পদক্ষেপ নিতে হবে এখনই

>ঢাকার পাঁচটি বিশেষ আদালতে নারী–শিশু নির্যাতনের গুরুতর ছয় অপরাধের মামলা নিয়ে প্রথম আলোর দীর্ঘ অনুসন্ধান। বিচার পরিস্থিতির বিশ্লেষণ বলছে, সাজার হার মাত্র ৩ শতাংশ। ধারাবাহিক আয়োজনের শেষ পর্বে আজ করণীয় খোঁজার চেষ্টা।
  • প্রায় দুই বছরের অনুসন্ধান।
  • অনুসন্ধানে অনেক পরামর্শ ও দিকনির্দেশ পাওয়া গেছে।
  • মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য দ্রুত ও ভালো তদন্ত দরকার।
  • উপযুক্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ সময়মতো উপস্থাপনের ওপর জোর।
  • পুলিশ ও সরকারি কৌঁসুলিদের কাজের সমন্বয় দরকার।
  • আদালতের সক্ষমতা বাড়িয়ে দ্রুত ও কার্যকর বিচারের সুপারিশ।

২০১০ সালের ১৯ জানুয়ারি থেকে আত্মহত্যায় প্ররোচনার একটি মামলা নিয়ে ছোটাছুটি করছেন আলী আশরাফ আখন্দ। আত্মহত্যা করেছিল বখাটের উৎপাতের শিকার তাঁর ১৩ বছর বয়সী ভাতিজি।

চলতি মাসের গোড়ায় আশরাফ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই যে বছর গুনি, সাত বছর হয়ে গেল, আট বছর হয়ে গেল। আমরা আর কত দিনই-বা বাঁচব, বেঁচে থাকার সময় এটার বিচার দেখে মরব কি না...। ন্যায়বিচার পাব কি না জানি না। হয়রানি তো হচ্ছেই।’

একটি ধর্ষণ মামলার ভুক্তভোগী প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘ঘুষ নেওয়াটা যদি না থাকত, ন্যায়বিচারটা থাকত, তাহলে একটা মানুষ অন্যায় করলে সেরে (পার পেয়ে) যেতে পারত না।’ ২০১২ সালে ১৫ বছর বয়সে মামলা করার পর থেকে মেয়েটিকে এখনো হুমকি-হেনস্তা সইতে হচ্ছে। তাঁর মামলার পয়সাওয়ালা পেশিশক্তিধর আসামি গত বছর বেকসুর খালাস পেয়েছেন।

ঢাকা জেলার বিশেষ আদালতগুলোয় ১৫ বছরে আসা এমন প্রায় আট হাজার মামলার তথ্য নিয়ে প্রথম আলো নারী-শিশু নির্যাতনের বিচার পরিস্থিতি বুঝতে চেয়েছে। দেখা গেছে, গুরুতর ছয়টি অপরাধের এসব মামলাতেও আসামিদের অব্যাহতি ও খালাসের হার মাত্রাছাড়া রকমের বেশি।এর কারণ খুঁজতে প্রতিবেদকেরা ৬৫টি মামলা খুঁটিয়ে দেখেছেন। কথা বলেছেন বিভিন্ন পক্ষের লোকজন, পুলিশ কর্মকর্তা আর আইনজীবীদের সঙ্গে। প্রায় দুই বছর চলা অনুসন্ধানে নানা ক্ষেত্রে করণীয় সম্পর্কে অনেক পরামর্শ ও দিকনির্দেশ পাওয়া গেছে।

জড়িত সব পক্ষ আর প্রথম আলোর সুপারিশগুলোর মোদ্দা কথা হচ্ছে মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য দ্রুত ও ভালো তদন্ত, উপযুক্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ সময়মতো উপস্থাপন, পুলিশ ও সরকারি কৌঁসুলিদের কাজের সমন্বয় আর আদালতের সক্ষমতা বাড়িয়ে দ্রুত ও কার্যকর বিচার।

