চট্টগ্রাম মাদকের আখড়া

চট্টগ্রামে মাদকের বিস্তার ঘটছে দ্রুত। সাম্প্রতিক সময়ে মাদক চোরাকারবারিদের ধরতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপর হলেও এদের সহায়তাকারী ও পৃষ্ঠপোষকেরা ধরাছোঁয়ার বাইরে। গত আট মাসে চট্টগ্রাম নগরের প্রধান মাদক আস্তানা ‘বরিশাল কলোনি’ এলাকায় র‍্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ তিন মাদক ব্যবসায়ী নিহত হন। তাঁদের মধ্যে দুজন নিহত হন গত বৃহস্পতিবার রাতেই।

চট্টগ্রাম নগর ও জেলায় মাদক ব্যবসায় যুক্ত ৯০ জনের একটি তালিকা করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আরেকটি তালিকা করা হয়েছে পৃষ্ঠপোষকদের। এই তালিকায় ৪৫ জনপ্রতিনিধি ও প্রভাবশালী এবং নগরের পাঁচ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ (ওসি) আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ২৫ জনের নাম আছে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের বিতর্কিত ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবদুল কাদের ওরফে মাছ কাদেরের নাম আছে এ তালিকায়।

র‍্যাব-৭ চট্টগ্রামের অধিনায়ক লে. কর্নেল মিফতাহ উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাদক বিক্রেতা, সেবনকারী ও পৃষ্ঠপোষকদের আজকের মধ্যে মাদক ব্যবসা ছাড়তে হবে। নইলে কাল তাদের জন্য বড় বিপদ অপেক্ষা করছে। তারা যত বড় প্রভাবশালীই হোক, আর কোনো ছাড় নয়।’

পুলিশ ও র‍্যাব কর্মকর্তারা জানান, চট্টগ্রাম নগরের প্রায় ৫০০ জায়গায় মাদক বেচাকেনা হয়। এর মধ্যে বরিশাল কলোনি, চট্টগ্রাম স্টেশন, কদমতলী বাস টার্মিনাল, মতিঝরনা, এনায়েতবাজার গোয়ালপাড়া, বায়েজিদ শের শাহ কলোনি, অক্সিজেন মোড়, ফিরোজ শাহ কলোনি, অলংকার মোড়, পাহাড়তলী, টাইগারপাস, বাটালি হিল মাদকের সবচেয়ে বড় বাজার।

মাদক চোরাকারবারিদের সহায়তাকারী হিসেবে তালিকায় নাম আছে চট্টগ্রাম নগরের পাঁচ ওসির। তাঁদের মধ্যে পাহাড়তলী থানার ওসি মো. আলমগীর ও আকবর শাহ থানার আলমগীর মাহমুদ সম্প্রতি বদলি হয়েছেন। অন্য তিন ওসি হলেন পাঁচলাইশ থানার মহিউদ্দিন মাহমুদ, পতেঙ্গা থানার আবুল কাসেম ভূঞা ও বন্দর থানার এস এম ময়নুল ইসলাম। এ ছাড়া থানা বা ফাঁড়ির ২০ জন এসআই, এএসআই ও কনস্টেবলের নাম আছে তালিকায়।

ওসি মহিউদ্দিন মাহমুদ বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, ‘আমি চ্যালেঞ্জ করছি, এই অভিযোগ ভিত্তিহীন ও মনগড়া।’ আবুল কাসেম ভূঞা বলেন, ‘আমরা মাদক ধরছি বলে কেউ আমাদের নাম বলতে পারে।’ এস এম ময়নুল ইসলাম বলেন, ‘বন্দর এলাকায় মাদকের ব্যবহার কম। তবু প্রতি মাসে ১৮-২০টি মামলা আমরা নিচ্ছি। বিদ্বেষপ্রসূত হয়ে কেউ আমাকে ফাঁসাতে পারে।’

পৃষ্ঠপোষকদের তালিকায় নগরের ২৮ নম্বর মোগলটুলি ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবদুল কাদের রয়েছেন। তিনি সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী। ‘মাছ কাদের’ নামে পরিচিত এই স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ২০১৫ সালে কাউন্সিলর হন। মুঠোফোনে কয়েক দফা যোগাযোগ করেও তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

৫০০ স্থানে মাদক কেনাবেচা

পুলিশ জানিয়েছে, নগরের ৫০০ স্থানে মাদক কেনাবেচার হাট।গতকাল দুপুরে নগরের মুরাদপুর, চট্টগ্রাম রেলস্টেশন, বরিশাল কলোনি গিয়ে কিছু যুবককে দেখা গেছে ইয়াবা কিনতে। তাঁদের মধ্যে আছেন গাড়িচালক ও ছাত্র। মুরাদপুরে একটি দোকানের সামনে এক গাড়িচালক মাদকের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। মুঠোফোনে কথা বলার পরই ওই চালকের কাছে এক যুবক এসে ছোট পোঁটলা ধরিয়ে চলে যান। জানতে চাইলে কেউ কিছু বলতে রাজি হননি। ওই চালকও দ্রুত সটকে পড়েন।

চট্টগ্রাম স্টেশনের পাশে গিয়ে দেখা যায়, গাঁজা ও ইয়াবা ক্রেতাদের আনাগোনা। সেখানে একজন ছাত্র ইয়াবা কিনতে যান। একজন মাদক ব্যবসায়ী জানান, রমজানের প্রথম দিন হওয়ায় শুক্রবার সকাল থেকে গ্রাহক কম। সন্ধ্যায় বাড়বে।

