সিটি করপোরেশনের ভোট, আছে শঙ্কাও

নির্বাচনের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। ব্যালট, বাক্সসহ অন্যান্য সরঞ্জাম নেওয়ার পর তা মিলিয়ে দেখছেন প্রিসাইডিং কর্মকর্তা। ১৪ মে জাতীয় মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্স, সোনাডাঙ্গা, খুলনা। ছবি: সাদ্দাম হোসেন
নির্বাচনের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। ব্যালট, বাক্সসহ অন্যান্য সরঞ্জাম নেওয়ার পর তা মিলিয়ে দেখছেন প্রিসাইডিং কর্মকর্তা। ১৪ মে জাতীয় মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্স, সোনাডাঙ্গা, খুলনা। ছবি: সাদ্দাম হোসেন

‘আমি ২০১৩ সালে ভোটার হয়েছি। কিন্তু ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনে ভোট দিতে যাইনি একতরফা নির্বাচনের কারণে। সে হিসেবে এবার আমার জন্য প্রথম ভোট। আমি ভোট দিতে চাই। কিন্তু কেন্দ্রে যাব পরিস্থিতি জেনে-বুঝে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশে যেসব নির্বাচন হয়েছে, তার অবস্থা দেখে আস্থা পাচ্ছি না। পাশাপাশি এখানকার পরিবেশও আমাকে আশাবাদী করতে পারছে না।’ খুলনা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন নিয়ে গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় এমন মন্তব্য করলেন খুলনা বিএল কলেজের শিক্ষার্থী আল আমিন।

একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রেজাউল করিমের মতে, ভোট ভালোই হবে। এখানে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দুই প্রার্থীর অবস্থাই ভালো। দুই দলই শক্তিশালী। এ কারণে মানুষের মধ্যে হয়তো শঙ্কা কাজ করছে। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি ভোট সুষ্ঠু হবে। ভোটাররা ভোট দিতে পারবেন না, এমন কোনো পরিস্থিতি এখানে হবে না।’


আল আমিনদের মতো অনেকের মধ্যে শঙ্কা আছে। আবার রেজাউলদের মতো অনেকেই ভালো ভোটের আশা করছেন। তবে দলভেদে রাজনৈতিক কর্মীদের অবস্থা ভিন্ন। সরকারি দলের কর্মীরা অনেক আশাবাদী। আবার বিএনপি কর্মীরা আশঙ্কায়।

খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেক ও বিএনপির প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু। ফাইল ছবি
খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেক ও বিএনপির প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু। ফাইল ছবি

রাত পোহালেই ভোট। মঙ্গলবার সকাল আটটা থেকে শুরু হয়ে কোনো বিরতি ছাড়াই বিকেল চারটা পর্যন্ত ভোট গ্রহণ হবে। এরপর ফল ঘোষণা। জানা যাবে কে বিজয়ী হয়ে খুলনার পরবর্তী নগরপিতা হচ্ছেন।

খুলনার নির্বাচনে মেয়র পদে এবার পাঁচজন প্রার্থী। আওয়ামী লীগের তালুকদার আবদুল খালেক নৌকা এবং বিএনপির নজরুল ইসলাম মঞ্জু ধানের শীষ  প্রতীকে নির্বাচন করছেন। এ ছাড়া ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মুজ্জাম্মিল হক হাতপাখা, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) মিজানুর রহমান বাবু (কাস্তে) এবং জাতীয় পার্টির এস এম শফিকুর রহমান (লাঙ্গল) মেয়র পদে লড়বেন।

খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ৩১টি সাধারণ ওয়ার্ডে কাউন্সিলর প্রার্থী ১৪৮ জন এবং ১০টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডে ৩৫ জন নারী কাউন্সিলর পদে লড়ছেন। এবারের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোটার ৪ লাখ ৯৩ হাজার ৯৩ জন। ভোট হবে ২৮৯টি ভোটকেন্দ্রে। দুটি ওয়ার্ডের দুটি ভোটকেন্দ্রে ভোট হবে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম)। সেখানে মেয়র প্রার্থীদের নাম ও প্রতীক এবং সাধারণ কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর প্রার্থীদের প্রতীকে বোতাম চেপে ইভিএমে ভোট দেবেন ভোটাররা।

ভোটের আগের দিন সোমবার দিনভর নানা শ্রেণির মানুষের সঙ্গে কথা হয়েছে প্রথম আলোর। তাঁরা বলেছেন নিজের ভাবনার কথা। নির্বাচন নিয়ে শেষ মুহূর্তেও তাঁদের মধ্যে উদ্বেগ, আতঙ্ক, শঙ্কা কাটেনি। এরপরও ভোটাররা একটি ভালো নির্বাচনের প্রত্যাশা করছেন। সবাই চান কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে।

খুলনার ৪ নম্বর ঘাট এলাকায় পাওয়া গেল একদল শ্রমিককে। কাজের ফাঁকে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন তাঁরা। সবাই একযোগেই বললেন, সকাল আটটার আগেই ভোটকেন্দ্রে যাবেন। পরিস্থিতি ভালো দেখলে ভোট দেবেন। না হলে ফিরে যাবেন। পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার আশঙ্কা আছে কি না, জানতে চাইলে তাঁরা শুরুতে কিছুটা চুপসে যান। পরে আবার বলে ওঠেন, ‘কিছুটা তো আছেই।’ পাল্টা প্রশ্ন তাঁদের, ‘আপনারা দেখছেন না? বুঝছেন না?’

