প্রমাণ না হলে কিসের হত্যা?

>গুরুতর ছয় অপরাধে ঢাকার পাঁচটি ট্রাইব্যুনালে ১৫ বছরে আসা প্রায় আট হাজার মামলার বিচার পরিস্থিতি নিয়ে প্রথম আলোর দীর্ঘ অনুসন্ধান। ধারাবাহিক আয়োজনে আজ যৌতুক বা ধর্ষণে মৃত্যু-হত্যা এবং যৌনপীড়ন ও আত্মহত্যায় প্ররোচনার মামলার চিত্র।

সব কথার শেষে নিশ্চিত সত্য শুধু এটুকুই যে গভীর রাতে ঢাকার উত্তরায় স্বামীর ঘরে পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা হনুফা বেগম আগুনে দাউ দাউ করে জ্বলছিলেন। প্রায় ৬০ ঘণ্টা পর বাবার বাড়ি নরসিংদীতে তিনি মারা যান। এর বাইরে বাকি সবই ‘অভিযোগ’, যা আদালতে প্রমাণিত হয়নি।

১০ হাজার টাকা যৌতুকের দাবিতে স্বামী মনির হোসেন মেরেপিটে হাত-পা বেঁধে কেরোসিন ঢেলে হনুফাকে পুড়িয়ে মেরেছেন-এই অভিযোগে মেয়ের মৃত্যুর পরপর বাবা উত্তরা এসে মামলা করেছিলেন। এজাহারে তিনি লেখেন, ১২ দিন আগে মেয়ে নরসিংদী গিয়ে বলে এসেছিলেন, টাকাটা না দিলে স্বামী তাঁকে মেরে ফেলবেন।

আদালতে মামলাটি ১০ বছরের বেশি চলে। তারপর রায়ে পলাতক স্বামী খালাস পান। মামলার নথি বলতে এই রায়ই হাতে এসেছে। সেখানে অনেক প্রশ্নের জবাব নেই।

সেসব প্রশ্নে যাওয়ার আগে আরেকটি হত্যার ঘটনা দেখা যাক। ২০০৭ সালে ঢাকার দক্ষিণখানে এক বাড়িতে ১৬ বছরের একটি মেয়ে কাজ করত। বাড়িওয়ালার ফোনে তার মৃত্যুসংবাদ পেয়ে ঢাকায় এসে মামলা করেন তার এক মামা। তদন্তে বের হয়, মেয়েটিকে ধর্ষণের পর গলায় ওড়না পেঁচিয়ে মারা হয়েছে। কিন্তু অভিযুক্ত ব্যক্তিটি গত বছর বেকসুর খালাস পান।

ঢাকার পাঁচটি ট্রাইব্যুনালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ১৫ বছরে আসা ৪২১টি হত্যা মামলার তথ্য প্রথম আলো বিশ্লেষণ করেছে। এর মধ্যে ছিল যৌতুকের জন্য হত্যা বা হত্যাচেষ্টা এবং ধর্ষণজনিত মৃত্যু ও হত্যার মামলা। আরও ছিল ফৌজদারি দণ্ডবিধিতে করা ছয়টি হত্যা মামলা, যেগুলোর চারটিই আসলে ধর্ষণজনিত হত্যার মামলা। এসব মামলার ৮৪ শতাংশই যৌতুকের জন্য হত্যার। আর ১৫ শতাংশ ধর্ষণের জেরে মৃত্যু ও হত্যার। প্রথম আলো তিন ধরনের ১৬টি হত্যা মামলার তথ্য আলাদা করে খুঁটিয়ে দেখেছে।

হনুফার মামলাটিতে প্রমাণের বিষয় ছিল, ১০ হাজার টাকা যৌতুকের জন্য স্বামী তাঁর গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়েছেন এবং সে কারণেই তিনি মারা গেছেন। আগুনে পুড়ে মারা গেলে ময়নাতদন্ত ও অন্যান্য পরীক্ষায় হত্যার আলামত না-ও পাওয়া যেতে পারে। হত্যা যদিও-বা প্রমাণিত হয়, এর পেছনে যৌতুকের দাবির বিষয়টি প্রতিষ্ঠা করতে হয়। নয়তো আসামি ছাড়া পেয়ে যান।

