বাংলাদেশে উচ্চ রক্তচাপের রোগীর সংখ্যা বাড়ছে

অপরিকল্পিত নগরায়ণ, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও গড় আয়ু বৃদ্ধির কারণে দেশে উচ্চ রক্তচাপের রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে সম্প্রতি প্রকাশিত একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ৪০ বছরের বেশি বয়সী মানুষের মধ্যে ২৬ শতাংশই উচ্চ রক্তচাপে ভুগছে।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলছেন, উচ্চ রক্তচাপ হৃদ্‌রোগ ও স্ট্রোকের (মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ) ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। বাংলাদেশে অপরিণত বয়সে বেশি মৃত্যু হচ্ছে হৃদ্‌রোগ ও স্ট্রোকে। দীর্ঘদিন অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপে ভোগা মানুষের কিডনি নষ্ট হয়ে যায়। দেশে কিডনি রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা দেড় কোটির বেশি।

হৃদ্‌রোগ বিশেষজ্ঞ ও ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা জাতীয় অধ্যাপক আবদুল মালিক প্রথম আলোকে বলেন, উচ্চ রক্তচাপ দেশে সাইলেন্ট কিলার বা নীরব ঘাতক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। মানুষ জানতেই পারে না সে উচ্চ রক্তচাপে ভুগছে। হঠাৎ হৃদ্‌রোগ, স্ট্রোক বা কিডনি রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর জানা যায়, এরা আসলে উচ্চ রক্তচাপেই ভুগছিল।

একজন সুস্থ মানুষের স্বাভাবিক রক্তচাপ ১২০/৮০ হয়। ওপরেরটিকে বলা হয় সিস্টোলিক (রক্তনালির দেয়ালের ওপর রক্তের চাপ) নিচেরটিকে বলা হয় ডায়াস্টলিক (রক্তনালির দেয়ালের স্বাভাবিক চাপ)। রক্তচাপের এই মাত্রা ১৪০/৯০ বা তার বেশি হওয়াই উচ্চ রক্তচাপ। রক্তনালি শক্ত হলে বা সরু হলে উচ্চ রক্তচাপ দেখা দেয়। বয়স বৃদ্ধি, ধূমপান রক্তনালিকে শক্ত করে। অন্যদিকে চর্বি জমে রক্তনালি সরু হয়।

উদ্বেগজনক পরিস্থিতি
বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে নিয়ন্ত্রণহীন উচ্চ রক্তচাপ নিয়ে আন্তর্জাতিক এই গবেষণায় নেতৃত্ব দেয় সিঙ্গাপুরের ডিউক-নাস মেডিকেল স্কুল। এই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ছিল বিশ্বের তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় এবং দুটি প্রতিষ্ঠান। দুই বছর ধরে গবেষণাটি হয়। গবেষণার ফলাফল সম্প্রতি প্রকাশ করেছে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস। এই গবেষণার অংশ হিসেবে ২০১৬ ও ২০১৭ সালে বাংলাদেশের মুন্সিগঞ্জ ও টাঙ্গাইল জেলার ১০টি অঞ্চলের ৪ হাজার ৪৪২ জন নারী ও পরুষের রক্তচাপ পরীক্ষা করা হয়। তাঁদের বয়স ছিল ৪০ বছর বা তার বেশি। দেখা গেছে, ১ হাজার ১৪৮ জনের বা ২৬ শতাংশের রক্তচাপ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি।

ত্রিদেশীয় এই গবেষণার বাংলাদেশ অংশের নেতৃত্ব দেন আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) সংক্রামক রোগবিষয়ক শাখার প্রধান আলেয়া নাহিদ। তিনি বলেন, উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত ব্যক্তিদের অর্ধেক জানে না যে তারা আক্রান্ত। যাদের উচ্চ রক্তচাপ আছে, তাদের তিনজনের একজন উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে ওষুধ খায়। আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ৫৮ শতাংশের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের বাইরে।

করণীয় কী
চিকিৎসকেরা বলছেন, উচ্চ রক্তচাপ মানুষের শরীরের প্রায় প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে কিডনির ওপর। কিডনি রোগীদের প্রায় ৮০ শতাংশের রক্তচাপ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকে। ৩০-৩৫ বছর বয়স থেকে নিয়মিত রক্তচাপ পরীক্ষা করা উচিত। উচ্চ রক্তচাপ শনাক্ত হলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত ওষুধ খেতে হবে। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে বাকি জীবন।

উচ্চ রক্তচাপ নিয়ে সরকারি উদ্যোগে জনসচেতনতা সৃষ্টির বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির পরিচালক নূর মোহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য হাসপাতালে অসংক্রামক ব্যাধি কেন্দ্র খোলা হয়েছে। সেখানে মানুষের রক্তচাপ পরীক্ষা করা ছাড়াও পরামর্শ ও ওষুধ দেওয়া হয়। এ ছাড়া মানুষকে সচেতন করার বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নেওয়া হচ্ছে।

উচ্চ রক্তচাপ দিবস আজ
উচ্চ রক্তচাপ বিষয়ে মানুষকে সচেতন করতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে ১৭ মে উচ্চ রক্তচাপ দিবস পালন করা হয়। উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সচেতনতার ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া দরকার বলে মনে করেন জাতীয় অধ্যাপক আবদুল মালিক। তাঁর পরামর্শ, পরিমিত লবণ খেলে, কায়িক পরিশ্রম করলে এবং ধূমপান না করলে উচ্চ রক্তচাপ থেকে দূরে থাকা যায়। এ ছাড়া চর্বিযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলাই ভালো। অনিয়ন্ত্রিত রক্তচাপের কারণে যেকোনো সময় মানুষ হৃদ্‌রোগ বা স্ট্রোকে আক্রান্ত হতে পারে। উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে না রাখলে মৃত্যুঝুঁকি অনেক বেড়ে যাবে।