চীন ও রাশিয়ার অবস্থানে ক্ষুব্ধ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র

রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির। ফাইল ছবি
রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির। ফাইল ছবি

রোহিঙ্গা সমস্যার ভয়াবহতা কতটা গুরুতর, সেটা সম্প্রতি বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সফরের পর যথার্থভাবে বুঝতে পেরেছে নিরাপত্তা পরিষদ। রোহিঙ্গারা যে রাখাইনে জাতিগত নির্মূলের শিকার, সেটাও বলেছেন নিরাপত্তা পরিষদের কোনো কোনো প্রতিনিধি।

গত ২৮ এপ্রিল থেকে ৩ মে পর্যন্ত জাতিসংঘের প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সফর করে। গত সোমবার সফর-পরবর্তী ব্রিফিংয়ে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের ওপর জোর থাকলেও বিষয়টি নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের স্পষ্ট বিভাজন আবার চোখে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো মিয়ানমারের ওপর চাপ দেওয়ার কথা বললেও এর বিরোধিতা করেছে রাশিয়া ও চীন।

নিউইয়র্কের একটি কূটনৈতিক সূত্র গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে প্রথম আলোকে জানিয়েছে, ব্রিফিং শেষে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদেশগুলো রুদ্ধদ্বার বৈঠক করে। সেখানে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্সের মতো পরিষদের স্থায়ী সদস্যরা এ বিষয়ে একটি প্রস্তাব নেওয়ার কথা তোলে। কিন্তু রাশিয়া ও চীন এখনই কোনো ধরনের প্রস্তাব নেওয়ার বিরোধিতা করে। তাদের ওই অবস্থানে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এমন এক পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা পরিষদ যে খুব শিগগির মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না, সেটা একরকম নিশ্চিতই বলা যায়।

কূটনৈতিক সূত্রটি জানিয়েছে, রাশিয়া ও চীন নিরাপত্তা পরিষদের সর্বশেষ রুদ্ধদ্বার আলোচনায় মিয়ানমারের বিরুদ্ধে প্রস্তাব নেওয়ার বিরোধিতা করে থেমে থাকেনি। স্থায়ী দুই সদস্যদেশের প্রতিনিধিরা পরিষদের সর্বশেষ বিবৃতি অনুযায়ী কাজ করার জন্য মিয়ানমারকে যাতে সময় দেওয়া হয়, সে কথাও বলেছেন। রাশিয়া ও চীনের ওই বক্তব্যের পর নিউইয়র্কে যুক্তরাজ্যের স্থায়ী প্রতিনিধি কারেন পিয়ার্স মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চিকে চিঠি লেখার প্রস্তাব দেন। তাঁর মতে, প্রস্তাবিত ওই চিঠিতে রাখাইনে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থাকে অবারিতভাবে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া, দ্রুত ইউএনএইচসিআর ও ইউএনডিপির সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই করা, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সহিংসতার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করা এবং পরিষদের সভাপতির বিবৃতিতে দেওয়া সুপারিশ বাস্তবায়নে অগ্রগতির প্রসঙ্গগুলো থাকতে হবে। চীন শুরুতে এ ধরনের চিঠি পাঠানোর বিরোধিতা করে। পরে পরিষদের অন্য এক সদস্য বাংলাদেশকেও চিঠি পাঠানোর প্রস্তাব করলে তাতে সাড়া দেওয়ার আগ্রহ দেখায় চীন।

পরে যুক্তরাজ্যের স্থায়ী প্রতিনিধি দুটি চিঠি পাঠানোর কথা বলে আলোচনা শেষ করেন। নিরাপত্তা পরিষদের বেশ কয়েকটি সদস্যদেশের প্রতিনিধি এবং জাতিসংঘের কর্মকর্তাদের আশঙ্কা, এ ধরনের চিঠি মিয়ানমারের ওপর তেমন কোনো প্রভাব ফেলবে না। এ নিয়ে যুক্তরাজ্যের স্থায়ী প্রতিনিধি কারেন পিয়ার্সের মত হচ্ছে, এ সমস্যা নিয়ে পরিষদের অভিন্ন অবস্থানের প্রতিফলন হচ্ছে এই চিঠি।

এদিকে রুদ্ধদ্বার বৈঠকের আগে ব্রিফিংয়ে অধিকাংশ বক্তাই সংকট সমাধানে মিয়ানমার সরকার যে শ্লথ গতি নীতি গ্রহণ করেছে, তার সমালোচনা করেন। তবে চীন ও রাশিয়া সংকট সমাধানে মিয়ানমার সরকারের ভূমিকায় সন্তোষ প্রকাশ করে। চীনের প্রতিনিধি রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে দ্বিপক্ষীয় সমাধানের ওপর জোর দিয়ে প্রকারান্তরে মিয়ানমারের পক্ষে বলেছেন। এ সমস্যাটিকে ‘আন্তর্জাতিকীকরণ’ করার বিরোধিতা করেছে চীন। রাশিয়াও চীনের সুরে বলেছে, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমস্যার সমাধান করতে হবে। মিয়ানমারের ওপর চাপ দেওয়ার বিষয়টিতে জোর দেওয়ার নামে বাইরের শক্তিগুলোকে তাদের সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা বন্ধ করতে হবে।

