ভারত ও বাংলাদেশ একে অপরের পরিপূরক: মোদি

উত্তরীয় পরিয়ে দিয়ে অতিথিদের বরণ করে নেওয়া হয়। মঞ্চে (বাম দিক থেকে) বিশ্বভারতীর ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য সবুজকলি সেন, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠী। ছবি: বাসস
উত্তরীয় পরিয়ে দিয়ে অতিথিদের বরণ করে নেওয়া হয়। মঞ্চে (বাম দিক থেকে) বিশ্বভারতীর ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য সবুজকলি সেন, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠী। ছবি: বাসস

আজ দিনটি ছিল কবিগুরুর স্মৃতিবিজড়িত শান্তিনিকেতনের জন্য অন্য রকম এক দিন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এসেছিলেন শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসব আর বাংলাদেশ ভবনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। দুটি অনুষ্ঠানেই যোগ দিয়েছেন এই তিন নেতা।

প্রথমে এই তিন নেতা যোগ দেন বিশ্বভারতীর সমাবর্তন উৎসবে। নরেন্দ্র মোদি আবার বিশ্বভারতীর আচার্য। তিনি এই প্রথম এলেন বিশ্বভারতীতে। বিশ্বভারতীতে দীর্ঘ পাঁচ বছর পর অনুষ্ঠিত হলো এই সমাবর্তন উৎসব। সমাবর্তন উৎসব শেষে শেখ হাসিনা, নরেন্দ্র মোদি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চলে আসেন বাংলাদেশ ভবন উদ্বোধনের জন্য। বিশ্বভারতীর পূর্বপল্লিতে বাংলাদেশের অর্থে নির্মিত হয়েছে এই বাংলাদেশ ভবন।

এর আগে বিশ্বভারতীর সমাবর্তনে ভাষণ দিতে গিয়ে আচার্য ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, ভারত ও বাংলাদেশ দুটি আলাদা দেশ হলেও পারস্পরিক সহযোগিতা এই দুই দেশকে জুড়ে দিয়েছে মৈত্রীর বন্ধনে। আর তারই উদাহরণ হলো বাংলাদেশ ভবন। তিনি আরও বলেন, ভারত ও বাংলাদেশ একে অপরের পরিপূরক। এটি একটি দুর্লভ ঘটনা যেখানে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী অংশ নিয়েছেন।

প্রধানমন্ত্রী মোদি বলেছেন, ‘আমি অতিথি হিসেবে এখানে আসিনি। আমি এসেছি আচার্য হিসেবে। তিনি বলেছেন, রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে এসে নিজেকে গর্বিত মনে হচ্ছে। গোটা বিশ্বে রবীন্দ্রনাথ নন্দিত। তিনিই প্রথম বিশ্বনাগরিক। এখনো তিনি বিশ্বনাগরিক হিসেবে রয়ে গেছেন।’ তিনি বলেন, রবীন্দ্রনাথ গোটা বিশ্বকে আপন করে নিয়েছিলেন। আর তাঁর সেই বিশ্বভাবনার ফসল হলো বিশ্বভারতী। মোদি তাঁর ভাষণ শুরু করেছিলেন বাংলায়।

একই মঞ্চে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বিশেষ অতিথি হিসেবে ছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই প্রথম বিশ্বভারতীর কোনো সমাবর্তন মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন কোনো রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী এবং রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। ৪২ বছর আগে পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় সমাবর্তনে উপস্থিত থাকলেও ছিলেন দর্শক আসনে। আজ আরও মঞ্চে ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠি এবং বিশ্বভারতীর উপাচার্য অধ্যাপক সবুজকলি সেন। প্রচণ্ড গরম সত্ত্বেও প্রায় দশ হাজার ছাত্রছাত্রী ও স্থানীয় মানুষ এদিনের সমাবর্তনে উপস্থিত ছিলেন। তবে সমাবর্তনে আসা সকলে পানি না পাওয়ায় যে অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছিলেন, সে জন্য প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে শুরুতেই ক্ষমা চেয়ে নেন। সমাবর্তন শেষে মমতাকে সঙ্গে নিয়ে দুই প্রধানমন্ত্রী পূর্বপল্লিতে বাংলাদেশ ভবনের উদ্বোধন করেন।

