রাঙামাটিতে এবার বর্ষায়ও পাহাড়ধসের আশঙ্কা

বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের মঞ্জয়পাড়ায় গতকাল পাহাড়ধসের পর উদ্ধার তৎপরতা। পরে রাতে এখান থেকে তিন শ্রমিকের লাশ উদ্ধার করা হয়।  ছবি: সংগৃহীত
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের মঞ্জয়পাড়ায় গতকাল পাহাড়ধসের পর উদ্ধার তৎপরতা। পরে রাতে এখান থেকে তিন শ্রমিকের লাশ উদ্ধার করা হয়। ছবি: সংগৃহীত
  • এবার বর্ষায়ও পাহাড়ধসের আশঙ্কা।
  • প্রশাসন ৩১টি পাহাড়কে ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করেছে।
  • প্রশাসন সতর্কতার সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দায়িত্ব সেরেছে।
  • তেমন নজরদারি নেই।
  • সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়নি।

রাঙামাটি শহরের ভেদভেদীর পশ্চিম মুসলিমপাড়ায় পরিবার নিয়ে বসবাস করেন মো. নয়ন। গত বছর পাহাড়ধসে মারা যান তাঁর মা রুবি আক্তার। ধ্বংসস্তূপে অনেক খুঁজেও মায়ের মরদেহটি পাননি তিনি। আশ্রয়কেন্দ্রে কিছুদিন থাকার পর একই স্থানে পুনরায় নতুন ঘর বেঁধে বসবাস শুরু করেন নয়ন।

পাহাড়ধসের এক বছর না যেতেই ক্ষতিগ্রস্ত অনেক পরিবার পুনরায় ঝুঁকি নিয়ে বসবাস শুরু করেছে। এবার বর্ষায়ও পাহাড়ধসের আশঙ্কা করা হচ্ছে। জেলা প্রশাসন ৩১টি পাহাড়কে ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করে কেবল সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দায়িত্ব সেরেছে, তেমন নজরদারিও নেই। ভূমিধসের কারণ চিহ্নিতকরণ ও ভবিষ্যতে করণীয় নির্ধারণ বিষয়ে অনুসন্ধান কমিটি যেসব সুপারিশ দিয়েছিল, সেগুলোর বাস্তবায়নও হয়নি।

আসন্ন বর্ষায় প্রাণহানির পাশাপাশি রাস্তাঘাট এবং বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা নতুন করে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। কারণ, পাহাড়ধসের ১১ মাসেও ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তাঘাট এবং স্থাপনা পুরোপুরি মেরামত করা হয়নি।

গত বছরের ১৩ জুন ভয়াবহ পাহাড়ধসে রাঙামাটিতে ১২০ জনের মৃত্যু হয়েছিল। এ সময় রাঙামাটির সঙ্গে অন্যান্য জেলার সড়ক যোগাযোগ প্রায় ১০ দিন বন্ধ ছিল। ছয়টি প্রধান সড়ক বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। জ্বালানি ও খাদ্যসংকট দেখা দিয়েছিল। বিদ্যুৎ ছিল না দুই দিন। পাহাড়ধসে ১০টি সরকারি স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।

ঝুঁকিতে বসবাস
রাঙামাটি বেতার স্টেশনের পাশে নতুনপাড়া এলাকায় সরেজমিনে দেখা গেছে, গতবার যেখানে পাহাড় ধসে পড়েছিল, সেখানে আবার নতুন করে টিন ও বেড়া দিয়ে ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। পাহাড়ের পাশে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে লাগানো সাইনবোর্ডে লেখা: ‘পাহাড়ধসের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। বসবাস করা নিষেধ’। সাইনবোর্ডের লাগোয়া গড়ে উঠেছে তিনটি সেমি পাকা ঘর। সেখানে বসবাসকারী এক নারী বলেন, ‘দুই মাস ধরে এখানে আছি। বর্ষার আগে চলে যাব।’ এর পাশে পাহাড়ের চূড়ায় খলিলুর রহমান নামের এক শ্রমিক ঘরের পাশে সবজি চাষ করছিলেন। এই বাড়ির মালিক শামসুল আলম। ঝুঁকিতে বসবাস করছেন কেন, জানতে চাইলে খলিলুর রহমান বলেন, ‘রাখে আল্লাহ মারে কে।’

নতুনপাড়া থেকে এক কিলোমিটার দূরে রূপনগর এলাকা। ওখানে গত বছর এক পরিবারের তিনজন মারা যায়। ওই পরিবারের বাকি সদস্যরা একই এলাকায় ঘর বেঁধে নতুন করে বসবাস শুরু করেছে। একই এলাকার বাসিন্দা মরিয়ম বেগম বলেন, ‘গরিব বলে অন্য কোথাও জায়গা নেই। তাই পাহাড়ে ঘর বেঁধে বসবাস করি।’

জেলা প্রশাসক এ কে এম মামুনুর রশিদ বলেন, ‘৩১টি পাহাড়ে সাইনবোর্ড দিয়ে সতর্ক করা হয়েছে। ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অভিযান চালানো হয়েছে। লোকজনকে সচেতন করা হচ্ছে। আশা করি, এবার আর প্রাণহানি ঘটবে না।’

সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়নি
পাহাড়ধসের পর ‘ভূমিধসের কারণ চিহ্নিতকরণ ও ভবিষ্যৎ করণীয় নির্ধারণ শীর্ষক অনুসন্ধান কমিটি’ স্বল্প, দীর্ঘ ও মধ্যমেয়াদি কিছু সুপারিশ করেছিল। ক্ষতিগ্রস্ত স্থাপনা রক্ষায় প্রতিরোধ দেয়াল নির্মাণ, ঝুঁকিপূর্ণ বসতি উচ্ছেদ, পুনর্বাসন, পাহাড় কাটা বন্ধ করা সুপারিশগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য।

অনুসন্ধান কমিটির সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মো. শহীদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সুপারিশের দৃশ্যমান কোনো বাস্তবায়ন দেখা যায়নি। লোকজন সরানো কিংবা পুনর্বাসন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এসব সিদ্ধান্ত নিতে অনেক সময় লাগে। সার্বিকভাবে মনে হচ্ছে, সামনের বর্ষায় শুধু রাঙামাটি নয়, অন্যান্য পার্বত্য এলাকা এবং কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ভয়াবহ বিপর্যয় হতে পারে।

বর্ষা শুরু হওয়ার আগেই গত এপ্রিল থেকে বেশ কয়েক দিন রাঙামাটিতে ভারী বৃষ্টি হয়েছে। মে মাসের প্রথম ১৫ দিনে ১৪২ দশমিক ৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। এর মধ্যে ৭ মে ৪৩ মিলিমিটার এবং ৮ মে ৫৪ মিলিমিটার। রাঙামাটি আবহাওয়া দপ্তরের আবহাওয়াবিদ গাজী হোসেন আহমেদ বলেন, এবার বৃষ্টি বেশি হচ্ছে। মে মাসে যে পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে, তাতে মনে হচ্ছে, মৌসুমি বায়ু সক্রিয় হলে জুনে অনেক বেশি বৃষ্টি হতে পারে।

রাস্তাঘাট ঝুঁকিতে
পাহাড়ধসে ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তাঘাট জোড়াতালি দিয়ে চালু রাখা হয়েছে যোগাযোগব্যবস্থা। রাঙামাটি-চট্টগ্রাম সড়কের দূরত্ব ৭৪ কিলোমিটার। এই সড়কের রাঙামাটি অংশে অন্তত ৬০টি স্থানে পাহাড়ধস হয়ে সড়কের ওপর মাটি পড়েছে। ২০ টির বেশি জায়গায় বড় বড় ফাটল ছিল। দুই স্থানে সড়কের অস্তিত্বই বিলীন হয়ে গিয়েছিল। সাপছড়ির বিলীন হয়ে যাওয়া অংশে একটি বেইলি সেতু করে যোগাযোগ রক্ষা করা হয়। ৬টি সড়কের ১৪৫টি স্থানে সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।

ধসের পর বড় বড় ফাটলের অংশে খুঁটি দিয়ে সড়ক ধরে রাখার চেষ্টা করা হয়। একইভাবে রাঙামাটির মহালছড়ি, ঘাগড়া-কাপ্তাইসহ অন্যান্য সড়কে জোড়াতালি দিয়ে মেরামত চলে। মহালছড়ি সড়ক, রাঙামাটি-চট্টগ্রাম সড়কের বিভিন্ন অংশে দেখা যায়, খুঁটি ও লোহার রড দিয়ে সড়কের ধসে পড়া অংশ আটকে রাখার চেষ্টা করা হয়। পাহাড়ধসের পর সাড়ে ১৪ কোটি টাকার কাজ করা হয়েছে। কিন্তু স্থায়ী কোনো সমাধান এখনো করা যায়নি।

সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) রাঙামাটির নির্বাহী প্রকৌশলী এমদাদ হোসেন বলেন, ‘আমরা ঝুঁকির কথা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। আসন্ন বর্ষা মৌসুমে কী হতে পারে, তা তুলে ধরেছি। কিন্তু বলা হয়েছে, যখন হয়, তখন ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আসলে রাস্তাঘাটের কাজ হুট করে করা যায় না।’

পুরোনো বসতির পাশাপাশি পাহাড়ের পাদদেশে ও খাঁজে গড়ে উঠেছে ঝুঁকিপূর্ণ নতুন বসতি। গতকাল বিকেলে রাঙামাটি শহরের নতুনপাড়া এলাকায়।  ছবি: প্রথম আলো
পুরোনো বসতির পাশাপাশি পাহাড়ের পাদদেশে ও খাঁজে গড়ে উঠেছে ঝুঁকিপূর্ণ নতুন বসতি। গতকাল বিকেলে রাঙামাটি শহরের নতুনপাড়া এলাকায়। ছবি: প্রথম আলো



বিভিন্ন স্থাপনা ঝুঁকিতে

গত বছরের পাহাড়ধসে রাঙামাটিতে সার্কিট হাউস, জেলা প্রশাসকের বাসভবনসহ ১০টি স্থাপনা ঝুঁকিতে পড়ে। এর মধ্যে টেলিভিশন ভবন, পাসপোর্ট কার্যালয়, পুলিশ সুপারের বাসভবন, বেতার ভবন অন্যতম। বালুর বস্তা, খুঁটিসহ বিভিন্ন সামগ্রী দিয়ে অস্থায়ীভাবে এসব স্থাপনা রক্ষা করার চেষ্টা চলে। স্থায়ী কোনো মেরামতকাজ করা হয়নি।

গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জহির উদ্দিন আহমেদ বলেন, পাহাড়ধসের পর ১০টি অতিঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে বরাদ্দ না পাওয়ায় ঝুঁকিমুক্ত করার কাজ করা যায়নি।