দরকার রাষ্ট্রপক্ষের জন্য আইনজীবীদের স্বতন্ত্র ক্যাডার সার্ভিস গঠন, তদন্ত ও বিচারে যুক্ত ব্যক্তিদের প্রশিক্ষণ এবং তাঁদের কাজের নজরদারি। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনটির সংশোধন জরুরি। চাই আপস-বাণিজ্য ঠেকানো আর দুর্নীতি কমানোর জন্য কড়া পদক্ষেপ।

সমস্যার শিকড়
সমস্যার সূত্র ধরেই সুপারিশে যাওয়া। প্রথম সমস্যা, তদন্ত ও বিচারপ্রক্রিয়ায় যুক্ত ব্যক্তিরাও বলে থাকেন, এ আইনে করা মামলার বেশির ভাগই মিথ্যা। অনেকের কথাবার্তায় ধর্ষণ বা যৌন হয়রানির ভুক্তভোগীকে অবিশ্বাস করার, ঘটনার দায় তার ওপরে চাপানোর প্রবণতা দেখা যায়। ঘটনাগুলো ‘অপরাধ’ বলে মনে না করার এবং এগুলো ঘটা ‘জায়েজ’ ভাবার প্রবণতাও চোখে পড়েছে।

এসব সাধারণ ধারণা ও প্রবণতা অভিযোগকারী আর ভুক্তভোগীর প্রতি বৈরী আচরণের একটা ধারা তৈরি করছে। এই ধারা সমাজেও আছে। প্রতিকার খোঁজার পথে এটা বড় বাধা।

এসব মামলার প্রতি দরদের অভাব চোখে পড়েছে। তদন্ত ও মামলা পরিচালনায় অদক্ষতা, অবহেলা আর দুর্নীতির অভিযোগ আছে। আছে মামলা ঝুলে যাওয়ার প্রবণতা।

বিচারপ্রার্থীর মনে সুবিচার পাওয়ার ভরসা নেই। ঘাটে ঘাটে টাকা ঢালতে হয়। টাকা আর প্রভাবের জোরে সবলতর আসামিকে রেহাই পেতে দেখা যায়। সব মিলিয়ে আদালতের বাইরে আপস এবং তা নিয়ে বাণিজ্যের একটা ধারা তৈরি হয়ে গেছে।

সমস্যার একেবারে গোড়ায় গেলে সমাজে, রাষ্ট্রে, মানুষের মনে গেড়ে বসে থাকা বৈষম্য ও মানসিকতার কথা চলে আসে। সেখানে বদল আনার তাগিদ থাকা চাই।

‘মিথ্যা মামলা’ এবং সুরাহা
এই অভিযোগ মূলত উঠেছে যৌতুকের জন্য সাধারণ জখম, প্রেমঘটিত অপহরণ, যৌনপীড়ন বা বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ধর্ষণের প্রসঙ্গে। এ ছাড়া, ধর্ষণচেষ্টা এমনকি ধর্ষণের ক্ষেত্রে জমিজমার বিরোধ নিয়ে কিছু ভুয়া মামলা হওয়ার অভিযোগ আছে।

এসব অভিযোগ পুরো আইনকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে। প্রথম আলোর দেখা ছয়টি গুরুতর অপরাধের ক্ষেত্রে মিথ্যা বলার সুযোগ কম। তবে আপস হয়। এর জেরে আসামিরা অব্যাহতি অথবা খালাস পান। আবার তদন্ত ও মামলা পরিচালনায় সমস্যা থাকলেও এমনটা হতে পারে।

বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) আইন উপদেষ্টা এস এম রেজাউল করিম যেমনটা বললেন, ‘ফৌজদারি মামলায় খালাস হলেই যে মামলা মিথ্যা হয়, তা না।’

ঢালাওভাবে ‘মিথ্যা মামলা’ বলার বা ভাবার প্রবণতা বন্ধ হওয়া দরকার। সরকার দেশজুড়ে একটি জরিপ করে দেখুক, কোন কোন ধারায় মিথ্যা মামলার প্রবণতা কেমন? সমস্যা কি ধারাগুলোর? যথোপযুক্ত ধারার অভাবের? খালাস বা অব্যাহতির কত ভাগ মিথ্যা মামলার জন্য? কত ভাগ তদন্ত ও বিচারের সমস্যার জন্য? ট্রাইব্যুনালে লিখিত আবেদন করে মিথ্যা মামলার অভিযোগকারীর বিরুদ্ধে পাল্টা মামলা দায়েরের সুযোগ আছে। অভিযোগ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মিথ্যা প্রমাণিত হলে জেল-জরিমানার বিধান আছে। কিন্তু পাল্টা মামলা কদাচিৎ হয়। আইনজীবীরা বিধানটির প্রয়োগ চাইছেন।

