এঁরা আসলে অন্য রকম, অন্য সবার মতো নন

ক্রেতা চান সবকিছু ঝটপট হবে। কিন্তু বিক্রেতা ক্রেতার কথা শুনলেন কি না, তা বোঝা যাচ্ছে না। ক্রেতার বড় তাড়া—সেই কখন খাবারের ফরমাশ দিয়েছেন! অপেক্ষার পালা না হয় শেষ হলো, আবার খাবার প্যাকেট করে দিলেও বিল দিতে এত দেরি করছেন কেন? 

ক্রেতা একপর্যায়ে বুঝতে পারেন, বিক্রেতা যাঁরা খাবার প্যাকেট করে দিলেন, তাঁদের মধ্যে কিছু একটা অস্বাভাবিকতা রয়েছে, ওদের গায়ের এপ্রোনে লেখা—ডিফারেন্টলি অ্যাবল, নট ডিজ্যাবল। এঁরা আসলে অন্য রকম, অন্য সবার মতো নন।

৫ মে রাজধানীর গুলশানে অবস্থিত অটিস্টিক, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী, বাক-শ্রবণপ্রতিবন্ধীসহ বিশেষ চাহিদা আছে, এমন লোকজনের পরিচালনায় ফুড সার্ভিস আউটলেট ‘অ্যাঞ্জেল শেফ’-এ গিয়ে দেখা যায় এ চিত্র। দেখা গেল, যে ক্রেতা মাছের আকৃতির ‘চিকেন ফিশ’ নিতে গিয়ে চরম বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন, তিনিই অ্যাঞ্জেল শেফে যাঁরা কাজ করছেন তাঁদের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছেন। কেউ কেউ নিয়মিতই আসেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ক্রেতা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি এখানে নিয়মিত আসি। খাবার কিনি। কিন্তু তাঁরা কোনো না কোনো প্রতিবন্ধকতার শিকার, তা মনে করিয়ে দিই না। সবারই এ কাজটা করা উচিত।’

আরেকজন নারী ক্রেতাও জানালেন, তাঁর নয় বছর বয়সী এক সন্তান অটিস্টিক। এখানে এলে তিনি মনে সাহস পান যে তাঁর ছেলেও ভবিষ্যতে কোনো না কোনো কাজ করতে পারবে। আর এখানকার খাবারের মান খুব ভালো।
অটিস্টিক হিশাম, ডাউনসিনড্রমের দোলন বা বাক-শ্রবণপ্রতিবন্ধী লিজাসহ সবাই যাঁর যাঁর কাজ নিয়ে ব্যস্ত। ক্রেতা আসামাত্রই হিশাম ক্রেতা যে জিনিসটি চাইলেন তার দাম কত, ক্রেতা কত দিলেন, আবার ক্রেতাকে কত ফেরত দিতে হবে, তা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ছিলেন। মনে মনে নিজেই হিসাব করে পরে ক্যালকুলেটরে মেলাচ্ছিলেন। আবার কোনো কোনো সময় একেবারেই আনমনা। অন্যদিকে যে ক্রেতারা সেখানে বসেই খাবার খাচ্ছেন তাঁদের খাবার দেওয়া এবং খাওয়া শেষে জায়গাটি পরিষ্কারের কাজ করছিলেন দোলন। আর লিজা ইশারা ভাষায় ক্রেতাদের তাঁদের খাবার খেয়ে দেখার আমন্ত্রণ জানাচ্ছিলেন। বেকারি ও পেস্ট্রি শপটিতে অন্যরা কেউ ময়দা মাখানো, চুলা জ্বালানোসহ অন্যান্য কাজে ব্যস্ত।

আউটলেটটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক সাজিদা রহমান ড্যানি। তিনি অটিস্টিকসহ বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু ও ব্যক্তিদের প্রশিক্ষণের জন্য গঠিত পিএফডিএ-ভকেশনাল ট্রেনিং সেন্টারের চেয়ারম্যান। অন্যদিকে অ্যাঞ্জেল শেফের উদ্যোগে এগিয়ে এসেছে সুপার স্টোর রিটেইল চেইন ‘স্বপ্ন’। গুলশানে স্বপ্ন আউটলেটের একপাশে এ অ্যাঞ্জেল শেফ যাত্রা শুরু করেছে তিন মাস আগে। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে এর উদ্বোধন হয়েছে গত ৩০ এপ্রিল। অভিনেতা আরেফিন শুভ অ্যাঞ্জেল শেফের উদ্বোধন করেন।

