জেব্রা পাচারের চক্রে বাংলাদেশ ছাড়াও আছে ভারত, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড

যশোরের শার্শায় ৮ মে উদ্ধার করা জেব্রা।  ছবি: প্রথম আলো
যশোরের শার্শায় ৮ মে উদ্ধার করা জেব্রা। ছবি: প্রথম আলো
>
  • ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে জেব্রা আনা হয় কাতার থেকে। 
  • ৫০ জনের সক্রিয় এই চক্র বাঘ ও সিংহের বাচ্চাও এনেছিল।

যশোরে উদ্ধার জেব্রাগুলোর ঠিকুজি নিতে গিয়ে পাওয়া গেল বন্য প্রাণী চোরাচালানে জড়িত একটি আন্তর্জাতিক চক্রের খোঁজ। সংঘবদ্ধ এই চক্রে বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়ার নাগরিকসহ ৫০ জনের মতো সদস্য আছে। বাংলাদেশকে তারা বন্য প্রাণী চোরাচালানের সুবিধাজনক পথ হিসেবে ব্যবহার করছে।

তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন, এই আন্তর্জাতিক চক্রের সঙ্গে পুলিশ, কাস্টমস ও বন বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত। এঁদের হাত ধরে জেব্রা ও ঘোড়ার মতো মারাত্মক রোগ বহনকারী প্রাণী বিনা বাধায় দেশে ঢুকছে। এর আগে এই চক্রের একাধিক চালান ধরা পড়লেও মামলা থেকে মূল হোতাদের বাদ দিয়েছে পুলিশ।

তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চোরাই বন্য প্রাণীর সবচেয়ে বড় বাজার ভারত। সে দেশে রয়েছে অনেক সার্কাস দল, যারা বন্য প্রাণীর বড় ক্রেতা। বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠা চিড়িয়াখানায়ও যাচ্ছে বন্য প্রাণী। আবার সেখানকার অনেক ধনী লোক শখ করে এসব প্রাণী পোষেন।

পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত ডিআইজি (গোয়েন্দা) মো. মনিরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, বন্য প্রাণী চোরাচালানে জড়িত আন্তর্জাতিক চক্রের ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য পুলিশের আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারপোলকে দেওয়া হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর গত বছরের নভেম্বরে কংগ্রেসে দেওয়া এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে বন্য প্রাণী বা বন্য প্রাণিজাত পণ্যের উৎস ও সুবিধাজনক পথ হিসেবে উল্লেখ করেছে।

জেব্রা এল যেভাবে

যশোরের শার্শা উপজেলার সাতমাইল পশুহাটে ভারত থেকে আসা গরু রাখার খোঁয়াড় (খাটাল) থেকে ৮ মে রাতে নয়টি জেব্রা উদ্ধার করে ডিবি পুলিশের একটি দল। পরে আদালতের নির্দেশে প্রাণীগুলো গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে ছেড়ে দেওয়া হয়।

বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ অধিদপ্তর খু
লনার বিশেষজ্ঞ মফিজুর রহমান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ছোট-বড় নয়টি জেব্রার মধ্যে আটটি জীবিত ও একটি মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। উদ্ধার করা জেব্রাগুলো আফ্রিকার একটি প্রজাতি।

সাতমাইল বাজারের ব্যবসায়ী মনিরুল ইসলাম বলেন, ওই দিন সন্ধ্যায় ঝড়বৃষ্টির সময় দুটি বড় পিকআপে করে জেব্রাগুলো এসে পৌঁছায়। রাখা হয় স্থানীয় বাসিন্দা তুতু মিয়া গরুর খাটালে। পরে ডিবি পুলিশ এসে এগুলো জব্দ করে।

সাতমাইল পশুর হাটে ভারতীয় গরু বেচাবিক্রি হয়। একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট হাটটি নিয়ন্ত্রণ করে। বাগআঁচড়া ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ইদ্রিস আলী ওই সিন্ডিকেটের সহযোগী।

জেব্রা উদ্ধারের ঘটনায় পুলিশ চারজনকে আসামি করে বন্য প্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা করে। মামলায় তুতু মিয়া, নরসিংদীর পলাশ উপজেলার বকুলনগর গ্রামের রানা ভূঁইয়া, বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার বশিকোড়া চকপাড়া গ্রামের কামরুজ্জামান বাবু ও যশোরের শার্শা উপজেলার পুটখালী গ্রামের মো. মুক্তিকে আসামি করা হয়। এজাহারে সহযোগী হিসেবে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা ইদ্রিস আলী ও ঢাকার উত্তরার রানাভোলার জাকির হোসেনের ছেলে ইয়াসিনের নাম উল্লেখ করা হয়।