মো. সেলিম নামের একজন ব্যবসায়ী জানালেন, তিনিও সকাল সকাল কেন্দ্রে যাবেন। পরিস্থিতি ভালো দেখলে ভোট দিয়ে বাসায় ফিরে স্ত্রী ও অন্যদের নিয়ে কেন্দ্রে যাবেন। খারাপ দেখলে পরিবারের অন্যদের ভোট দিতে পাঠাবেন না।

সুমাইয়া স্নিগ্ধা নামের এক শিক্ষার্থী জানালেন তাঁর আশঙ্কার কথা। কেন্দ্র কতটা নিরাপদ, সেটার খোঁজখবর নিয়ে ভোটকেন্দ্রে যাবেন তিনি। এই তরুণী বললেন, ভোট দিলে ব্যক্তিগত লাভ নেই। সামষ্টিক লাভ। ভোট দিতে গিয়ে ব্যক্তিগত কোনো ক্ষতি হলে সেটা হবে একান্তই ব্যক্তিগত। ক্ষতি হলে যার জন্য যাব, তিনিও খবর পর্যন্ত নেবেন না।

ইজিবাইকচালক মো. মুন্না জানালেন আটটার আগেই ভোট দিয়ে আসার ইচ্ছা আছে। তিনি বলেন, ‘গন্ডগোল হলে তো পরে হবে। তাই সবার আগেই ভোট দিয়ে চলে আসব।’

নির্বাচনের ১২ ঘণ্টা আগে নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ করেন বিএনপির প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু। ছবি: সাদ্দাম হোসেন
নির্বাচনের ১২ ঘণ্টা আগে নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ করেন বিএনপির প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু। ছবি: সাদ্দাম হোসেন

কেডিএ রোডে চায়ের দোকানে কথা হলো বেশ কয়েকজনের সঙ্গে। তাঁরা বললেন, ভোট ভালোভাবেই হবে। সরকারি দলের পক্ষ থেকে ভোটার বা অন্য কারও ওপর কোনো চাপ নেই। তবে বোঝা যাচ্ছে না ভোটের দিন সকালে কী হয়।

ভোটারদের আশঙ্কার মূলে রয়েছে নির্বাচন  শুরু হওয়ার পর থেকে ভোটের আগের দিন পর্যন্ত সার্বিক পরিস্থিতি। প্রধান দুই প্রার্থীর অভিযোগ আর পাল্টা অভিযোগে শুরু থেকে উত্তপ্ত ছিল মহানগরীর নির্বাচনী অঙ্গন। বিএনপির পক্ষ থেকে নির্বাচনে ‘ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের’ অভিযোগ এসেছে গতকাল দুপুরে। সরকারি দল পাল্টা একই অভিযোগ করেছে বিএনপির বিরুদ্ধে। পুলিশের বিরুদ্ধে বিএনপি নেতা-কর্মীদের হয়রানি আর গ্রেপ্তারের অভিযোগ ছিল নিয়মিত। নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে অভিযোগও শুরু থেকে করে আসছে বিএনপি।

এরই মধ্যে সোমবার ভোটের আগের দিন শহরের অবস্থা ছিল অনেকটাই থমথমে। ভোট নিয়ে কথা বলতে অনেককেই সতর্কভাব নিতে দেখা গেছে। অবস্থা বুঝে মুখ খুলেছেন। নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের মধ্যেও পরিস্থিতি নিয়ে রয়েছে মিশ্র মূল্যায়ন।

সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) খুলনার সভাপতি অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির প্রথম আলোকে বলেন, মানুষের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা আছে। কয়েক দিন আগে যে উৎকণ্ঠা ছিল তা অনেকটা কমেছে। ভোটের দিন সকালে মানুষের ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার আগ্রহ যতটা থাকবে, আস্তে আস্তে সেটা বাড়তে পারে। প্রথম দিকে মানুষ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবেন। পরে সিদ্ধান্ত নেবেন।

তবে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) খুলনা জেলা সম্পাদক কুদরত ই খুদা মনে করেন, ভোটের পরিবেশ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ভোটের পরিবেশ এখন অনেকটাই অনিশ্চিত (আনপ্রেডিকটেবল) অবস্থায় চলে গেছে। আজই (সোমবার) দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী একে অন্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে সংবাদ সম্মেলন করেছেন। একটা নির্বাচনের আগের দিন এ ধরনের কথাবার্তা সন্দেহ তৈরি করে।

রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. ইউনুচ আলী প্রথম আলোকে বলেন, অবাধ ও সুষ্ঠু ভোট করার জন্য তাঁদের যথেষ্ট প্রস্তুতি আছে। প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ (ঝুঁকিপূর্ণ) কেন্দ্রের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবে ২৪ জন পুলিশ ও আনসার। সাধারণ কেন্দ্রগুলোর প্রতিটিতে থাকবে ২২ জন করে। এর বাইরে পুলিশের ১১টি স্ট্রাইকিং দল (প্রতিটিতে ১০ জন করে), ৭০টি ভ্রাম্যমাণ দল (প্রতিটি ৭ জন করে), ১৬ প্লাটুন বিজিবি, র‍্যাবের ৩২টি ভ্রাম্যমাণ দল, ৩১ জন নির্বাহী হাকিম এবং ১০ জন বিচারিক হাকিম দায়িত্ব পালন করবেন।

নির্বাচন কমিশন বলছে, খুলনায় মোট ২৮৯টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ২৩৪টিকেই ঝুঁকিপূর্ণ (কমিশনের ভাষায় গুরুত্বপূর্ণ)। আর ৫৫টি সাধারণ বা ঝুঁকিমুক্ত কেন্দ্র আছে।

খুলনায় ২০১৩ সালে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থী মনিরুজ্জামান মনি বিজয়ী হন। ওই নির্বাচনে তালুকদার আবদুল খালেক পরাজিত হন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে খালেক মেয়র নির্বাচিত হন।