অ্যাঞ্জেল শেফে আছে উন্মুক্ত রান্নাঘর। ক্রেতাদের সামনেই খাবার প্রস্তুত ও রান্না হচ্ছে। ক্রেতারা চাইলে সেখানে না খেয়ে খাবারের প্যাকেট নিয়েও যেতে পারেন। খাবার বানানোর বিভিন্ন কাঁচামালসহ অন্যান্য জিনিস স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন পিএফডিএ-ভকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার থেকে পাঠানো হচ্ছে।
ট্রেনিং সেন্টার এবং অ্যাঞ্জেল শেফে খাবার বানানোসহ বিভিন্ন কাজে মোট ১১ জন কাজ করছেন। এ ছাড়া অ্যাঞ্জেল শেফে বর্তমান প্রধান বাবুর্চিসহ কয়েকজন কাজ করছেন, যাঁদের কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। তাঁরা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের বিভিন্নভাবে সহায়তা করছেন। ক্রেতার সঙ্গে আচরণ, হিসাব-নিকাশ বুঝিয়ে দিচ্ছেন ক্রেতার আড়ালে। বাংলাদেশে এই ধরনের উদ্যোগ এটিই প্রথম বলে জানালেন সাজিদা রহমান।

সাজিদা রহমান ড্যানি প্রথম আলোকে জানালেন, অ্যাঞ্জেল শেফে শ্রম আইন মানা হচ্ছে। ১৮ বছরের কম বয়সীদের এখানে কাজ দেওয়া হয় না। শ্রমঘণ্টাও মানা হয়। কাজের ভিত্তিতে ভকেশনাল ট্রেনিং সেন্টারের পক্ষ থেকে একেকজনকে ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত বেতন দেওয়া হচ্ছে। কেউ কেউ প্রশিক্ষণার্থী হিসেবেও কাজ শিখছেন। দুই শিফটে তাঁরা কাজ করছেন সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত। তবে সবকিছু গুছিয়ে, পরিষ্কার করে বের হতে হতে ১০টা বেজে যায়। বেশির ভাগ ব্যক্তির বেতন চলে যাচ্ছে তাঁদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে।

সাজিদা রহমানের মতে, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের সমাজের মূল স্রোতে আনতে হলে তাঁদের মানুষের সঙ্গে মেশার সুযোগ দিতে হবে। এই ব্যক্তিরা কোনো কাজ করতে পারে না, মানুষের এই ভুল ধারণাও পাল্টাতে হবে। এই ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্য বিশেষ করে মা-বাবা মনে সাহস পাচ্ছেন যে তাঁদের অনুপস্থিতিতে তাঁদের সন্তান হয়তো কিছু না কিছু করে জীবন চালাতে পারবেন। আর সব থেকে বড় কথা, এই ব্যক্তিদের যদি শেখানো হয় কোনো খাবারে ঘি লাগবে, তবে ওই খাবার বানাতে ঘি ছাড়া তাঁরা কোনো অবস্থাতেই তেল দেবেন না বা কোনো আপস করবেন না।

সাজিদা রহমান প্যারেন্টস ফোরাম ফর দ্য পারসনস উইথ অটিজম, সেরিব্রার পালসি, ডাউন সিনড্রমস, ইন্টেলেকচুয়াল অ্যান্ড নিউরোলজিক্যাল ডিজ্যাবিলিটিসের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর নিজের একমাত্র সন্তান অটিস্টিক। সাজিদা রহমান বিভিন্ন জায়গায় অ্যাঞ্জেল শেফের আদলে আউটলেট গড়ে তুলতে সরকার এবং ‘স্বপ্ন’র মতো অন্যান্য ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সহযোগিতা চাইলেন।
স্বপ্নর এরিয়া সেলস ম্যানেজার রোনাল্ড ডি রোজারিও প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই ব্যক্তিদের আমরা বলি স্পেশাল চাইল্ড বা গিফটেড চাইল্ড। এঁদের ডেডিকেশন খুব বেশি থাকে বলে আউটপুটও ভালো পাওয়া যায়। এখন পর্যন্ত কোনো ক্রেতার কাছ থেকে কোনো অভিযোগ আসেনি। আর এখানে যাঁরা কাজ করছেন তাঁদের প্রশিক্ষণ থাকায় তাঁদের কাজের মানও খুব ভালো। আমাদের স্বপ্নের বিভিন্ন আউটলেটে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিরা আগে থেকেই কাজ করছেন। আমরা অন্যান্য আউটলেটেও অ্যাঞ্জেল শেফের মতো কিছু করা যায় কি না চিন্তা ভাবনা করছি।’