জেল-জরিমানা নির্ধারণে চলছে ব্যাপক নৈরাজ্য

বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বছরে প্রায় ১ লাখ ৪৩ হাজার টাকা। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কেউ স্বাধীনতাযুদ্ধ নিয়ে দ্বিতীয়বার অপরাধমূলক মন্তব্য করলে তার অর্থদণ্ড হবে তিন কোটি টাকা, যা তার ২১০ বছরের মাথাপিছু আয়ের সমান।

প্রথমবার অপরাধ করলে এক কোটি টাকার অর্থদণ্ডের সঙ্গে জেল ১৪ বছর, দ্বিতীয়বার করলে ওই অর্থের সঙ্গে যাবজ্জীবন জেল। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি রোধে আইনের যে খসড়া হয়েছে, তাতে প্রথমবার পাঁচ বছর জেল ও এক কোটি টাকা, দ্বিতীয়বার করলে এর দ্বিগুণ সাজার প্রস্তাব করেছে আইন কমিশন।

প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা যায়, প্রায় দুই দশক ধরে সর্বোচ্চ শাস্তি নির্ধারণে জাতীয় সংসদ ক্রমাগত কঠোর হচ্ছে। ২০০৬ সালে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে বিএনপি গুরুদণ্ড নির্ধারণ করেছিল, যা আওয়ামী লীগ সরকার গত প্রায় এক দশকে নৈরাজ্য পর্যায়ে নিয়ে গেছে। ছাপা ও অনলাইনের ক্ষেত্রে একই অপরাধের জন্য আলাদা সাজা রাখা হয়েছে। এমনকি একটি আইনে যা বলা হয়, পরের আইনে তা বদলে ফেলা হয়। নতুন ডিজিটাল আইন বলছে, অন্য আইনে যা কিছু বিধান থাকুক না কেন, এই আইনটিই প্রাধ্যান্য পাবে।

মূল অপরাধী ও সহায়তাকারীর একই সাজা

 ২০১৫ সালের ৫ মে বর্তমান প্রধান বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত চার সদস্যের বেঞ্চ সর্বসম্মতভাবে বলেছিলেন, অপরাধের গুরুত্ব অনুপাতে শাস্তির মাত্রা নির্ধারিত হবে। ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত পাঁচজনের দুজন সরাসরি ধর্ষণ করেছে, তিনজন সহায়তা করেছে। যদি পাঁচজনকেই মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, তাহলে তা হবে শতাব্দীকাল ধরে অনুসরণ করে আসা রীতির পরিপন্থী।

২০০৬ সালের আইনের ৬৬ ধারায় বিএনপি সরকার বিধান করেছিল, প্রত্যেক সহায়তাকারী মূল অপরাধীর মতোই দণ্ড পাবেন। ডিজিটাল নিরাপত্তা বিলে ৬৬ ধারা বিলোপ করে ৩৫ ধারায় বলা হয়েছে, সহায়তাকারীও মূল অপরাধের মতো একই দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

আপিল বিভাগ আরও বলেছিলেন, আদালতের এখতিয়ার খর্ব করে দিয়ে আইনসভা প্রাসঙ্গিক প্রেক্ষাপটকে অপ্রাসঙ্গিক করে তুলতে পারে না। দণ্ডবিধিতে সে কারণেই অনধিক সাজার পরিমাণ বলে দেওয়া হয়। অপরাধীর অপরাধ বিচার করে তার যথোপযুক্ত কী সাজা হবে, সেটা নির্দিষ্ট করে দেওয়া আইনসভার অধিকার নয়।

উল্লেখ্য, জঘন্য অপরাধেও যেখানে সংসদ এতকাল ন্যূনতম শাস্তি বেঁধে দেয়নি, সেখানে আওয়ামী লীগ সরকার ২০১৩ সালে ২০০৬ সালের তথ্যপ্রযুক্তি আইনের চারটি ধারায় সাত বছর করে ন্যূনতম শাস্তি বেঁধে দিয়েছিল। ডিজিটাল আইনে তার তিনটিতে বিলোপ হলেও ২০০৬ সালের আইনের ৬১(১) ধারায় তা রাখা হয়েছে।