দ্রুত নিষ্পত্তি
মামলা নিষ্পত্তিতে দেরি হলে আসামির খালাসের সম্ভাবনা বাড়ে। আপস হয়ে যায়। সাক্ষীদের পাওয়া যায় না। আলামত নষ্ট হয়।

দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য প্রথম কথা, দ্রুত কিন্তু ভালো তদন্ত। পুলিশ তদন্ত প্রতিবেদন দিয়ে আসামির অব্যাহতি চাইলে ট্রাইব্যুনাল এজাহারকারীর উপস্থিতিতে দ্রুত শুনানি করবেন। পুলিশ অভিযোগপত্র দিলে ট্রাইব্যুনাল দ্রুত অভিযোগ গঠন করবেন। রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী আনবে, টানা শুনানিতে মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি হবে।

কখনো আসামিপক্ষ ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মামলাটির বাতিল চেয়ে অথবা ট্রাইব্যুনালের কোনো আদেশের বিরুদ্ধে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৬১-ক ধারায় হাইকোর্টে বিবিধ মামলা করে। হাইকোর্ট রুল জারি করে মামলার কার্যক্রম স্থগিত করলে সেটা অনেক দিনের জন্য ঝুলে যায়।

আইনজীবী রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, হাইকোর্টে যাওয়া সবার অধিকার। তবে এ ধরনের স্পর্শকাতর মামলায় আদালত দ্রুত বিষয়টি নিষ্পত্তি করে দিলে ভালো হয়।

দ্রুত ভালো তদন্ত
ফৌজদারি আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলছেন, বেশির ভাগ মামলার তদন্ত দুর্বল থাকে, ‘অনেক ক্ষেত্রে অনভিজ্ঞতার কারণে, অনেক ক্ষেত্রে ইচ্ছাকৃত। মামলার আসামি সচ্ছল হলে ইচ্ছাকৃতভাবে তদন্ত কর্মকর্তারা (আইও) সঠিক সাক্ষী আনেন না, সঠিকভাবে মামলার আলামত সংগ্রহ করেন না।’

আরও কয়েকজন আইনজীবী ও পুলিশ কর্মকর্তা দক্ষ আর যোগ্য তদন্ত কর্মকর্তার অভাবের কথা বলেছেন। তাঁরা বলেছেন, আইওদের শুধু তদন্তে নিযুক্ত রাখলে তাঁরা বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠতে পারেন। কিন্তু তাঁদের ‘ভিআইপি ডিউটি’সহ বিবিধ দায়িত্ব দেওয়া হয়। তাঁরা রাজনৈতিক প্রভাবসহ নানা চাপেও থাকেন।

পুলিশের বিশেষায়িত দুটি সংস্থায় আইওদের নিরবচ্ছিন্ন তদন্তের সুযোগ আছে। কিন্তু অধিকাংশ মামলার তদন্ত করে থানা। থানায় একজন পরিদর্শক (তদন্ত) আছেন। দরকার, একাধিক কর্মকর্তাকে নিয়ে তদন্ত ইউনিট।

রুজুকারী কর্মকর্তাকে দেখতে হবে, এজাহার যেন ঠিকঠাক হয়। আইও দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে অপরাধ বুঝে আলামত সংগ্রহ করবেন। আলামত সংরক্ষণের সুযোগ-সুবিধা লাগবে। ঘটনাস্থলের মানচিত্র করা, সাক্ষীদের তদন্তকালীন জবানবন্দি নেওয়া, সুরতহাল করা, মামলার যথাযথ ধারা নির্ণয়, কেস ডায়েরি ও তদন্ত প্রতিবেদন লেখার মতো নৈমিত্তিক কাজগুলোতে নিয়মিত প্রশিক্ষণ জরুরি।