নিরাপদ রুট চট্টগ্রাম

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মতে, মিয়ানমার থেকে আসা ইয়াবা কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে চট্টগ্রাম হয়ে দেশে সরবরাহ হচ্ছে। প্রতিদিনই ইয়াবা পাচার হচ্ছে। আবার প্রতিদিনই ধরাও পড়ছে। কিন্তু পাচারের তুলনায় জব্দ হচ্ছে খুব কম। ৪ মে নগরের হালিশহরের একটি বাসায় অভিযান চালিয়ে ১৩ লাখ ইয়াবাসহ দুই ভাইকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ। গত বছরের ১৫ এপ্রিল পতেঙ্গাসংলগ্ন বঙ্গোপসাগরের মোহনায় ট্রলার থেকে ২০ লাখ ইয়াবা বড়ি জব্দ করেছিল র‍্যাব। একই দিন নগরের পাঁচলাইশ এলাকার একটি বাড়ি থেকে ইয়াবা পাচারের মূল হোতা মোজাহেরকে গ্রেপ্তার করা হয়। গত বছরের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ১৭ মে পর্যন্ত র‍্যাব অভিযান চালিয়ে ৮৩ লাখ ৪৪ হাজার ২২৫টি ইয়াবা উদ্ধার করে।

চট্টগ্রামের ভারপ্রাপ্ত পুলিশ কমিশনার মাসুদ-উল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, চট্টগ্রাম মাদক পরিবহনের প্রধান রুট। এর সঙ্গে কিছু গডফাদার যুক্ত। গডফাদার ও ব্যবসায়ীদের তালিকা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাজ শুরু করেছে। ৫ ওসিসহ ২৫ জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, তদন্ত সাপেক্ষে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইতিপূর্বে কয়েকজন পুলিশ সদস্য গ্রেপ্তার হয়েছেন। আইন নিজস্ব গতিতে চলবে।

কারাগারে ৭০ ভাগই মাদক মামলার আসামি

চট্টগ্রাম কারাগারে ৭ হাজার ১৫০ জন পুরুষ ও ৩৩২ জন নারী বন্দীর মধ্যে ৭০ ভাগ মাদক মামলার আসামি। চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জ্যেষ্ঠ তত্ত্বাবধায়ক ইকবাল কবীর চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, বন্দীদের বেশির ভাগই মাদক মামলার আসামি। প্রতিদিন আসছেন আর জামিনে মুক্তিও পাচ্ছেন। মাদকাসক্ত বন্দীদের নিয়ে বেকায়দায় থাকতে হয়। মাদকের জন্য তাঁরা ছটফট করেন। কারা হাসপাতালে রেখে তাঁদের চিকিৎসা দেওয়া হয়।

২০১৩ সালে নগরের ১৬ থানায় মাদকের মামলা হয়েছিল ১ হাজার ৭০৬টি। তিন বছর পর তিন গুণ বেড়ে ২০১৭ সালে হয় ৪ হাজার ১৯১টি মামলা। এসব মামলার বাদী র‍্যাব, পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।

জামিনে বেরিয়ে উধাও

জামিনে কারাগার থেকে বেরিয়ে প্রথম দু-তিন মাস আদালতে হাজিরা দেন মাদক মামলার আসামিরা। কিন্তু রায় ঘোষণার সময় এগিয়ে এলেই উধাও হয়ে যান তাঁরা। রায়ে আদালত সাজা দিলেও পুলিশ আর তাঁদের খুঁজে পায় না। গত বছরের ১ মে থেকে ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় সাত মাসে চট্টগ্রামের ১৩টি আদালতে ৩১২টি মাদকের মামলার রায় ঘোষণা হয়। এসব মামলায় কারাদণ্ড হয় ৬৪৯ জনের। এর মধ্যে ৩৮২ জনই রায় ঘোষণার আগে জামিন নিয়ে পলাতক। তবে মাদক মামলার কত আসামি বর্তমানে জামিনে রয়েছেন, সে পরিসংখ্যান নেই পুলিশের কাছে।

ইয়াবা আনতে অভিনব কৌশল

ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকতে ইয়াবা পাচারকারীরা অভিনব কৌশলে কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে চট্টগ্রামে ইয়াবা নিয়ে আসছেন। পেটের ভেতর, পেঁয়াজ ও কুমড়ায়, মোটরসাইকেল ও গাড়ির জ্বালানির ট্যাংক, কাভার্ড ভ্যানের ভেতরে বিশেষ বাক্সে করে আসছে ইয়াবা। সর্বশেষ গত ১৫ এপ্রিল নগরের কোতোয়ালি থানার ব্রিজঘাট এলাকা থেকে রশিদ আহমেদ ও ফরিদ আহমেদ নামের দুজনকে গ্রেপ্তার করেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে পেটের ভেতর ইয়াবা নিয়ে চট্টগ্রামে আসেন তাঁরা। তাঁদের পেট থেকে ৫ হাজার ৮০০টি ইয়াবা বের করা হয়।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মেট্রো অঞ্চলের উপপরিচালক শামীম আহমেদ বলেন, নতুন নতুন কৌশলে নগরে মাদক ঢুকছে। অভিযান চালিয়ে মাদকসহ গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ইন্দ্রজিৎ কুণ্ডু মাদকের বিস্তার সম্পর্কে প্রথম আলোকে বলেন, মাদকের সঙ্গে আন্তর্জাতিক ও দেশীয় রাজনীতি ও অর্থনীতির গভীর সম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশে উন্নয়ন হলেও কর্মসংস্থান কম। এ কারণে বেকার যুবকেরা হতাশা ও বিচ্ছিন্নতা থেকে মাদকের প্রতি ঝুঁকছেন। ফলে বাংলাদেশ এখন মাদকের রমরমা বাজার। তাই কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে মাদকের লাগাম টেনে ধরতে হবে।