গত বছরের ১৩ নভেম্বর যশোর শহরের চাঁচড়া চেকপোস্ট মোড় থেকে চিতাবাঘ, সিংহের চারটি শাবক আটকের মামলায়ও নাম আছে রানা ভূঁইয়া, কামরুজ্জামান, মুক্তি ও ইয়াসিনের।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, জেব্রাবহনকারী খাঁচায় লেখা ছিল, ‘টার্কিশ এয়ারলাইনস। ওজন ২ হাজার ৪০০ কেজি। তাপমাত্রা ১৮ থেকে ২৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস’। এই সূত্র ধরে যোগাযোগ করা হলে ঢাকায় টার্কিশ এয়ারলাইনসের সহকারী ব্যবস্থাপক নাফিজ ইমরান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের মালবাহী উড়োজাহাজে করে প্রতি মাসেই জীবিত প্রাণীর চালান আসে। তিনি বলেন, তাঁদের কাজ এগুলো পণ্য পরিবহনের কাজে নিযুক্ত প্রতিষ্ঠানকে বুঝিয়ে দেওয়া। ঢাকায় তাঁদের পণ্য পরিবহন করে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস।

বিমানের পণ্য পরিবহন বিভাগে যোগাযোগ করা হলে তারা জানায়, কাতার থেকে টার্কিশ এয়ারে উড়োজাহাজ টিকে-৬৪৭২-তে করে ১০টি জেব্রার একটি চালান ঢাকায় এসেছে। আমদানিকারক শুল্ক দিয়ে এগুলো ছাড় করে নিয়ে গেছেন।

ঢাকা কাস্টম হাউসের কমিশনার প্রকাশ দেওয়ান এর সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, বৈধ কাগজপত্র দিয়েই এগুলো এসেছে।

কাস্টমস সূত্র জানায়, ৭ মে ১০টি জেব্রার চালান ঢাকায় আসে, ওই দিনই এগুলো ছাড় করানো হয়। এর আমদানিকারক ছিল কক্সবাজারের ‘বে মাদার শ্রিম্প’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। আমদানির কাগজপত্রে ১০টি জেব্রার দাম উল্লেখ করা হয়েছে ৪ হাজার ডলার। আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান এ জন্য ৩ লাখ ৭৬ হাজার টাকার শুল্ক পরিশোধ করে। এর সিঅ্যান্ডএফ (ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরোয়ার্ডিং) ছিল মতিন অ্যান্ড কোম্পানি।

আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানটির মালিক কক্সবাজারের শাহেদ আলী। জানতে চাইলে তিনি বলেন, তিনি আগে মাছের ব্যবসা করতেন, এখন মাছের খাবারের ব্যবসা করেন। জেব্রা কে আনল আর কেন আনল, তার কিছুই তিনি জানেন না।

সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠান মতিন অ্যান্ড কোম্পানির মালিক আবদুল মতিন মারা যাওয়ার পর তাঁর স্ত্রীর নামে লাইসেন্সটি হস্তান্তরিত হয়। এটি এখন ভাড়ায় চালান অন্য এক ব্যক্তি।

তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন শুল্ক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে এসব জেব্রা আমদানি করা হয়েছে। তাঁর ধারণা, ওই চালানের ১০টি জেব্রার মধ্যে হয়তো একটি আগে মারা যায়। আর সীমান্তে পাঠানোর পর নয়টির মধ্যে আরও একটি মারা যায়।

বন্য প্রাণী এনে পাচার করার ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা কোনো বন্য প্রাণী আমদানির অনুমতি বা অনাপত্তিপত্র দেন না। এটা বন বিভাগের দায়িত্ব।

জানতে চাইলে বন সংরক্ষক (বন্য প্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চল) মো. জাহিদুল করিম প্রথম আলোকে বলেন, এখন পর্যন্ত সরকারি চিড়িয়াখানা ছাড়া কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে বন্য প্রাণী আনার অনুমতি দেওয়া হয়নি। তিনি বলেন, সম্প্রতি যে জেব্রার চালান ধরা পড়েছে, তার সব কাগজপত্রই জাল। একটি আন্তর্জাতিক চক্র এসব আমদানি করেছে। এ ঘটনা তদন্তে তাঁরা কমিটি গঠন করবেন বলে জানান।

সব একই চক্রের কাজ

পুলিশ সূত্র জানায়, গত বছরের ২০ সেপ্টেম্বর রাজধানীর উত্তরার একটি বাড়ি থেকে ছয় শতাধিক বিরল প্রজাতির কচ্ছপ, একটি কুমিরের বাচ্চাসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, ঢাকায় এই চক্রের অন্যতম প্রধান আজিজ ইসলাম। তাঁর নিশান পেট্রল গাড়িতে করেই বন্য প্রাণী সীমান্তে নেওয়া হতো। আজিজকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ ২৫ জন ভারতীয়, ১১ জন মালয়েশিয়ান ও একজন পাকিস্তানির নাম-ঠিকানা পায়। এসব তথ্য ইন্টারপোলকে দেওয়া হয়।

এরপর গত বছরের ১৩ নভেম্বর যশোর শহরের চাঁচড়া চেকপোস্ট মোড় থেকে চিতাবাঘ, সিংহের দুটি করে চারটি শাবকসহ রানা ভূঁইয়া ও কামরুজ্জামান নামের দুজনকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। শাবক বহনকারী একটি প্রাডো গাড়িও আটক করা হয়।

