এসএসসি, এইচএসসি ও প্রাথমিক পরীক্ষায় নানা পরিবর্তন

প্রথম আলো ফাইল ছবি
প্রথম আলো ফাইল ছবি
>
  • পরীক্ষা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা
  • শিক্ষাবর্ষ শুরুর কয়েক মাসের মধ্যে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে প্রশ্নের কাঠামো ও নম্বর ওলট-পালট।

বহুনির্বাচনী প্রশ্ন (এমসিকিউ) রেখে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের কাঠামো ও নম্বর ঠিক করেছিল জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি। এর দেড় মাস পর ২ এপ্রিল এমসিকিউ বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। আরও ১০ দিন পর নতুন নিয়মে প্রশ্নপত্রের কাঠামোর আদেশ জারি হয়। অর্থাৎ শিক্ষাবর্ষ শুরুর প্রায় সাড়ে তিন মাস চলে যাওয়ার পর শিক্ষার্থীরা জানল পরীক্ষায় এমসিকিউ থাকবে না।

কেবল প্রাথমিক নয়, শিক্ষাবর্ষ শুরু হওয়ার পর মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকেও নানা ধরনের পরিবর্তন আনা হচ্ছে। অথচ এসএসসি পরীক্ষা-সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত দুই বছর আগে, অর্থাৎ শিক্ষার্থীরা যখন নবম শ্রেণিতে ওঠে, তখনই জানানোর কথা। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী বা অন্যান্য পরীক্ষা-সংক্রান্ত সিদ্ধান্তগুলোও অন্তত এক থেকে দেড় বছর আগে জানানো উচিত বলে মনে করেন শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা।

প্রাথমিকের পরিবর্তন নিয়ে আলোচনার মধ্যেই জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) ও জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি) পরীক্ষা থেকে নম্বর ও বিষয় কমানোর প্রস্তাব করেছেন শিক্ষা বোর্ডগুলোর চেয়ারম্যানরা। এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে আজ রোববার সভা ডেকেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। অথচ বছরের প্রায় পাঁচ মাস পার হতে চলেছে।

এর পাশাপাশি প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধসহ কয়েকটি কারণে আগামী মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি), উচ্চমাধ্যমিক সার্টিফিকেটসহ (এইচএসসি) বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষা থেকেও এমসিকিউ বাদ দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

শিক্ষাবর্ষ শুরুর পর প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে এভাবে একের পর এক ওলট-পালট ও নতুন নতুন পরিকল্পনায় চাপে পড়ছে শিক্ষার্থীরা। এই তিন স্তরে শিক্ষার্থী আছে প্রায় ৪ কোটি ২০ লাখ।

শিক্ষা বিশেষজ্ঞ, শিক্ষক ও অভিভাবকেরা বলছেন, যুগের সঙ্গে মিল রেখে পরীক্ষা ও শিক্ষাপদ্ধতি নিয়ে ইতিবাচক পরিবর্তন হতেই পারে। কিন্তু এসব সিদ্ধান্ত নির্বাহী আদেশে হওয়ার ফলে নানা ধরনের জটিলতা ও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হচ্ছে।

জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী প্রথম আলোকে বলেন, যুগোপযোগী করার জন্য শিক্ষাব্যবস্থা ও পরীক্ষাপদ্ধতি মাঝেমধ্যে পর্যালোচনা করতে হয় এবং করা উচিত। কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে হবে পরিকল্পিতভাবে এবং তা বাস্তবায়নের জন্য সময় দেওয়া উচিত। কারণ শুধু শিক্ষার্থী, শিক্ষক বা অভিভাবকই নয়, শিক্ষা প্রশাসনেরও প্রস্তুতি নিতে হয়।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত এক দশকে শিক্ষাব্যবস্থায় বেশ কিছু নতুন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কখনো পরীক্ষা, কখনো বিষয়ের সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। আবার প্রশ্নপত্রের কাঠামোতেও পরিবর্তন আনা হয়েছে।

রাজধানীর উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ুয়া এক শিক্ষার্থীর মা প্রথম আলোকে বলেন, জানুয়ারিতে শিক্ষাবর্ষ শুরুর পর এপ্রিলে এসে এমসিকিউ বাদ দেওয়ার আকস্মিক সিদ্ধান্তে তাঁর সন্তানের ওপর চাপ পড়েছে।

এদিকে কয়েক বছর ধরে একের পর এক প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় আগামী জেএসসি, জেডিসি, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা থেকে এমসিকিউ প্রশ্নপত্র তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা করে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, এমসিকিউ পদ্ধতি ভালো হলেও তা সুষ্ঠুভাবে প্রয়োগ করা যাচ্ছে না। পরীক্ষার আগমুহূর্তে এমসিকিউ যেমন ফাঁস হয়ে যাচ্ছে, তেমনি পরীক্ষার সময় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রে কেন্দ্রে সমঝোতা করে উত্তর দেওয়ার ক্ষেত্রে দুর্নীতি করছে। সব দিক বিবেচনা করেই এই পদ্ধতি বাদ দিয়ে পুরোটাই সৃজনশীল প্রশ্ন বা কিছু সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব সোহরাব হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, তিনি ব্যক্তিগতভাবে চান এমসিকিউ একেবারে বাদ দেওয়া হোক। তবে আলাপ-আলোচনা করে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ৩ মে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত পাবলিক পরীক্ষা-সংক্রান্ত এক সভায় শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগের প্রতিমন্ত্রী কাজী কেরামত আলী, সচিব মো. সোহরাব হোসাইন এমসিকিউ বাতিল করার পক্ষে কথা বলেন। তবে সভায় উপস্থিত পুলিশ সদর দপ্তরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নির্বাচনের বছরে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আরেকটু ভাবার পরামর্শ দেন। এরপর এমসিকিউ বাদের ঘোষণা দেয়নি মন্ত্রণালয়। এ অবস্থায় এমসিকিউ বাদ দেওয়া হবে কি না, তা নিয়ে শিক্ষার্থীরা অনিশ্চয়তায় আছে। এ নিয়ে আলোচনার মধ্যেই শিক্ষা বোর্ডগুলোর চেয়ারম্যানদের সংগঠন আন্তশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় সাব-কমিটি ৮ মে আগামী জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষা থেকে সাতটি বিষয়ে মোট ৬৫০ নম্বরের পরীক্ষা নেওয়ার প্রস্তাব করেছে। বর্তমানে চতুর্থ বিষয়সহ ১০টি বিষয়ে মোট ৮৫০ নম্বরের পরীক্ষা হয়।

এক দশক ধরেই শিক্ষা নিয়ে ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। মুখস্থবিদ্যার বদলে শিক্ষার্থীরা বুঝে পড়বে ও শিখবে, এমন উদ্দেশ্য নিয়ে ২০০৮ সালে শিক্ষাব্যবস্থায় সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করা হয়। প্রথমে মাধ্যমিকে হলেও এখন প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে এই পদ্ধতিতে প্রশ্নপত্র করা হয়। সৃজনশীল পদ্ধতিতে একটি বিষয়কে চারটি ভাগে প্রশ্ন করা হয়। কিন্তু সরকারি ও বেসরকারি একাধিক গবেষণা ও জরিপের তথ্য বলছে, এখনো প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের প্রায় অর্ধেক শিক্ষক সৃজনশীল পদ্ধতি সম্পর্কে ভালো করে বোঝেন না এবং এই পদ্ধতিতে প্রশ্নও করতে পারেন না। ফলে শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে যথাযথ শিক্ষা না পেয়ে নোট-গাইড বা অনুশীলন বই এবং কোচিং-প্রাইভেটের ওপর নির্ভরশীল হচ্ছে।

২০১০ সালে করা জাতীয় শিক্ষানীতিতে পঞ্চম শ্রেণি শেষে উপজেলা বা পৌরসভা বা থানা পর্যায়ে সবার জন্য অভিন্ন প্রশ্নপত্রে সমাপনী পরীক্ষা নেওয়ার কথা। কিন্তু সরকার এর এক বছর আগে ২০০৯ সালে হঠাৎ করেই জাতীয়ভাবে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা নেওয়া শুরু করে। শিক্ষানীতি অনুযায়ী প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ঘোষণা করার পরও তা বাস্তবায়ন না করে পঞ্চম শ্রেণি শেষে পাবলিক পরীক্ষা নেওয়ায় শিশুদের ওপর বিরাট চাপ পড়ছে বলে অভিভাবকদের অভিযোগ। সরকার নতুন কোনো সিদ্ধান্ত না নেওয়া পর্যন্ত এই পরীক্ষা চলতে থাকবে বলে জানিয়ে দিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।

শিক্ষায় ঘন ঘন এসব পরিবর্তনকে ‘তুঘলকি সিদ্ধান্ত’ বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, কোনো রকম গবেষণা ও শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ ছাড়াই প্রশাসনিক এসব সিদ্ধান্ত নিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর অবিচার করা হচ্ছে। তাঁর মতে, হঠাৎ হঠাৎ পরিবর্তন ঠিক নয়। গবেষণা করে ও বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত এক থেকে দুই বছর আগে জানানো উচিত।