মুখে মুখে আরমানের ফিরনি

ইফতারে চট্টগ্রাম নগরের ক্যাফে আরমানের তৈরি ফিরনি খুব জনপ্রিয়। গতকাল নগরের দেওয়ান হাটে।  ছবি: প্রথম আলো
ইফতারে চট্টগ্রাম নগরের ক্যাফে আরমানের তৈরি ফিরনি খুব জনপ্রিয়। গতকাল নগরের দেওয়ান হাটে। ছবি: প্রথম আলো

টেবিলের ওপর সারি করে সাজানো হচ্ছে একের পর এক ছোট ছোট কাপ। তার আগে দুজন বিশাল ডেকচি থেকে দ্রুতবেগে কাপগুলো ফিরনি দিয়ে ভর্তি করছেন। এর পাশে রান্নাঘর। সেখানে দুটি চুলা জ্বলছে। চুলার ওপর দুটো বড় ডেকচিতে দুধের মতো সাদা পানি। বড় দুটি চামচ দিয়ে চারজন লোক বারবার নেড়ে যাচ্ছেন। আস্তে আস্তে বের হচ্ছে সুগন্ধ। একসময় তরল দুধ ঘন হয়ে রূপ নিচ্ছে ফিরনিতে।

ফিরনি তৈরির এই প্রক্রিয়াটি সার্বক্ষণিক তদারক করে যাচ্ছেন একজন। তাঁর নাম এরশাদ হোসেন। ডাক নাম আরমান। তাঁর নামেই এই ফিরনির নামকরণ। ‘আরমানের স্পেশাল ফিরনি’। শহরের দেওয়ানহাট ডিটি রোডের ক্যাফে আরমান হোটেল অ্যান্ড রেস্তোরাঁর মালিক এরশাদ হোসেনসহ তিন ভাই।

প্রায় দুই দশক ধরে রমজান মাসে তাঁদের রেস্তোরাঁয় ফিরনি এই নগরের ইফতারির অন্যতম অনুষঙ্গ। মুখে মুখে আরমানের ফিরনির নামডাক। দেওয়ানহাটের আরমানের ফিরনি নগরের পাথরঘাটা, মোমিন রোড, এনায়েতবাজার, ফকিরহাট, সীতাকুণ্ডসহ সর্বত্র মেলে। খুচরা বিক্রির পাশাপাশি পাইকারিতেও বিক্রি হয় আরমানের এই স্পেশাল ফিরনি।

ফিরনি তৈরি করে বিখ্যাত হওয়ার নেপথ্যের কাহিনিটিও সাদামাটা। এরশাদ বলেন, প্রায় ২০ বছর আগে পারিবারিকভাবে তিন ভাই ক্যাফে আরমান রেস্তোরাঁ শুরু করেন তাঁরা। রমজান মাসে অন্যান্য ইফতারির পাশাপাশি ফিরনি তৈরি করতেন। তিন-চার বছর যাওয়ার পর ফিরনির চাহিদা আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে। প্রথমদিকে ছোট একটি ডেকচিতে ফিরনি তৈরি করা হতো। এখন বড় বড় ৯-১০ ডেকচিতে ফিরনি তৈরি করতে হয়।

এবার প্রথম রোজায় ক্যাফে আরমান ১৭ ডেকচি (প্রতি ডেকচিতে ২০০ কেজি) ফিরনি বিক্রি করে। প্লাস্টিকের ছোট কাপ, ছোট মাটির হাঁড়ি, এক কেজি এবং আধা কেজির প্লাস্টিক কাপে ফিরনি বিক্রি হয়। প্লাস্টিকের কাপ ২৫ টাকা, মাটির হাঁড়িতে ২০ টাকা এবং প্রতি কেজি ২৫০ টাকায় বিক্রি হয়।

ফিরনি তৈরির কাজ শুরু হয় ভোর পাঁচটা থেকে। চলে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত। দিনের ১০টা থেকে সাহ্‌রি পর্যন্ত চলে ফিরনি বিক্রি। দিনেরটা দিনেই শেষ হয়ে যায়। নগরের বড় বড় ইফতার পার্টিতেও যায় আরমানের ফিরনি।

গতকাল সোমবার বেলা ১১টায় সরজমিনে দেখা যায়, একদিকে চলছে ফিরনি তৈরি, অন্যদিকে বিক্রি। পাইকারি ও খুচরা দুভাবে ফিরনি বিক্রি হয় দেওয়ানহাটের রেস্তোরাঁ থেকে। ধনিয়ালা পাড়ার মো. আনোয়ার বাসার জন্য ফিরনি কিনতে আসেন তখন। তিনি বলেন, আরমানের ফিরনির স্বাদ অন্যদের চেয়ে আলাদা। তাই এখান থেকে নেন প্রতিবছর।

ফকিরহাটের মো. জসিম উদ্দিন কিংবা পাথরঘাটার নাবিলও পাইকারিভাবে ফিরনি কিনতে আসেন তখন। দুজনেই এখান থেকে নিয়ে নিজ নিজ এলাকায় খুচরায় বিক্রি করবেন।

পশ্চিম মাদারবাড়ির জসিম উদ্দিন বলেন, প্রতি রোজায় এখন থেকে ফিরনি নিয়ে ফেরি করে বিক্রি করেন তিনি। রোজা এলে এই ব্যবসা করে তিনি লাভবান। গতকাল দেড় হাজার কৌটা ফিরনি নিয়ে যান জসিম।

ক্যাফে আরমানের কোনো কোনো শাখা নেই। প্রচারও নেই। মুখে মুখে এত নামডাক। এখান থেকে নিয়ে গিয়ে অন্য এলাকায় বিভিন্ন বিক্রেতারা সাইনবোর্ড কিংবা ব্যানার লাগিয়ে বিক্রি করে আরমানের ফিরনি।

এরশাদ হোসেন জানান, লোকজন প্রচার করে। তাঁর নিজের কোনো প্রচার লাগে না। সারা শহর ছাড়াও বিভিন্ন উপজেলায় এমনকি অন্যান্য জেলায়ও যায় ফিরনি। মাদারবাড়ি, দেওয়ানহাট এলাকায় বসবাসরত অন্যান্য জেলার লোকজন বাড়ি যাওয়ার সময় নিয়ে যায়। শুধু রোজার মাসেই এই ফিরনি ব্যবসা করা হয়।

রোজায় ফিরনিই তাঁদের প্রধান ব্যবসা। অন্য ইফতারি কিংবা ভাতও পাওয়া যায় এখানে। রোজার সময় এই দোকানে কাজ করেন প্রায় ৭০ জন কর্মচারী। পুরোনো কর্মচারী সেকান্দর বলেন, শুরু থেকেই তিনি এখানে কাজ করে যাচ্ছেন। ফিরনি তৈরির সঙ্গে যুক্ত তখন থেকেই।

তবে ফিরনি তৈরির মূল ফর্মুলা এরশাদ হোসেনের হাতেই। ‘দুধ পাউডার, চিনি, চাল, সাগু, সুগন্ধি কোনটা কতটা লাগবে তা আমিই দিই। এটা গোপনীয়। আমার ফিরনির স্বাদ আর কারও সঙ্গে মিলবে না।’—বললেন এরশাদ হোসেন।