এর আগে সকাল ৯টা ২৫ মিনিটে দুদিনের সরকারি সফরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর সফরসঙ্গীদের বহনকারী বিমান কলকাতার নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছায়। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নগর উন্নয়নমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম এবং ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী বিমানবন্দরে প্রধানমন্ত্রীকে অভ্যর্থনা জানান। সেখান থেকে প্রধানমন্ত্রী হেলিকপ্টারে করে কলকাতা থেকে ১৮০ কিলোমিটার উত্তরে পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার শান্তিনিকেতনে পৌঁছান। হেলিপ্যাড থেকে শেখ হাসিনা রবীন্দ্রভবনে পৌঁছালে মোদি তাঁকে স্বাগত জানান। এই সময় হাসিনার সঙ্গে ছিলেন তাঁর বোন শেখ রেহানা। সেখানে পুষ্পার্ঘ্য দিয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী।

এরপর দুজনই সেখানে রাখা স্মারক মন্তব্য বইতে তাঁদের মতামত লেখেন। সেখান থেকে বিশ্বভারতীর প্রথা অনুযায়ী দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী হাসিনা ও মোদি, পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল কেশরী লাল ত্রিপাঠি, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়সহ সবাই হেঁটে আম্রকুঞ্জের মূল অনুষ্ঠানস্থলে আসন গ্রহণ করেন। মঞ্চে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী হাসিনা ও মোদির পাশেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বসেন। প্রথা অনুযায়ী আচার্য মোদি উপাচার্যের হাতে একটি ছাতিম পাতা তুলে দেওয়ার মাধ্যমে সমাবর্তন সূচনার নির্দেশ দেন। বেদ গান ও রবীন্দ্রসংগীত দিয়ে সমাবর্তনের উদ্বোধন করা হয়। স্বাগত ভাষণ দেন উপাচার্য সবুজকলি সেন।

তখন দুপুর ১২টা ৩০ মিনিট। শান্তিনিকেতনের ঘরানায় তৈরি মঞ্চের বাঁ দিকের তিনটি গদিতে বসেন বিশ্বভারতীর উপাচার্য সবুজকলি সেন। এরপরে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী এবং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মাঝের দুটি গদির বাঁ দিকে বসেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আর ডান পাশের অন্য তিনটি গদিতে বসেন পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠি, বাংলাদেশের শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম এবং বাংলাদেশের সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর।

প্রথমে কথা বলেন, ‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বাংলাদেশ ভবন দেখে হতবাক হয়ে যান। বলেই ওঠেন, দারুণ লেগেছে আমার বাংলাদেশ ভবন। দারুণ পছন্দ হয়েছে। এই বাংলাদেশ ভবনের মধ্য দিয়েই আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরও দৃঢ় হবে। রবীন্দ্র-নজরুল আমাদের চেতনায় বহ্নিমান। আমরা দুই দেশ রবীন্দ্র–নজরুল ছাড়া ভাবতে পারি না।’ মমতা বলেন, এই বাংলাদেশ ভবন তীর্থস্থান হয়ে যাবে। তবে তিনি রাজনৈতিক কোনো কথা বলেননি।

শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা মনে করি রবীন্দ্র নাথ আমাদের। তাঁর গান আজ আমাদের দুই দেশের জাতীয় সংগীত। আমাদের বাংলাভাষা বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে বিশ্বদরবারে।’ তিনি বলেন, ‘ছিটমহল সমস্যার সমাধান হয়েছে। ভারত আমাদের বন্ধু দেশ। মুক্তিযুদ্ধে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। ছিটমহল সমস্যার সমাধান করেছে। তবে শেখ হাসিনা তিস্তা নিয়ে কোনো কথা বলেননি।’

এখানে মোদি তাঁর ভাষণ শুরু করেন বাংলা ভাষায়। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ভবন উদ্বোধন করার সৌভাগ্য হলো। খুব গর্ব অনুভব করলাম। শেখ হাসিনা সময় দেওয়ায় আমার আন্তরিক অভিনন্দন। বাংলাদেশ ভবন ভারত-বাংলাদেশের সংস্কৃতি বন্ধনের প্রতীক।’ তিনি বলেন, ‘গুরুদেবের গান আজ আমাদের দুই দেশের জাতীয় সংগীত। গুরুদেব আমারও প্রেরণা। আমাদের সঙ্গে রয়েছে বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। সাম্প্রতিককালে আমাদের দুই দেশের মধ্যে চলছে এক সোনালি অধ্যায়। দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগ বেড়েছে। কলকাতা-খুলনা বন্ধন ট্রেন চালু হয়েছে। ভারত বাংলাদেশ বন্ধুত্ব চিরজীবী হোক।’