বাক্স্বাধীনতার অপব্যবহারসংক্রান্ত অপরাধের জেল-জরিমানা দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসের সাজার চেয়ে বেশি হয়ে গেছে। হ্যাকিং করা আর কাউকে হত্যাচেষ্টা এখন সমান অপরাধ। ডিজিটাল আইনের ৩৩ ধারায় বেআইনিভাবে তথ্য-উপাত্ত ধারণে অনধিক ৫ বছর জেল, ১০ লাখ টাকা জরিমানা, দ্বিতীয়বার করলে কারাদণ্ড ৭ বছর ও জরিমানা হবে ১৫ লাখ টাকা।

দণ্ডবিধির ৩২৫ ধারা বলেছে, ধারালো কোনো অস্ত্রে কেউ মারাত্মকভাবে আহত হলে অনধিক সাত বছর জেল হবে, ন্যূনতম শাস্তির উল্লেখ নেই। জরিমানার অনধিক টাকার অঙ্ক বলা নেই। এমনকি গুলি করে বা বোমার আঘাতে কেউ কাউকে পঙ্গু করে দিলেও তার শাস্তি অনধিক যাবজ্জীবন। কিন্তু ন্যূনতম শাস্তি কী হবে, তা বিচারকেরাই ঠিক করেন। এমনকি যদি সরকারি কর্মকর্তা বিশ্বাস ভঙ্গ করে ফৌজদারি অপরাধে জড়ান, তাহলেও তাঁর সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন, কিন্তু ন্যূনতম সাজা বলা নেই। অর্থদণ্ড কী হবে তা বলা নেই। সন্ত্রাসী, ছিনতাইকারী, ধর্ষণকারী বারবার একই অপরাধ করলে শাস্তি দ্বিগুণ দিতে বিচারককে বাধ্য করার বিধান নেই। কিন্তু ডিজিটাল আইনে প্রতিটি অপরাধের ক্ষেত্রে তাই করা হয়েছে।

মুদ্রণের সঙ্গে অনলাইনের সাজার পার্থক্য

বাক্স্বাধীনতাসংক্রান্ত অপরাধকে সাইবার অপরাধ বা নাশকতার সঙ্গে এক করে দেখা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাক্স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণে সাজার মাত্রা দেখে পেশাদার সাইবার সন্ত্রাসীরা ভাবতে পারেন, সাংবাদিক-অপরাধীর সঙ্গে তাঁদের তফাত নেই।

প্রস্তাবিত ডিজিটাল আইনের বাক্স্বাধীনতাসংক্রান্ত প্রায় সব অপরাধই জামিন অযোগ্য। এই আইনে অনুপাতহীন শাস্তি এবং মুদ্রণমাধ্যমের সঙ্গে অনলাইনের সাজার মধ্যে বিরাট পার্থক্য তৈরি করা হয়েছে।

১৯২৩ সালের অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টে গুপ্তচরবৃত্তির সাজা আছে, কিন্তু তা শর্তসাপেক্ষ। বিদেশি শক্তিকে সাহায্য এবং সামরিক বাহিনীসংক্রান্ত তথ্য বেআইনিভাবে সংগ্রহ করলে ১৪ বছর জেল, তবে জরিমানার কথা নেই। অন্য ক্ষেত্রে হলে তিন বছর জেল। অর্থদণ্ড নেই।

অথচ ২০১৮ সালের নতুন আইনের ৩২ ধারায় গুপ্তরচরবৃত্তির জন্য ১৪ বছর জেল ও ২৫ লাখ টাকা জরিমানা এবং দ্বিতীয়বার ঘটলে যাবজ্জীবন জেল ও এক কোটি টাকা জরিমানার বিধান করা হয়েছে। মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, এই বিধান অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় বিঘ্ন সৃষ্টি করবে।

