বগুড়া-২ আসনে ভোটের আগে জোটের দ্বন্দ্ব

একাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বগুড়া-২ (শিবগঞ্জ) আসনে বিএনপি-জামায়াতের ‘গৃহযুদ্ধ’ তীব্র হয়েছে। এবার বিএনপিকে কার্যত চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে জামায়াত। আর স্বার্থের দ্বন্দ্বে ‘সাপে-নেউলে’ সম্পর্কের সৃষ্টি হয়েছে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির (জাপা) মধ্যে। গত দুই নির্বাচনে ছাড় দিলেও এবার জাপাকে ছাড় দিতে নারাজ আওয়ামী লীগ। ফলে ভোটের লড়াইয়ের আগেই নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছে দুই জোট।

নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক ও ডাকসুর সাবেক ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না একসময় এখানে আওয়ামী লীগের তারকা প্রার্থী ছিলেন। তিনি এবারও আলোচনায়।

১৯৭৩ সালের প্রথম সংসদ নির্বাচনের পর আর কখনো এখানে ‘নৌকা’ জেতেনি। গত নির্বাচনে জাপার শরিফুল ইসলাম মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সাংসদ হন। ২০০৮ সালে বিএনপির এ কে এম হাফিজুর রহমানের কাছে ৪৫ হাজার ৮৭১ ভোটে হেরেছিলেন তিনি। ২০০১ সালে জয় পান বিএনপির রেজাউল বারী। আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে মাহমুদুর রহমান ৪৭ হাজার ৮১৯ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় হন। এ আসনে বর্তমানে ভোটার ২ লাখ ৯৬ হাজার ৪০৯।

আসন্ন নির্বাচনে ২০-দলীয় জোটের মনোনয়ন পেতে বিএনপির হাফিজুর রহমান, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মীর শাহে আলমের নাম আলোচিত হচ্ছে। এর বাইরে জোটের প্রার্থী হিসেবে আছেন জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সাংসদ মাওলানা শাহাদাতুজ্জামান।

২০০৮ ও ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পেয়েছিলেন আকরাম হোসেন। কিন্তু দুবারই জাপা প্রার্থীর সমর্থনে মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নেন। এবারও তাঁরা দুজনই মনোনয়ন চাইবেন। এর বাইরে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফিজার রহমান প্রার্থী হওয়ার আশা নিয়ে গণসংযোগ করছেন।

প্রকাশ্য দ্বন্দ্বে বিএনপি-জামায়াত

বিএনপি ‘ছাড় দিলে ভালো, না-দিলেও ক্ষতি নেই’ এমন মনোভাব নিয়ে মাঠে নেমেছে জামায়াত। বিভিন্নভাবে প্রচারণা আর কর্মিসভা করে দলটি ব্যস্ত সময় পার করছে। এই তৎপরতাকে পাত্তা দিতে নারাজ বিএনপির নেতা-কর্মীরা। জামায়াতকে ‘কাগুজে বাঘ’ হিসেবেই দেখছেন তাঁরা।

জামায়াতে ইসলামী বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের শরিক হলেও এখানে তাদের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। ২০১৪ সালের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল জামায়াত-বিএনপির মধ্যে। বিএনপির প্রার্থী মতিয়ার রহমানকে হারিয়ে চেয়ারম্যান হন জামায়াতের আবু নছর মোহাম্মদ আলমগীর হুসাইন। এরপর মাঠের আন্দোলনে জামায়াতকে আর পাশে পাচ্ছে না বিএনপি। এর আগে ’৯১-এর সংসদ নির্বাচনে জামায়াতের প্রার্থী শাহাদাতুজ্জামান বিএনপির প্রার্থীকে পরাজিত করে নির্বাচিত হন। তবে ’৯৬-তে জামায়াতকে হারিয়ে জয় পান বিএনপির হাফিজুর রহমান। এবারও তিনি প্রার্থী হবেন বলে প্রথম আলোকে জানিয়েছেন।

এবার আর বিএনপির মুখাপেক্ষী না থেকে শাহাদাতুজ্জামানকেই প্রার্থী ঘোষণা দিয়ে নির্বাচনী মাঠে জামায়াত। উচ্চ আদালতের রায়ে নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা হলেও প্রয়োজনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে থাকতে চান তিনি। উপজেলা জামায়াতের সহকারী আইনবিষয়ক সম্পাদক ফারুক হুসাইন বলেন, ‘দুঃসময়ে বিএনপিকে পাশে পাইনি। উল্টো তারা নানাভাবে আমাদের ক্ষতি করেছে। তাই এবার স্বতন্ত্র হলেও ভোট করতে আমরা প্রস্তুত।’

উপজেলা জামায়াতের সভাপতি শামছুর রহমান বলেন, এখানে বিএনপি কোন্দলে জর্জরিত। তাদের সংগঠন ভেঙে পড়েছে। তাই বিএনপিকে প্রার্থী করে লাভ হবে না। শাহাদাতুজ্জামান বলেন, ‘নির্বাচন করার জন্য সার্বিক প্রস্তুতি নিয়েছি। আমরা দেখিয়ে দেব, এ আসন বিএনপির নয়, জামায়াতের দুর্গ।’

তবে পৌর বিএনপির সভাপতি বুলবুল ইসলাম বলেন, দীর্ঘদিন বিএনপি এখানে জামায়াতকে আগলে রেখেছিল। এখন তাদের খেই হারিয়ে ফেলার অবস্থা।

আ.লীগ-জাপার দ্বন্দ্ব

আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির মধ্যে দূরত্ব বাড়তে শুরু করে ২০০৮ সালের নির্বাচন থেকে। তখন মহাজোটের প্রার্থী ছিলেন শরিফুল ইসলাম। কিন্তু স্থানীয় আওয়ামী লীগের কিছু নেতা বিএনপির সঙ্গে হাত মেলানোর কারণে তিনি হেরে যান বলে অভিযোগ আছে। সর্বশেষ ‘একতরফা’ নির্বাচনে মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে বিনা ভোটে জেতেন শরিফুল। এরপর গত চার বছরে একটু একটু করে দূরত্ব বেড়েছে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির।

২০০৮ ও ২০১৪ সালে দলের মনোনয়ন পাওয়া আকরাম হোসেন বলেন, পরপর দুবার মনোনয়ন পেয়েও তিনি জোটের রাজনীতির স্বার্থে জাপাকে প্রার্থিতা ছেড়ে দেন। এবারও জোটগত নির্বাচন হলে তখন কী হবে, তা দলীয় নেতৃত্ব ঠিক করবেন।

সাংসদ শরিফুল ইসলাম বলেন, অনৈতিক কাজে প্রশ্রয় না দেওয়ায় উপজেলা আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা তাঁর বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারেন। কারণ, তাঁদের ব্যক্তিগত দাবি তিনি পূরণ করেননি।

আলোচনায় মান্না

নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না ’৯১ থেকে তিনবার এ আসনে নির্বাচন করেছেন। প্রথমবার জনতা মুক্তি পার্টির হয়ে, পরের দুবার ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী। জিততে পারেননি একবারও। আসন্ন নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে তাঁর সমর্থকেরা জানিয়েছেন। মাহমুদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘নির্বাচনে যাব কি না, তা এ মুহূর্তে বলা কঠিন। তবে নির্বাচন করলে শিবগঞ্জ থেকেই করব। আর বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটে যাওয়া না-যাওয়ার ব্যাপারে এখনো কোনো কথা হয়নি।’