৫০০ গ্রামে সমৃদ্ধির হাসি

তিস্তা খাল দিয়ে পানি আসছে। এই পানিতে সমৃদ্ধির হাসি ফুটেছে ৫০০ গ্রামে। ছবি: প্রথম আলো
তিস্তা খাল দিয়ে পানি আসছে। এই পানিতে সমৃদ্ধির হাসি ফুটেছে ৫০০ গ্রামে। ছবি: প্রথম আলো

রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার পেউলা গ্রামের কৃষক দীনেশ চন্দ্র রায়। দুই বছর ধরে তিনি রংপুর খালের পানি দিয়ে ধান চাষ করছেন। এ বছর পুরোটা সময়ই খালে পানি ছিল। ফলে ধানে সেচ নিয়ে বেগ পেতে হয়নি।
দীনেশ রায় বলেন, ‘এই পানিতে সার আছে। ভুঁইয়োত সার বেশি দিবার নাগে না। পোকামাকড় না থাকায় কীটনাশকও তেমন নাগে না।...খালি বেচন (বীজ) ও ভুঁই চাষ করতে যা খরচ হয়। পাঁচটা বছর যদি হামরা ঠিক মতন খালোত পানি পাই, তাইলে হামার সাথে আর কাঁয়ো পাইরবার নয়।’
ওদিকে নীলফামারীর জলঢাকার মধ্যপাড়া গ্রামের উচ্চশিক্ষিত যুবক কামরুজ্জামান গড়েছেন হাঁসের খামার। তিস্তা খালের ধারে এ খামারে হাঁস আছে দুই হাজারের বেশি। হাঁসগুলো খালে চরে বেড়ায়। বাড়তি খাবার লাগে না বললেই চলে। প্রতিদিন এক হাজারের বেশি ডিম পাচ্ছেন কামরুজ্জামান। তাঁর সংসারে এখন আর অভাব নেই।
দীনেশ রায় ও কামরুজ্জামানের ভাগ্য বদলে দিয়েছে তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্প। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) এই প্রকল্প রংপুর, নীলফামারী ও দিনাজপুরের প্রায় ৫০০টি গ্রামের চিত্র পাল্টে দিয়েছে। কৃষকেরা প্রকল্পের খালের পানিতে ধানসহ বিভিন্ন ফসল ফলিয়ে নিজেদের ভাগ্য বদলাচ্ছেন। এই খাল অসংখ্য বেকারের কর্মসংস্থানও সৃষ্টি করেছে।
পাউবোর উত্তরাঞ্চলের সদ্য সাবেক প্রধান প্রকৌশলী আজিজ মোহাম্মদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্পের আওতায় উপকারভোগী কৃষকের সংখ্যা প্রায় ছয় লাখ। এলাকায় চলতি বোরো মৌসুমে ধান চাষের জন্য সরকারকে প্রায় ১১৩ কোটি টাকার ডিজেল আমদানি করতে হতো। খালের পানি দিয়ে আবাদ করায় ওই টাকা সাশ্রয় হয়েছে। সরকার ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ করে এবার সর্বোচ্চ পরিমাণ পানি তিস্তায় নিতে পেরেছে। এই পানি আমরা সেচ খালে সরবরাহ করেছি। এতে চলতি মৌসুমে ফসল চাষে প্রকল্প এলাকায় অতীতের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে।’
পাউবো সূত্রে জানা গেছে, নীলফামারী সদর, ডিমলা, জলঢাকা, কিশোরগঞ্জ ও সৈয়দপুর, রংপুরের সদর, গঙ্গাচড়া, তারাগঞ্জ ও বদরগঞ্জ এবং দিনাজপুরের চিরিরবন্দর, খানসামা ও পার্বতীপুর উপজেলা ওই তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত। এই প্রকল্পের অধীনে প্রধান খাল রয়েছে চারটি। এগুলো হচ্ছে তিস্তা, বগুড়া, দিনাজপুর ও রংপুর খাল। পাউবো তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্পটির প্রথম পর্যায় বাস্তবায়ন করেছে। ১৯৭৯ সালে এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। শেষ হয়েছে ১৯৯৮ সালের জুনে।

তিস্তা খালের পানিতে চাষ করা বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ। ছবি: প্রথম আলো
তিস্তা খালের পানিতে চাষ করা বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ। ছবি: প্রথম আলো