উত্তরায় ৬ নম্বর সেক্টরের একটি খালি প্লটে টিনশেড বাড়িতে থাকে রানা ভূঁইয়ার পরিবার। তারা জানায়, রানা বিয়ের অনুষ্ঠানের ছবি তোলার কাজ করেন। মাঝেমধ্যে ভাড়ার গাড়িও চালান। গ্রেপ্তার হওয়ার পর প্রাডো গাড়ির মালিক তাঁকে জামিন করিয়ে আনেন।

ফোনে যোগাযোগ করা হলে রানা বলেন, বাঘ ও সিংহের বাচ্চা যে গাড়িতে নেওয়া হয়েছিল তা চালাচ্ছিলেন কামরুজ্জামান। তিনি উত্তরা থেকে কামরুজ্জামানের গাড়িতে ওঠেন। সেই গাড়িতে দুটি খাঁচা ছিল। কে গাড়িতে সেই খাঁচা তুলেছিল, তা তিনি জানেন না।

কামরুজ্জামান বলেন, উত্তরা জসীমউদ্‌দীন সড়ক থেকে এক ব্যক্তি কয়েকটি খাঁচা নিয়ে তাঁর গাড়ি ৩০ হাজার টাকায় ভাড়া নেন যশোরে যাওয়ার জন্য। পথে যশোরের চাতরা ফাঁড়ির সামনে থেকে পুলিশ তাঁদের আটক করে।

বাঘ ও সিংহের বাচ্চা বহনকারী যে প্রাডো গাড়িটি আটক করা হয়েছিল, তার মালিক স্টার গোল্ড ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী খাজা মইনুদ্দিন। এয়ারপোর্ট সড়কের হাজি টাওয়ারের পঞ্চম তলায় তাঁর কার্যালয়। তিনি রিক্রুটিং এজেন্ট। তাঁর কার্যালয়ে গেলে ব্যবস্থাপক আসাদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর মালিকের গাড়িচালক কামরুজ্জামান মেরামত করার নাম করে গাড়ি যশোরে নিয়ে যান। পুলিশ আটক করলে তাঁরা আদালতের মাধ্যমে গাড়িটি নিয়ে আসেন।

এই মামলার তদন্ত শেষে পুলিশ পাঁচজনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেয়। কিন্তু অভিযোগপত্র থেকে প্রাডো গাড়ির মালিককে বাদ দেওয়া হয়। এমনকি চিতাবাঘ ও সিংহের বাচ্চা কীভাবে সীমান্তে গেল, তা-ও তদন্তে আড়াল করা হয়। ওই মামলায় যাঁদের আসামি করা হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে এই জেব্রা পাচার মামলার চার আসামিও আছেন। তাঁরা হলেন রানা, কামরুজ্জামান, মুক্তি ও ইয়াসিন। অপরজন হলেন ঢাকার মিরপুর ১২ নম্বর এলাকার সৈয়দ আলী শাহবাজ।

এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আবদুল কাইয়ুম মুনশি প্রথম আলোকে বলেন, অল্প সময়ে মামলাটি তদন্ত করায় বাঘ-সিংহের বাচ্চা কোথা থেকে জিপে তোলা হয়েছিল, তা বের করতে পারেননি। গাড়ির মালিককে কেন আসামি হবে না, জানতে চাইলে তিনি কোনো জবাব দেননি।

জেব্রা পাচার মামলার বাদী জেলা ডিবি পুলিশের উপপরিদর্শক মুরাদ হোসেন বলেন, বাঘ ও সিংহের বাচ্চা পাচারের সঙ্গে যে চক্র জড়িত, সেই একই চক্র জেব্রা পাচারের সঙ্গে জড়িত। যশোরের মুক্তি হলেন এই দলের স্থানীয় নেতা।

মুক্তি একসময় বায়তুল মোকাররমে টুপি-জায়নামাজের ব্যবসা করতেন। পাচারকারীদের সঙ্গে পরিচয়ের সুবাদে ঢাকা-যশোর নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন। তাঁর বাবা আবুল সরদার পুটখালী ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। সীমান্তে এই প্রভাব কাজে লাগান তিনি। মুক্তির সঙ্গে উত্তরার বাসিন্দা জসিম উদ্দিনের যোগাযোগ রয়েছে। বিমানবন্দর থেকে মাল ছাড়ানোর কাজ করেন জসিম।

জানতে চাইলে দুবাই সাফারি পার্কের বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞ রেজা খান প্রথম আলোকে বলেন, ঘোড়া ও জেব্রার মতো প্রাণীগুলো মারাত্মক রোগ বহন করে। এসব প্রাণী আমদানির সুযোগ বন্ধ করা উচিত। না হলে আমদানি হওয়া প্রাণী পাচার হতেই থাকবে। এই সুযোগে আন্তর্জাতিক চক্র দেশে ঘাঁটি গেড়ে বসবে।

 (প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন মনিরুল ইসলাম, যশোর, খায়রুল ইসলাম, আদমদীঘি (বগুড়া) এবং ড্রিঞ্জা চাম্বু গং, ঢাকা)