তদন্ত এখনো মূলত মৌখিক সাক্ষ্যনির্ভর। বিজ্ঞানভিত্তিক আলামত-প্রমাণ সংগ্রহ আর পরীক্ষার সক্ষমতা বাড়াতে হবে। আলামতের বিষয়ে মানুষকে সচেতন করতে হবে। সাক্ষী তালিকায় যথোপযুক্ত ব্যক্তিদের রাখা এবং ভাসমান সাক্ষী নির্বাচনে সতর্কতা জরুরি।

আলামতের জব্দতালিকায় নিরপেক্ষ ও সাহসী লোককে সাক্ষী করা দরকার। জব্দতালিকার একটা কপি ভুক্তভোগী পক্ষকে দিতে হবে। আইনজীবীরা বলছেন, তালিকা বদলে যাওয়ার নজির আছে।

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নূর মোহাম্মদ জোর দিচ্ছেন তদন্ত তদারকির ওপর। তিনি বলছেন, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের তদারকিতে গাফিলতির সুনির্দিষ্ট উদাহরণ ধরে ব্যবস্থা নিলে অন্যরা সতর্ক হবেন।

নাম-ঠিকানা সঠিক না থাকায় অনেক আসামি অব্যাহতি পায়। কখনো যাচাইয়ের আগেই আসামি ভুয়া নাম-ঠিকানা দিয়ে জামিনে বেরিয়ে যায়। এজাহারকারী বা সাক্ষীদেরও পাওয়া যায় না।

যাচাই মূলত করেন স্থায়ী ঠিকানা যে থানায়, সেখানকার তদন্তকারী। আইও পাল্টা যাচাইয়ের চেষ্টা করবেন। ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা নিশ্চিত করে আসামি, সাক্ষী ও এজাহারকারীর নাম-ঠিকানার ডিজিটাল তথ্যভান্ডার থাকা জরুরি।

তদন্ত ও জামিনের সময় যাচাইযোগ্য প্রমাণপত্র (জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্মনিবন্ধন, মোবাইল সিমের নিবন্ধন ইত্যাদি) নিয়ে পাল্টাপাল্টি যাচাই করা বাধ্যতামূলক হওয়া চাই। আসামি পালিয়ে গেলে ট্রাইব্যুনাল অবশ্যই আইনজীবী ও জামিনদারকে জবাবদিহি করবেন।

সাক্ষী ও সাক্ষ্য
সাজা না হওয়া অথবা মামলা ঝুলে যাওয়ার বড় কারণ সাক্ষীর গরহাজিরা। আইনত সাক্ষীর আসা নিশ্চিত করবেন তাঁর এলাকার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি)। সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) সাক্ষী হাজির করার উদ্যোগ নেবেন, তাঁকে আদালতে তুলবেন।

পিপি ও পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব আছে। সাক্ষীদের হাজিরা, তাঁদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা—এসবের জন্য এই সমন্বয় অত্যাবশ্যক। পিপি আদালতের সব নির্দেশনা পুলিশকে জানাবেন। পুলিশের অপরাধ ও তথ্য বিভাগ (আদালত পুলিশ) গুরুত্বপূর্ণ মামলাগুলোর সাক্ষীদের তালিকা করে নিয়মিত তদারক করবে। থানাগুলো সাক্ষী হাজির করতে বিশেষ ব্যবস্থা নেবে।

সাবেক পিপি ফারুক আহম্মেদ মামলার নথিতে প্রত্যেক সাক্ষীর মোবাইল নম্বর ও ই-মেইল ঠিকানা দিতে বলছেন। তিনি পুলিশের মতো চিকিৎসক এবং জবানবন্দি রেকর্ডকারী হাকিমেরও পরিচয়পত্র নম্বর চাইছেন। সরকারি এই সাক্ষীদের কর্তৃপক্ষকে তাঁদের হাজিরা নিশ্চিত করতে হবে।

পিপি সাক্ষীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবেন, সমন-পরোয়ানা যাচ্ছে কি না দেখবেন। সাক্ষী এলে তাঁকে তাঁর তদন্তকালীন জবানবন্দি পড়াবেন।