দক্ষিণখানের মেয়েটির মামলাতে প্রমাণ করতে হতো, আসামি ধর্ষণ করেছেন এবং পরে সে কারণেই মেয়েটিকে তিনি মেরে ফেলেছেন। ময়নাতদন্তে ধর্ষণ এবং হত্যার আলামত পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু অভিযুক্ত ব্যক্তিই যে ধর্ষণ করেছিলেন, রাষ্ট্রপক্ষ সেটা প্রমাণের মতো সাক্ষী বা প্রমাণ হাজির করেনি।

দুটি ক্ষেত্রেই আরেক সাধারণ প্রবণতা, মামলা দীর্ঘদিন ঝুলে থাকা। যৌতুকের জন্য হত্যার চলমান মামলাগুলোর ২২ শতাংশ এবং ধর্ষণ ও হত্যা মামলাগুলোর ২১ শতাংশ ১০ থেকে ১৪ বছর ধরে চলেছিল আদালতে। অবশ্য মামলা নিষ্পত্তির প্রবণতায় কিছু পার্থক্যও দেখা যায়।

নিষ্পন্ন হওয়া যৌতুকের মামলার ৪ শতাংশে সাজা হয়েছে। ধর্ষণজনিত মৃত্যু বা হত্যা মামলার সংখ্যা খুব কম (৬১ টি)। এর অর্ধেকের মতো নিষ্পন্ন হয়েছে, সেখানে সাজার হার তুলনামূলকভাবে বেশি (২৫ শতাংশ)। তবে অব্যাহতির হারও অনেক বেশি। অর্থাৎ হয় পোক্ত প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে, নয়তো কাউকে ধরাই যাচ্ছে না।

যৌতুকের জন্য হত্যা?
আইন অনুযায়ী, বর বা বরের তরফের কেউ যদি কখনো বিয়ে হওয়া বা টিকিয়ে রাখার শর্ত হিসেবে জিনিসপত্র, টাকাপয়সা-সম্পদ দাবি করে, সেটা হবে যৌতুক। একইভাবে কনেপক্ষ যদি এসব কিছু দেয় বা দিতে রাজি হয়, সেটাও যৌতুক। প্রমাণ করা কঠিন যে এমন দাবি বা দেওয়া-থোয়া হয়েছিল এবং সেটা বিয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত।

যৌতুকের অভিযোগ প্রমাণ করতে না পারলে হত্যারই বিচার পাওয়া যায় না। হনুফাকে যে ওই রাতে তাঁর স্বামী যৌতুকের দাবিতে হত্যা করেছেন-এ কথাটা তাঁর বাবা এজাহারে লিখেছিলেন প্রতিবেশীদের বরাত দিয়ে।

কিন্তু ট্রাইব্যুনাল ২-এ সাক্ষ্য দিতে এসে তিনজন প্রতিবেশী বলেন, যৌতুক চাওয়ার কোনো কথা কখনোই তাঁরা শোনেননি। ঘটনার কিছুই দেখেননি, দরজা ভেঙে হনুফাকে উদ্ধার করেছিলেন। মনির সেখানে ছিলেন না। ঘরের বেড়া ভাঙা ছিল। কেরোসিনের স্টোভ মাটিতে গড়াচ্ছিল, তবে তাতে আগুন ছিল না।
সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) তাঁদের বৈরী ঘোষণা করে জেরা করেন। তাঁদের সাক্ষ্যে কিছু অসংগতিও ছিল। তবে মূল কথা থেকে তাঁরা সরেননি।
অভিযোগ গঠনের সময় হনুফার স্বামী গ্রেপ্তার ছিলেন, পরে জামিনে বেরিয়ে পলাতক অবস্থায় খালাস পান। ময়নাতদন্ত হয়েছে কি না, মামলার রায়ে তার উল্লেখ নেই। ঘটনার সময় মনির কোথায় ছিলেন, সে ব্যাপারেও কোনো তথ্য নেই।

এজাহার অনুযায়ী, প্রতিবেশীরা হনুফাকে হাসপাতালে নেন। তবে বাবাকে খবর দেন এক দিন পর। রায়ে লেখা আছে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল গুরুতর দগ্ধ হনুফাকে চিকিৎসার জন্য না রেখে ফিরিয়ে দেয়। কিন্তু বাবা কোথা থেকে হনুফাকে নরসিংদী নিয়ে গেলেন, তা বলা নেই। রাষ্ট্রপক্ষ বাবাকে সাক্ষ্য দিতে হাজির করেনি। রায়ে এসব প্রশ্নের জবাবও নেই।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মাকছুদা আখতার প্রথম আলোকে বলেন, সাধারণত যৌতুকের জন্য হত্যা শ্বশুরবাড়িতে হয়। নিহত মেয়েটির পরিবারের কেউ তাৎক্ষণিক কিছু জানতে পারে না। আসামিপক্ষ সাজিয়ে-গুছিয়ে তথ্য দেয়, হত্যাকে আত্মহত্যা প্রমাণ করার চেষ্টা করে। প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী কদাচিৎ থাকে। ময়নাতদন্ত বা অন্যান্য পরীক্ষার রিপোর্ট নিয়েও দুর্নীতির অভিযোগ আছে।