কুয়েতের স্থায়ী প্রতিনিধি মনসুর আইয়াদ আলোতাইবি বলেন, ‘অনেক পিতৃমাতৃহীন শিশু এখনো তাদের বাবা-মায়ের নাম ধরে কেঁদে চলেছে। তাদের কান্না ও চিৎকার আমি এখনো ভুলতে পারি না। রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের হাতে যেভাবে গ্রামের পর গ্রাম ধ্বংস করা হয়েছে, তা থেকে স্পষ্ট রোহিঙ্গারা শুধু তাদের জাতিগত পরিচয়ের কারণে ধ্বংস ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এ ঘটনা “জাতি নির্মূলকরণ” ছাড়া অন্য কিছু নয়।’

কাজাখস্তানের রাষ্ট্রদূত দিদার তেমেনফ তাঁর অভিজ্ঞতার বিবরণ দিয়ে বলেন, ‘চোখের সামনে বিশ্বের বৃহত্তম উদ্বাস্তু সংকট দেখার পর আমরা শুধু প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়েছি তা-ই নয়, আমাদের বিবেকও জাগ্রত হয়েছে। এই অভিজ্ঞতা সমস্যার সমাধানে বলিষ্ঠ ও সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণে আমাদের অনুপ্রাণিত করবে।’

সংকট সমাধানের জন্য মিয়ানমার সরকারকেই উদ্যোগী হওয়ার কথাও বলেন অনেক সদস্য। এ ব্যাপারে কালক্ষেপণের বিরোধিতা করে তাঁরা দ্রুত রাজনৈতিক সমাধানের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তাঁদের মতে, এ লক্ষ্যে নিরাপত্তা পরিষদের উচিত হবে অবিলম্বে একটি সর্বসম্মত প্রস্তাব গ্রহণ করা। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত নিকি হেইলি স্বীকার করেন, এ ধরনের প্রস্তাব প্রশ্নে কোনো কোনো সদস্যদেশ এখনো আপত্তি করে যাচ্ছে। তা সত্ত্বেও নিরাপত্তা পরিষদের উচিত হবে প্রস্তাব গ্রহণের ব্যাপারে উদ্যোগী হওয়া।

পেরুর রাষ্ট্রদূত গুস্তাভো মেজা-কুয়ার্দো জানান, মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি পরিষদের সদস্যদের আশ্বাস দেন, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে আনতে তিনি উদ্গ্রীব। সু চি জানান, এ জন্য নাগরিকত্বের ব্যাপারে কিছু আইন পরিবর্তনের প্রয়োজন, যা সম্পন্ন করতে সময় লাগছে।

সংকটের রাজনৈতিক সমাধানের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে যুক্তরাজ্যের রাষ্ট্রদূত কারেন পিয়ার্স বলেন, নাগরিকত্বের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে এ পর্যন্ত খুব সামান্যই অগ্রগতি হয়েছে। তবে রোহিঙ্গা প্রশ্নে শান্তিপূর্ণ সমাধানে নিরাপত্তা পরিষদের সব সদস্যের ঐকমত্য রয়েছে, যা গভীরভাবে আশার সঞ্চার করেছে।

মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত হাউ দো সুয়ান শরণার্থী প্রত্যাবাসনে বিলম্বের সব দোষ বাংলাদেশের ওপর চাপিয়ে দিয়ে বলেন, নিবন্ধনের জন্য আবেদনের যে ছক বাংলাদেশ ব্যবহার করেছে, সেটি ভুল ছিল। এতে সত্যতা যাচাইয়ের জন্য আঙুলের ছাপ, স্বাক্ষর ও ফটো অন্তর্ভুক্তির কথা থাকলেও সেটি রক্ষিত হয়নি। আন্তর্জাতিক সহানুভূতি পাওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকার মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করছে বলে অভিযোগ তোলেন তিনি।

জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন মিয়ানমারের সমালোচনার জবাবে বলেন, রোহিঙ্গাদের জন্য এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি হলো নাগরিকত্বের প্রশ্নের সমাধানের পাশাপাশি মানবাধিকার ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের নিশ্চয়তা। তিনি বলেন, মিয়ানমার দাবি করেছে, তারা শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিতে অভ্যর্থনা কেন্দ্র নির্মাণ করেছে। কিন্তু ৪০০ ভস্মীভূত গ্রামের ছবি দেখার পর সেখানে প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারে এসব শরণার্থীর উৎসাহিত হওয়ার কথা নয়। তিনি জানান, শরণার্থী কেন্দ্রগুলোতে সন্ত্রাসী আশ্রয়ের যে দাবি তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। এই সংকট সমাধানের লক্ষ্যে নিরাপত্তা পরিষদের উচিত মিয়ানমারের পরিস্থিতি প্রশ্নে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা।