চালকদের লোভ-খামখেয়ালিতে জিম্মি জীবন

সড়কে হতাহতের সংখ্যা কেবল বেড়েই চলেছে।কিন্তু কেউই বিচার পাচ্ছেন না।
সড়কে হতাহতের সংখ্যা কেবল বেড়েই চলেছে।কিন্তু কেউই বিচার পাচ্ছেন না।

গত দেড় মাসে সারা দেশে চালকদের বেপরোয়া আচরণের শিকার অন্তত নয়টি ঘটনা মানুষের মনে নাড়া দিয়ে গেছে। এগুলো দুর্ঘটনা না হত্যা অথবা হত্যাচেষ্টা, তা নিয়েও ক্ষোভ রয়েছে সাধারণ মানুষের মনে। সড়কে ঘটে যাওয়া এমন নয়টি ঘটনায় ভুক্তভোগীদের মধ্যে অন্তত তিনজন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে মারা গেছেন। আর ঘটনার পর হাসপাতালে নিলে একজনকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।

আর যাঁরা বেঁচে আছেন? তাঁরা হাসপাতালে শুয়ে কাতরাচ্ছেন। অজানা ভবিষ্যৎ চিন্তা করে আঁতকে উঠছেন। চিকিৎসা খরচ বহন করতে কিংবা পরিবারের প্রধান ব্যক্তিটির এ অবস্থায় বাকি সবাই শঙ্কিত বোধ করছে। নিরপরাধ এই মানুষগুলোর বেশির ভাগই কিছু কিছু গাড়িচালকের অতিরিক্ত আয়ের লোভ কিংবা খামখেয়ালিপনার শিকার।

সর্বশেষ গত রাতে মারা গেলেন কমিউনিটি পুলিশের সদস্য আলাউদ্দিন সুমন। ক্ষুব্ধ কণ্ঠে নিহত ব্যক্তির ভাই সালাউদ্দিন পলাশ বলেন, ‘এই যে হাত যায়, পা যায়; বিচারটা করবে কে?’

আলাউদ্দিন ১২ মে হানিফ ফ্লাইওভারে দায়িত্ব পালন করছিলেন। যাত্রাবাড়ী থেকে ছেড়ে আসা তারাবো পরিবহনের একটি বাস তাঁকে পেছন থেকে ধাক্কা দেয়। বাসের চাকা তাঁর বাঁ পায়ের ওপর দিয়ে চলে যায়।

একটি রেন্ট-এ-কার কোম্পানির গাড়িচালক রাসেল সরকার এখনো যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন অ্যাপোলো হাসপাতালে। হানিফ ফ্লাইওভারের যাত্রাবাড়ীতে গ্রিন লাইন পরিবহনের একটি বাস তাঁর গাড়িকে ধাক্কা দেয়। এ নিয়ে বাসের চালক ও রাসেলের মধ্যে কথা-কাটাকাটি হয়। এ সময় গ্রিন লাইন পরিবহনের চালক বাস চালানো শুরু করেন। তখন রাসেল সরতে গেলে ফ্লাইওভারের রেলিংয়ে আটকে পড়েন। তাঁর পায়ের ওপর দিয়েই বাস চলে যায়। এতে তাঁর বাঁ পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

রাসেলের স্ত্রী মিম আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘যার যায় কষ্টটা সে-ই বোঝে। বাংলাদেশে তো কোনো বিচার নাই। দিনের পর দিন বাসচালকেরা মানুষ মারছে। আজ পর্যন্ত একজনের যদি কঠিন কোনো বিচার হইত, বাকিরা ভয় পাইত।’

এই হানিফ ফ্লাইওভারেই শ্রাবণ সুপার ও মনজিল নামের দুটি বাসের রেষারেষির মধ্যে শ্রাবণ বাসের চাপায় নিহত হন ঢাকা ট্রিবিউনের বিজ্ঞাপন বিভাগের জ্যেষ্ঠ নির্বাহী নাজিম উদ্দিন (৪১)। পাঁচ দিন আগেই তিনি দ্বিতীয় কন্যার বাবা হয়েছিলেন। নাজিম উদ্দিনের চাচাতো ভাই মোসলেহউদ্দিন রিফাত এ ঘটনায় কঠোর শাস্তি দাবি করেন।

তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী রাজীব হোসেনের করুণ মৃত্যু সবাইকে নাড়া দিলেও মৃত্যু মিছিল থামেনি বরং বেড়েই চলেছে। গত ৩ এপ্রিল বিআরটিসির একটি দোতলা বাসের পেছনের ফটকে দাঁড়িয়ে গন্তব্যে যাচ্ছিলেন। স্বজন পরিবহনের একটি বাস বিআরটিসির বাসটিকে ওভারটেক করার জন্য বাঁ দিক গা ঘেঁষে পড়ে। দুই বাসের প্রবল চাপে রাজীবের হাত শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ১৬ এপ্রিল রাজীব মারা যান। এ ঘটনায় হাইকোর্ট রাজীবের পরিবারকে এক কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দেন। তবে এ আদেশ স্থগিত চেয়ে আবেদনের শুনানি হবে আগামী সোমবার।

রাজীবের মৃত্যুর এক দিন পরই খালিদ হাসান হৃদয়ও (২০) হাত হারান। কাজ শেষে হৃদয় টুঙ্গিপাড়া এক্সপ্রেসের বাসে করে গোপালগঞ্জ যাচ্ছিলেন। বাসের পেছনে জানালার পাশের একটি সিটে বসেছিলেন তিনি। ডান হাত দিয়ে জানালার মাঝখানের রড ধরে ছিলেন। গোপালগঞ্জের বেতগ্রাম বাসস্ট্যান্ড এলাকায় বাসের পেছন দিক থেকে আসা একটি ট্রাক ওভারটেক করতে যায়। কিন্তু হঠাৎ করে ট্রাকটি বাসের পেছন অংশ ঘেঁষে চলে যায়। এতে হৃদয়ের ডান হাতটি শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। হৃদয় এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাঁর বাবা রবিউল ইসলাম জানান, ট্রাকচালককে গ্রেপ্তারের পরদিনই প্রভাবশালীরা জামিনে বের করে নিয়ে যায়। তিনি বিচার পাওয়ার আশা করেন না।

২০ এপ্রিল রাতে বিআরটিসির দোতলা বাসের চাপায় ডান পা হারানো গৃহকর্মী রোজিনা আক্তার মারা যান ২৯ এপ্রিল। ওই মাসের ৫ তারিখ সকালে রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় বিকাশ পরিবহনের দুটি বাস পাল্লা দিয়ে চলছিল। আয়েশা খাতুন তাঁর ছয় বছর বয়সী মেয়েসহ ওই দুই বাসের মধ্যে চাপা পড়েন। রিকশাচালক ও আয়েশা খাতুনের মেয়ে অক্ষত থাকলেও আয়েশা খাতুনের মেরুদণ্ড ভেঙে যায়। তিনি সাভারের সিআরপিতে চিকিৎসাধীন। দায়িত্ব পালনকালে ট্রাফিক পুলিশ পরিদর্শক দেলোয়ার হোসেনের পা চাপা পড়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একটি বাসের নিচে। দুর্ঘটনার পর তিনি হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হন। তিনি এখনো চিকিৎসাধীন।

আট বছরের ছোট্ট সুমি বগুড়ার শেরপুর উপজেলার শেরুয়া বটতলা এলাকায় ঢাকা-রংপুর মহাসড়কে মায়ের হাত ধরে পার হওয়ার সময় ট্রাকের ধাক্কায় বাঁ হাতের কনুইয়ের ওপর পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সুমিকে এখন কৃত্রিম হাত দেওয়া হবে।

সড়কে দুর্ঘটনায় অঙ্গহানি বা মৃত্যুর তালিকা বড় হচ্ছে। প্রতিটি ঘটনাতেই বাস বা ট্রাক আটক হয়, চালকও গ্রেপ্তার হন। কেউ কেউ জামিনে বেরিয়ে আসেন। স্বজনদের অভিযোগ, সড়ক দুর্ঘটনায় কঠিন কোনো শাস্তি না হওয়ার কারণে চালকেরা মানুষ মেরেও সহজেই পার পেয়ে যাচ্ছেন। কেউ কেউ এখন বিচারের আশাও করেন না।