বিচারে দীর্ঘসূত্রতা
ঝুলে থাকতে থাকতে কখনো মামলার পুরো মানচিত্রই পাল্টে যায়। ৩০ বছরের বিবাহিত স্ত্রী মিনারা বেগমকে লাঠি দিয়ে মেরে মাথা ফাটিয়ে দাঁত ভেঙে দিয়েছিলেন স্বামী ফজলুল হক। তাঁদের বড় ছেলে (১৫) মামা কামরুল হাসানকে খবর দিলে তিনি এসে বোনকে হাসপাতালে নেন। সেখানে মিনারা মারা যান।

১০ লাখ টাকা যৌতুকের দাবিতে ফজলুল তাঁর ভাইবোনদের সঙ্গে মিলে মিনারাকে পিটিয়েছেন-এই অভিযোগে কামরুল মামলা করেন। পুলিশের তদন্তে তাঁরা অভিযুক্ত হন। ২০১৪ সালের এ ঘটনায় ৪ নম্বর ট্রাইব্যুনাল এখনো অভিযোগ গঠন করেননি। ইতিমধ্যে ফজলুল মারা গেছেন।

গত এপ্রিলে মামলার এজাহারকারী কামরুল বলেন, ফজলুলের ভাই পলাতক। তাঁর খোঁজে কাগজে বিজ্ঞাপন দিতে গিয়ে দেরি হচ্ছে। ক্ষুব্ধ কামরুল বলেন, ‘হয়রানি, সময় নষ্ট, টাকা টাকা টাকা।’ তাঁর অভিযোগ, আদালতের কর্মচারীরা আসামিপক্ষের কাছ থেকে টাকা নিয়ে দেরি করছেন।

ধর্ষণ থেকে হত্যা
দক্ষিণখানে গৃহকর্মী ধর্ষণ ও হত্যা মামলায় প্রথমে এক ভাড়াটেকে আসামি করা হয়েছিল। পরে পুলিশের তদন্তে যিনি অভিযুক্ত হন, তিনি বাড়িওয়ালার ছোট ভাই। হাকিমের কাছে জবানবন্দিতে তিনি বলেন, মেয়েটিকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক করেছিলেন। কিন্তু তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) অভিযোগপত্রে এসব কিছুই লেখেননি।

সাক্ষীর তালিকায় আইও আসামির তিন ভাইবোনকে রেখেছেন। মামলার এজাহারকারী ভুক্তভোগীর গ্রামসুবাদে মামা। তিনি সাক্ষ্যই দেননি। গত এপ্রিলে তাঁকে ফোন করলে তাঁর ছোট ভাই ধরেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মেয়েটির পরিবার খুব গরিব। এলাকায় মেম্বার-চেয়ারম্যান ডেকে আসামিপক্ষের কাছ থেকে পরিবারটিকে দেড় লাখ টাকা নিয়ে দেওয়া হয়েছে। আপসের শর্ত মেনে কেউ সাক্ষ্য দিতে যাননি।

দক্ষিণখানেরই এক এলাকায় একটি হোটেলের ঘরে ২০১১ সালের এপ্রিলে ছয় বছর বয়সী একটি মেয়ের লাশ পাওয়া যায়। ময়নাতদন্তে গুরুতর আঘাতের সঙ্গে ধর্ষণ এবং শ্বাসরোধের আলামত পাওয়া যায়। মেয়েটির ভাই তাঁদের মামাতো ভাইয়ের বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও হত্যার মামলা করেন।

আসামি গ্রেপ্তার হলে হাকিমের কাছে জবানবন্দি দিয়ে বলেন, ফুপুর সঙ্গে শত্রুতার জের ধরে মেয়েটিকে ধর্ষণ ও হত্যা করেছেন। তাকে তিনি সিলেট থেকে ঢাকায় চিড়িয়াখানা দেখানোর কথা বলে এনেছিলেন। মামলাটি চলছে ট্রাইব্যুনাল ২-এ। গত মাসে মামলার এজাহারকারী বলেন, এখন পর্যন্ত তাঁদের কেউ সাক্ষ্য দিতে ডাকেনি। অভিযুক্ত যুবক জামিনে বেরিয়ে বাড়িতে আছেন।