এজাহারকারী ও মানবাধিকার আইনজীবীরা বলছেন, সাক্ষী গেলেও অনেক সময় পিপি-এপিপিরা তাঁদের হাজিরা নেন না। আইনজীবী মাকছুদা বললেন, ‘সাক্ষী যখন আদালতে যায়, মনে হয় যেন আসামি যাচ্ছে, এমন ভয় পায় তারা যেতে। টাকা না দিলে পিপি হাজিরাও নিতে চায় না।’

সাক্ষীদের ভালোভাবে বসানো, হাজিরা দ্রুত করানো, সম্মান-সৌজন্য দেখানো দরকার। সরকারি সাক্ষীরা পান, অন্যদেরও যাতায়াত খরচ দেওয়া দরকার।

দুর্নীতি নিরন্তর
ভুক্তভোগীরা বলছেন, থানায় মামলা নেওয়া থেকে আদালতে বিচার-সংক্রান্ত কাজের প্রায় প্রতিটি ধাপে টাকা লেনদেন হয়। অভিযোগের আঙুল পুলিশ কর্মকর্তা, পিপি ও আদালতের লোকজনের দিকে। ফরেনসিক ডাক্তার আর বিভিন্ন আলামতের পরীক্ষকদের বিরুদ্ধেও এই অভিযোগ আছে।

এজাহারকারী বা ভুক্তভোগীকে মামলা-সংক্রান্ত বিভিন্ন কাজের জন্য টাকা দিতে হয়। আসামি টাকা দেন বিভিন্ন সুবিধা পেতে।

কিছু মামলা তদন্ত করে ঘুষ-দুর্নীতির প্রমাণ পেলে পুলিশ কর্মকর্তা, পিপি-এপিপিসহ জড়িত সবাইকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে সে কথা মানুষকে জানাতে হবে। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ মো. রেজাউল হায়দার বলছেন, পুলিশে নিয়মিত গুরুদণ্ড-লঘুদণ্ড দেওয়া হয়।

আপস-বাণিজ্য
সমাজে সালিসকারী, থানায় পুলিশ, আদালতে আইনজীবী বা কর্মচারীদের অনেকে আসামিপক্ষের সঙ্গে ভুক্তভোগীকে আপস করানোর ব্যাপারে মধ্যস্থতা করেন। স্থানীয় নেতা, জনপ্রতিনিধি, সমাজপতিরা যুক্ত থাকেন। সাক্ষীরাও বিক্রি হন।

অন্তত কয়েকটি মামলা তদন্ত করে টাকাদাতা আসামিপক্ষসহ জড়িত প্রত্যেককে দৃষ্টান্তমূলক কঠোর শাস্তি দেওয়া দরকার। পিপিরা যেন পাল্টি খাওয়া সাক্ষীদের বৈরী ঘোষণা করেন।

এজাহারকারীর সুরক্ষা
থানায় মামলা নিতে হয়রানি করা যাবে না। রাষ্ট্র বাদী। এজাহারকারী বা ভুক্তভোগী সাক্ষী। কয়েকজন এজাহারকারী অভিযোগ করেছেন, পিপি শুনানি এমনকি রায়ের তারিখও জানান না। এজাহারকারীকে নিয়মিত তদন্ত আর মামলার অগ্রগতি জানানো জরুরি। তাঁকে মামলার সব কাগজপত্র দিতে হবে।

কিছু আইন-সহায়তা সংস্থা এজাহারকারীকে সাহায্য করার জন্য তাঁর সঙ্গে একজন আইনি সহায়তা কর্মীকে দেন। রাষ্ট্রও এটা করতে পারে।

চাই নজরদারি
নারী-শিশু মামলাগুলো আলাদা করে নজরদারি বা তদারকির কেন্দ্রীয় কোনো ব্যবস্থা নেই। তদন্ত ও বিচারের সমস্যাগুলো সে জন্য চোখের আড়ালে রয়ে যায়। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলছেন, নারী-শিশু নির্যাতন মামলার জন্যও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি মনিটরিং সেল করা একেবারে জরুরি হয়ে পড়েছে। এই সেল অগ্রাধিকার তালিকা করে সারা দেশের মামলাগুলোর তদন্ত থেকে নিষ্পত্তি পর্যন্ত নজরদারি-তদারক করবে। রাষ্ট্রপক্ষ হেরে গেলে আপিলের তাগাদা দেবে।

সেলটি ফৌজদারি কার্যবিধির ২৬৫-জ ধারায় সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবের যুক্তিতে যে খালাসগুলো হচ্ছে, সেগুলো খতিয়ে দেখবে। একাধিক আইনজীবী মনে করেন, ধারাটির অপব্যবহার হচ্ছে।

আপিল করতে হবে
আইন বলছে, রায়ের ৬০ দিনের মধ্যে আপিল করতে হবে। রাষ্ট্রপক্ষ আপিলের উদ্যোগ খুব কম নেয়। সুপ্রিম কোর্টে আইন মন্ত্রণালয়ের সলিসিটরের দপ্তরের অনুমতি নিয়ে এজাহারকারী আপিল করতে পারেন। তবে তাঁরা বেশির ভাগই দরিদ্র, সাধ্যে কুলায় না।
পিপি মামলার মান বুঝে উদ্যোগী হয়ে আপিলের পক্ষে লিখিত যুক্তিসহ কাগজপত্র জমা দেবেন। সেটা পেলে সলিসিটর অ্যাটর্নি জেনারেলকে ব্যবস্থা নিতে বলবেন, খরচের ব্যবস্থা করবেন।

ট্রাইব্যুনাল ১-এর পিপি মো. আবদুল বারী বলছেন, মামলাগুলো প্রায় সবই আপস হয়ে যায়। তাই তাঁরা আপিলে যান না। তিনি বলেন, ‘গত এক থেকে দেড় বছরে আমি কোনো আপিল করার উদ্যোগ নিইনি। যদিও আপিল করার দায়িত্ব আমাদেরই।’

ট্রাইব্যুনালে মামলাজট
নিষ্পত্তিতে দেরি হয় মূলত ট্রাইব্যুনালে মামলা ঢোকার পর। ট্রাইব্যুনালগুলো মামলার চাপে বেসামাল। অতি সম্প্রতি ঢাকার জন্য চারটিসহ দেশজুড়ে ৪১টি নতুন ট্রাইব্যুনাল হয়েছে।

পুরোনো ট্রাইব্যুনালগুলোর কোনো কোনোটিতে লম্বা সময় ধরে বিচারক না থাকার নজির আছে। এজলাস, লোকবল ও আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধার অবস্থা বেহাল। এগুলো দূর করা জরুরি। মামলার তথ্য ডিজিটাল উপায়ে সংরক্ষণ করা দরকার। দরকার, কম্পিউটারে তাৎক্ষণিক সাক্ষ্য টুকে সাক্ষীকে দিনাদিন দেখিয়ে তাঁর সই নেওয়া।

সর্ষের মধ্যে ভূত?
আইনজীবী শাহদীন মালিক মনে করেন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে বেশ কিছু ধারা ঢালাও। ব্যবহারিক দিক দিয়েও আইনটির অনেক দুর্বলতা আছে। আরও কয়েকজন আইনজ্ঞ বেশ কিছু অপরাধের সুস্পষ্ট সংজ্ঞায়ন চাইছেন। পুলিশ, রাষ্ট্রপক্ষ ও আদালতের জবাবদিহি সুনির্দিষ্ট করতে তাগিদ দিচ্ছেন।

ছেলেশিশুদের যৌন নির্যাতন এবং বিবাহ সম্পর্কের মধ্যে ধর্ষণকে সমভাবে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করার দাবি আছে। শিশুর বয়স অনূর্ধ্ব-১৮ নির্ধারণ করা দরকার। অর্থাৎ আইনটির সংশোধন চাই।

ভুক্তভোগী, নারীর অধিকার নিয়ে কাজ করা ব্যক্তি-সংগঠন, মানবাধিকার আইনজীবী, পুলিশ, পিপি, অভিজ্ঞ ফৌজদারি আইনজীবী, বিচারকসহ সব পক্ষকে সম্পৃক্ত করে, তাদের মতামত নিয়ে সরকারকে আইনটি সংশোধনের উদ্যোগ নিতে হবে।