সম্প্রতি চার খালের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখা গেছে, খালে নীলাভ স্বচ্ছ পানি। খালের দুই পাশে যত দূর চোখ যায়, আধা পাকা বোরো খেত। মাঠের পর মাঠে দুলছে বোরো ধান। খালের ভেতরে বিভিন্ন স্থানে এবং আশপাশে খনন করা পুকুরে চলছে মাছ চাষ। গড়ে তোলা হয়েছে অসংখ্য হাঁসের খামার। তিস্তা খালের পাশ দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে পাকা সড়ক। দুই পাশে গাছ লাগানো হয়েছে। পড়ন্ত বিকেলে কিংবা সকালে খালের পাশের নৈসর্গিক দৃশ্য পথচারীদের নজর কাড়ে।
পাউবোর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্পের আওতাভুক্ত এলাকা ১ লাখ ২০ হাজার ৭৫২ হেক্টর। আবাদযোগ্য জমি ১ লাখ ১১ হাজার ৬০৮ হেক্টর। এর মধ্যে সেচযোগ্য হচ্ছে ৭৯ হাজার ৩৭৮ হেক্টর জমি।
পাউবো বলছে, প্রকল্পের আওতাভুক্ত চারটি খালের পানি ব্যবহার করে চলতি মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক বেশি জমিতে বোরো চাষ হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮ হাজার হেক্টর। অর্জিত হয়েছে ২৮ হাজার ১০০ হেক্টর, যা গত চার মৌসুমের তুলনায় সর্বোচ্চ।
সুবিধাভোগী কৃষকেরা জানিয়েছেন, ওই পরিসংখ্যানের চেয়েও বেশি পরিমাণ জমিতে এবার বোরো চাষ হয়েছে।
কৃষকেরা বলেন, এবার খালে পানির সরবরাহ ছিল পর্যাপ্ত। ফলে বোরো চাষে কোনো বেগ পেতে হয়নি। বোরো চাষের পানি পেতে তাঁদের নির্ধারিত ব্যাংক হিসাবে জমা করতে হয়েছে একরপ্রতি মাত্র ১৮০ টাকা। আর পুরো বছরে সেচের পানি নিতে জমা করতে হয় ৪৮০ টাকা। আগে ভূগর্ভস্থ পানি তুলে বোরো চাষেই একরপ্রতি খরচ পড়ত আট-নয় হাজার টাকা।
গঙ্গাচড়ার দনদরা ও আলাদাবপুর গ্রামের পাশে রংপুর খালের প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার অংশে সম্মিলিতভাবে মাছ ছেড়েছেন গ্রাম দুটির ৫৪ জন বাসিন্দা। ইতিমধ্যে তাঁরা বিপুল পরিমাণ মাছ বিক্রি করেছেন। বাকি মাছ বিক্রি করে কোটি টাকার বেশি পাবেন বলে আশা করছেন তাঁরা।

তিস্তা খালের ধারে গড়ে তোলা খামারে হাঁসগুলোকে খাবার দিচ্ছেন এক খামারি। ছবি: প্রথম আলো
তিস্তা খালের ধারে গড়ে তোলা খামারে হাঁসগুলোকে খাবার দিচ্ছেন এক খামারি। ছবি: প্রথম আলো

ওই মৎস্যচাষিদের দলনেতা হুমায়ুন কবীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ৭০ মণ পোনা মাছ ছেড়েছি। ক্যানেলের পানিতেই মাছের খাবার রয়েছে। বাড়তি তেমন খাবার দিতে হয় না। ফলে মাছ দ্রুত বাড়ছে। ইতিমধ্যে ৪০ লাখ টাকার মাছ তুলে বিক্রি করেছি। এখনো ক্যানেলে যে মাছ আছে, তা কোটি টাকায় বিক্রি হবে বলে আশা করছি।’
পাউবোর রংপুর কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মেহেদী হাসান বলেন, ‘অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে এবার খালে বেশি পানি সরবরাহ করতে পেরেছি। ভবিষ্যতে আমরা আরও বেশি পানি সরবরাহ করতে পারব বলে আশা করছি।’
রংপুর পাউবোর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হারুন অর রশিদ বলেন, খালে পানি সরবরাহ করায় ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমে গেছে। এ কারণে পানির স্তর ক্রমান্বয়ে ওপরে উঠছে।