অনেক সময় অপরাধীকে চিহ্নিতই করা যায় না। ২০১৫ সালের নভেম্বরে পুলিশ দক্ষিণ যাত্রাবাড়ীর মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারের নিচে পরিত্যক্ত এক টং-দোকানে ১২ বছর বয়সী একটি মেয়ের পচা-গলা মৃতদেহ পায়। মেয়েটি ‘পাগল’, রাস্তায় থাকত।

ময়নাতদন্ত বলে মেয়েটিকে ধর্ষণের পর শ্বাসরোধ করে মারা হয়েছে। ধর্ষণ ও হত্যার মামলা হয়। পুলিশ ও সিআইডির কর্মকর্তারা দুই দফায় তদন্ত করে মেয়েটির পরিচয় পাননি, অপরাধীকেও বের করতে পারেননি। দ্বিতীয় চূড়ান্ত প্রতিবেদন বলে, ঘটনা সত্য। কিন্তু এলাকার লোকজন বা সাক্ষীরা আর সেখানে নেই। পুলিশবক্সের সিসি ক্যামেরার ফুটেজও নেই। ট্রাইব্যুনাল ২ এখনো প্রতিবেদনটি গ্রহণ করেননি।

সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ মো. রেজাউল হায়দার বলছেন, গণধর্ষণের ক্ষেত্রেও সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া কঠিন হয়। তিনি বলেন, ঘটনা রাতে হলে মেয়ে যদি জীবিতও থাকে, আসামিদের চেনা কঠিন, ‘আসামি পাওয়া না গেলে চার্জশিট কার বিরুদ্ধে দেওয়া হবে?’

আইনজীবী আমিনুল গণি প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের মামলায় আইওরা অদক্ষতার পরিচয় দেন-‘যেসব আলামত সংগ্রহ খুব জরুরি, সেগুলো অনেক সময় নেওয়া হয় না।’ আলামতের রাসায়নিক বা অন্য পরীক্ষাও ঠিকমতো করা হয় না।

হত্যা থেকে আত্মহত্যায় প্ররোচনা
রাজশাহীর ওয়াহিদা সিফাত ভালোবেসে সহপাঠী মো. আসিফকে বিয়ে করেছিলেন। বিয়েটি সুখের হয়নি। ২০১৫ সালের মার্চে একদিন সিফাতের শ্বশুর তাঁর ভাইকে ফোন দিয়ে জানালেন, সিফাত আত্মহত্যা করেছেন।

সিফাতের মরদেহের নানা জায়গায় জখম ছিল। নাক-মুখে রক্তের দাগ। প্রথম ময়নাতদন্তে চার ঘণ্টার মধ্যে ডাক্তার ‘আত্মহত্যা’ বলে রিপোর্ট দেন। সিফাতের চাচা ২০ লাখ টাকা যৌতুকের দাবিতে হত্যার অভিযোগে মামলা করেন।

লাশ কবর থেকে তুলে ৫৮ দিন পর আবার ময়নাতদন্ত হয়। প্রতিবেদন বলে, মাথায় রক্ত জমাট বাঁধার চিহ্ন ছিল এবং মৃত্যুটি হত্যার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ বলে মনে হচ্ছে। মামলাটি রাজশাহীর নারী-শিশু ট্রাইব্যুনাল থেকে ঢাকায় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৩-এ এলে গত ডিসেম্বরে এর রায় হয়।

রায়ে বলা হয়, সাক্ষ্যনির্ভর এই মামলায় যৌতুক বা হত্যা কোনো অভিযোগই সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়নি। কিন্তু আসামিপক্ষই বলেছে, সিফাত আত্মহত্যা করেছেন। আর পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য-প্রমাণ বলছে, আসিফ তাঁকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করেছেন। বিচারক তাই তাঁকে দণ্ডবিধির এ-সংক্রান্ত ধারায় ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও ১০ হাজার টাকা জরিমানা দেন।