ভিন্ন মত আছে, তবে কয়েকজন আইনজ্ঞ বলেছেন, আইনটিতে অনেকগুলো অপরাধে মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ড থাকায় সমস্যা হচ্ছে। শাহদীন মালিক বলছেন, উঁচু ও চরম শাস্তির বিধান থাকলে সাজার হার কমে যায়।

আইনে আছে, ট্রাইব্যুনাল চাইলে অর্থদণ্ডের টাকাটা ভুক্তভোগীকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে দিতে পারবেন। এটা কিন্তু আদায় করা কঠিন। সরকার আলাদা করে বিশেষত ধর্ষণ-সংক্রান্ত মামলার ভুক্তভোগীর জন্য ক্ষতিপূরণের কর্মসূচি চালু করতে পারে। এটা ভুক্তভোগীকে মামলা চালাতে এবং আপস ঠেকাতে সাহায্য করবে।

এত বছরেও আইনটির বিধি তৈরি হয়নি। আইনজীবীরা বলছেন, ধর্ষণজাত শিশুর ভরণপোষণ, অর্থদণ্ড আদায়ের উপায়সহ আরও কিছু বিষয়ে সুনির্দিষ্ট বিধি দরকার।

সমস্যা মনের গভীরে
দুনিয়াজুড়ে বিভিন্ন গবেষণা বলছে, নারীর প্রতি সহিংসতার আকর হচ্ছে সমাজে বিদ্যমান নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি এবং বৈষম্যের মানসিকতা। প্রথম আলোর অনুসন্ধান দেখেছে, এই মানসিকতা বিচারপ্রক্রিয়াতেও নানাভাবে বাধার সৃষ্টি করে।

অপরাধের তদন্ত ও বিচারপ্রক্রিয়ায় যুক্ত সবার জন্য নারী-শিশুর তথা সব মানুষের সম-অধিকার ও সমমর্যাদা বিষয়ে নিয়মিত প্রশিক্ষণ দরকার। দরকার, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে আচরণবিধি-নীতিমালা করে সেটা কঠোরভাবে মান্য করা। নির্যাতন যে হচ্ছে, সহিংসতার বিচার ও প্রতিরোধ যে হতে হবে, এটা তাদের বিশ্বাস করতে হবে।

পুরুষ ও নারী উভয়ের মানসিকতা বদলের কাজটি আসলে শুরু হতে হবে পরিবারে, সমাজে। গবেষক-বিশ্লেষক ফেরদৌসী সুলতানা জোর দিচ্ছেন মেয়েদের শক্তি বাড়ানো আর উপযুক্ত পরিবেশ গড়ার ওপর। তারা যেন নির্যাতনের কথা বলতে সাহসী হয়, ন্যায়ের জন্য লড়ার শক্তি পায়।

সমাজের ফেটে পড়া?
এই ধারাবাহিকের ধর্ষণ-সংক্রান্ত পর্বটি প্রকাশের পর প্রথম আলো ফেসবুকে পাঠকদের পরামর্শ চেয়েছিল। পাঠক সাব্বির হোসেন লিখেছিলেন, ‘ধর্ষকের কোনো ধর্ম বা দল নেই! তাই কোনো রাজনৈতিক নেতা যদি ধর্ষকের পক্ষ নেয়, তবে তারও বিচার করতে হবে।’ তানভির আরাফাত চেয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি পদক্ষেপ।

মামলা যাঁরা করছেন, তাঁদের বেশির ভাগই গরিব মানুষ। আইনজীবী শাহদীন মালিক মনে করেন, সে জন্যই রাষ্ট্র, সমাজ এমনকি নারী সংগঠনগুলোও এসব অপরাধের বিচার বা প্রতিরোধ নিয়ে কেবল মুখে সরব, কাজে একনিষ্ঠ নয়। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘গুরুতর ছয় অপরাধে মাত্র তিন ভাগ মামলায় সাজা হচ্ছে! আমাদের তো সবাইকে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া উচিত!’