ছাপার চেয়ে অনলাইনে সাজা বেশি

একই অপরাধ পত্রিকায় ছাপা হলে সাজা কম, অনলাইনে প্রকাশ হলে সাজা বেশি। যেমন, ভয় দেখানোর জন্য কিছু ছাপলে অনধিক দুবছর জেল বা জরিমানা। অনলাইনে প্রকাশ হলে ১৪ বছর পর্যন্ত জেল বা এক কোটি টাকা জরিমানা। নেতিবাচক প্রচারণা মুদ্রণে ১০ বছর জেল, কোনো জরিমানা নেই। অনলাইনে তা ১৪ বছর জেল, এক কোটি টাকা জরিমানা। মিথ্যা ও বিকৃত সংবাদ মুদ্রণে সাত বছর (দুই বছর ছিল, বিএনপি সাত বছর করেছে) জেল, অনলাইনে তিন বছর (দ্বিতীয়বার পাঁচ) জেল। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা খবর মুদ্রণে জেল দুই বছর, টাকার অঙ্ক নেই। অনলাইনে প্রথমবার সাত বছর, ১০ লাখ টাকা জরিমানা এবং দ্বিতীয়বার ১০ বছর জেল ও ২০ লাখ টাকা জরিমানা।

দণ্ডবিধি থেকে মানহানির সংজ্ঞাটুকু নেবে

 আইন কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ২০১৬ সালে প্রেস কাউন্সিলের অনুরোধে সাংবাদিকদের মানহানি মামলায় অভিযুক্ত হওয়া এবং কাউন্সিলের রায় মানা বা না মানা বিষয়ে প্রতিকারমূলক উপায় নির্দেশ করেছিলেন। এক প্রতিবেদনে তিনি ভারত, শ্রীলঙ্কা, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, ডেনমার্ক, জার্মানি, কানাডা, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, নিউজিল্যান্ডের আইনে সাংবাদিকদের কীভাবে মানহানিমূলক খবর প্রকাশ করলে শাস্তি দেওয়া হয়, তা বিস্তারিত আলোচনা করেন। তাতে দেখা যায়, অধিকাংশ দেশেই তিরস্কারের বিধান বহাল আছে। শ্রীলঙ্কায় মানহানিকর বক্তব্য ও জননৈতিকতার জন্য ক্ষতিকারক বা অশ্লীল বিবরণ পত্রিকায় প্রকাশ করলে আদালত কর্তৃক পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা এবং অনূর্ধ্ব দুবছরের জেলের বিধান আছে। সম্প্রতি মানহানিকে ফৌজদারি দায় হিসেবে না দেখতে জেনেভায় মানবাধিকার কাউন্সিলের বৈঠক থেকেও তাগিদ এসেছে।

বাংলাদেশে ডিজিটাল আইনে ব্যক্তির মানহানির সংজ্ঞা ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ৪৯৯ ধারা থেকে নেওয়া হবে। কিন্তু শাস্তিটা নেওয়া হবে না। ডিজিটাল আইনের ২৯ ধারা বলেছে, মানহানিকর তথ্য প্রথম প্রকাশ করলে তিন বছর জেল বা অনধিক ৫ লাখ টাকা জরিমানা, দ্বিতীয়বার করলে ৫ বছর জেল বা অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড কার্যকর হবে।

জানতে চাইলে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এম এ মতিন প্রথম আলোকে বলেন, জেল-জরিমানা নির্ধারণে যে চিত্র পাওয়া যাচ্ছে, তা নৈরাজ্যকর। মূল অপরাধী ও সহায়তাকারীর একই সাজা এবং ন্যূনতম শাস্তি নির্ধারণ যথাক্রমে ন্যায়বিচারের মৌল নীতি এবং আদালতের পরম ও অন্তর্নিহিত ক্ষমতার পরিপন্থী। সার্বিক বিচারে এতে আইনি অজ্ঞতা এবং ক্ষমতার ঔদ্ধত্যের প্রতিফলন ঘটেছে। (শেষ)