ফৌজদারি দণ্ডবিধির হত্যা মামলাতেও একই রকম নজির আছে। মিরপুরে মাফরুদা হক সুতপা শ্বশুরবাড়িতে মারা গেলে ভাই আমিনুল হক হত্যা মামলা করেন দণ্ডবিধিতে। তিনি অভিযোগ করেন, বিয়ের পর থেকে সুতপাকে স্বামী ইমরুল সাদাত ও তাঁর বাবা-মা অত্যাচার করতেন, হত্যার হুমকিও দিয়েছেন।

কিন্তু ময়নাতদন্ত বলে মৃত্যুর কারণ ফাঁসিতে ঝোলার ফলে শ্বাসরুদ্ধ হওয়া এবং ধরন আত্মহত্যা। মামলাটির রায়ে মুখ্য মহানগর হাকিম গত বছর বলেন, সাক্ষ্য-প্রমাণ বলছে স্বামীর নির্যাতন মাফরুদাকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করেছে। তিনি দণ্ডবিধির এ-সংশ্লিষ্ট ধারায় আসামিকে তিন বছরের কারাদণ্ড দেন।

সুতপার ভাই আমিনুল বলেন, বহু দিন সাক্ষীদের নিয়ে গিয়ে ফিরে এসেছেন। বিচার পাওয়ার আশায় আবার গেছেন। তাঁর ক্ষুব্ধ মন্তব্য, ‘আট বছরে বহু পুলিশ দেখেছি, পিপিও দেখেছি।’ এই সাজা তাঁকে হতাশ করেছে। তাঁরা বলছেন, ন্যায়বিচারের জন্য প্রতি পদে যুদ্ধ করতে হয়। মামলায় জিততে হলে পরিবারের কাউকে না কাউকে সব সময় এর পেছনেই লেগে থাকতে হয়। এ যুদ্ধ খুব কঠিন।

‘মিথ্যা মামলা’ ও আপস
সিআইডির পরিদর্শক মো. ইব্রাহিম প্রথম আলোকে বলেন, অভিযোগকারীরা শ্বশুরবাড়ির সবাইকে আসামি করেন। আরেক পরিদর্শক নূরুল ইসলাম বলেন, বাড়তি আসামি ছাঁটাই করতে অনেক সময় চলে যায়।

২০১৬ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় বিচার বিভাগীয় সম্মেলনে একজন বিচারক তাঁর উপস্থাপিত নিবন্ধে বলেছিলেন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ৮০ শতাংশ মামলা যৌতুক-সংক্রান্ত। এগুলোর ব্যাপক অংশ যৌতুকের জন্য মারপিট বা জখমের অভিযোগে করা। কিন্তু সেখানে অনেক সময়ই যৌতুকের বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত হয় না।

তবে আইনজীবী ফাহমিদা আক্তার তাঁর এক দশকের অভিজ্ঞতায় বলছেন, স্বামীর বাড়িতে নির্যাতনের শিকার নারী আইনে অন্য সুযোগ না থাকায় যৌতুকের জন্য মারপিটের অভিযোগে মামলা করেন। নির্যাতনের ঘটনা হয়তো সত্য, ‘কিন্তু যৌতুক যখন প্রমাণ হচ্ছে না, তখন আমরা বলছি, মিথ্যা মামলা হচ্ছে।’ যৌতুকের জন্য হত্যা মামলার ক্ষেত্রেও কথাটা খাটে। মামলার দীর্ঘসূত্রতা, নিহত নারীর রেখে যাওয়া সন্তানের কথা ভেবে অনেক ক্ষেত্রে পরিবার পরে আপস করে ফেলে।

সাবেক পিপি ফারুক আহম্মেদ বলেন, তাঁর আমলে অন্তত দুটি যৌতুকের জন্য হত্যা মামলায় বাদীপক্ষ আর আসামিপক্ষের আপস হতে দেখেছেন। একটি মামলার এজাহারকারী ছিলেন একজন সরকারি কর্মকর্তা। একপর্যায়ে তিনি আর মামলা চালাতে না চাইলে পিপি মধ্যস্থতা করে আসামিপক্ষের কাছ থেকে ২০ লাখ টাকা আদায় করে দেন।

তদন্তে ত্রুটি, আসামি শনাক্ত করার ব্যর্থতা, অভিযোগপত্রে ফাঁকি, সাক্ষী না আনা, ঘটনার উদ্দেশ্য প্রমাণে ব্যর্থতা বা আপসের কারণে আসামি ছাড়া পায়। কেবল ভুক্তভোগীর ‘অস্বাভাবিক’ মৃত্যুটাই সত্য হয়ে থেকে যায়। অমীমাংসিত সত্য।