এক 'শিশু যোদ্ধার'গল্প

নিজ বিদ্যালয়ের সামনে বই হাতে দাঁড়িয়ে শরমিন আক্তার। সম্প্রতি চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলা সদরের ফয়েজ শফি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।  প্রথম আলো
নিজ বিদ্যালয়ের সামনে বই হাতে দাঁড়িয়ে শরমিন আক্তার। সম্প্রতি চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলা সদরের ফয়েজ শফি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। প্রথম আলো

শিশুটির বয়স সবে ১২। এর মধ্যে তার ওপর দিয়ে গেছে বিরাট ধকল। মা-বাবা জোর করে বিয়ে দিয়ে দেন। কিন্তু তার মন পড়ে থাকত স্কুলে। তিন মাসের মাথায় শ্বশুরবাড়ি থেকে পালিয়ে আসে সে। তবে পরিবারের কাছে ফেরেনি, সোজা হাজির হয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয়ে। মেয়েটি পাশে পায় ইউএনওকে। ফিরে পায় তার শৈশব, বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষের কোলাহল। ইউএনও তাকে অ্যাখ্যা দিয়েছেন ‘শিশু যোদ্ধা’ হিসেবে।

অদম্য এই শিশুটির নাম শরমিন আক্তার। চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার চুনতি ইউনিয়নের ফারাঙ্গা গ্রামে তার বাড়ি। সেখানেই ফারাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী ছিল সে। গত বছরের ডিসেম্বর মাসে (তখন তার বয়স ছিল ১১) তার মা-বাবা গোপনে জোর করে কক্সবাজারের মহেশখালীর এক যুবকের সঙ্গে তার বিয়ে দেন। কিন্তু বিয়ের তিন মাসের কাছাকাছি সময়ে সুযোগ বুঝে গত ২৫ মার্চ সে শ্বশুরবাড়ি থেকে পালিয়ে আশ্রয় নেয় লোহাগাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয়ে। এরপর থেকে উপজেলা প্রশাসনের জিম্মায় আছে সে। পরিবারের সদস্য হিসেবে থাকছে প্রশাসনের এক কর্মকর্তার বাসায়। পড়ছে উপজেলা সদরের ফয়েজ শফি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণিতে।

শরমিন প্রথম আলোকে জানায়, গত বছরের আগস্টের শুরুতেই মা-বাবা তাঁদের পূর্বপরিচিত মহেশখালীর ছনখোলাপাড়া এলাকার এক যুবকের সঙ্গে তার বিয়ের কথা পাকা করেন। গত ১১ আগস্ট বিয়ের তারিখ ঠিক হয়। বিয়ে না দিতে মা-বাবাসহ স্বজনদের বোঝায় সে। কিন্তু তাঁরা অনড় থাকেন। শেষে বিষয়টি বিদ্যালয়ের এক শিক্ষককে বললে তিনি ইউএনওকে জানান।
লোহাগাড়া উপজেলায় তখন ইউএনও ছিলেন মো. মাহবুব আলম (এখন কুমিল্লার দাউদকান্দিতে কর্মরত)। তিনি বাল্যবিবাহের খবর পাওয়ার পরপরই গত বছরের ৯ আগস্ট ফারাঙ্গা গ্রামে গিয়ে হাজির হন। এ সময় মেয়ের বয়স ১৮ না হওয়া পর্যন্ত বিয়ে দেবেন না শর্তে অভিভাবকদের কাছ থেকে মুচলেকা নেন।

মুচলেকা নিলেও শরমিনের মা-বাবা ঠিকই সেই যুবকের সঙ্গে বিয়ের সিদ্ধান্ত থেকে সরেননি। গত বছরের ডিসেম্বর মাসে শরমিনের তৃতীয় শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষার সময় জোর করে তাকে নানার বাড়ি বান্দরবানের লামায় নিয়ে যান তাঁরা। সেখানেই ১৫ ডিসেম্বর রাতে ওই যুবকের সঙ্গে তার বিয়ে দেন।
শরমিন বলে, ‘বিয়ের পরপরই তাকে শ্বশুরবাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে স্কুলের স্যার ও বন্ধুদের চেহারাই মনে পড়ত সব সময়। মন চাইত বিদ্যালয়ে যেতে। তাই গত ২৫ মার্চ সুযোগ পেয়ে পালিয়ে ইউএনও স্যারের অফিসে চলে আসি। স্যারকে (ইউএনও) সব খুলে বলি।’

ইউএনও মো. মাহবুব আলম বলেন, শরমিন পালিয়ে আসার পরই তাকে লোহাগাড়া উপজেলা পরিষদ কার্যালয়ের পার্শ্ববর্তী ফয়েজ শফি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রশাসনের জিম্মায় সে এখন নিয়মিত স্কুলে যায়। ভবিষ্যতে শিক্ষার খরচ মেটানোর জন্য তার নামে উপজেলা ডাকঘরে ৫০ হাজার টাকা এফডিআর করে রাখা হয়েছে। তার দায়িত্ব এখন উপজেলা প্রশাসনের। সে পঞ্চম শ্রেণি পাস করলে তাকে আবাসিক ব্যবস্থা আছে এ রকম কোনো বিদ্যালয়ে ভর্তি করানো হবে। মাহবুব আলম বলেন, ‘শরমিন একজন শিশু যোদ্ধা। এই অদম্য মনোবল তাকে এগিয়ে নেবে।’
মেয়েকে বাল্যবিবাহ দিয়ে এখন অনুতপ্ত শরমিনের পরিবার। তার মা ছেনুয়ারা বেগম মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘অভাবের সংসার। তার বাবার চায়ের দোকান চালিয়ে কোনোরকমে সংসার চালান। তাই না বুঝে মেয়েকে লেখাপড়া না করিয়ে বিয়ে দিয়েছেন। মেয়ে ফিরে এলে তার লেখাপড়া চালিয়ে যাবেন।

উপজেলা সদরের ফয়েজ শফি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দেব প্রসাদ বড়ুয়া বলেন, শরমিন নিয়মিত বিদ্যালয়ে উপস্থিত থাকে। সে পড়ালেখায় মনোযোগী।
ইউএনও মো. মাহবুব আলমের মাধ্যমেই গত মাসে ওই যুবকের সঙ্গে শরমিনের বিয়ে বিচ্ছেদ হয়। ফেলে আসা সেই ঘটনা ভুলতে চায় শরমিন। দৃঢ়তার সঙ্গেই সে বলে, ‘আমি বড় হতে চাই। নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই। বড় একজন অফিসার হতে চাই।’