নির্যাতনের শিকার সাবিনাকে চিনতেই পারেননি মা

শরীরজুড়ে ক্ষতচিহ্ন নিয়ে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বারান্দায় চিকিৎসা নিচ্ছেন সাবিনা খাতুন (২৫)। দুই চোখে তাঁর এখনো আতঙ্ক ও ভয়। গতকালের ছবি। প্রথম আলো
শরীরজুড়ে ক্ষতচিহ্ন নিয়ে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বারান্দায় চিকিৎসা নিচ্ছেন সাবিনা খাতুন (২৫)। দুই চোখে তাঁর এখনো আতঙ্ক ও ভয়। গতকালের ছবি। প্রথম আলো

এক বছর আগে স্বামী-সন্তান রেখে ঢাকায় এক বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করতে গিয়েছিলেন সাবিনা খাতুন। যাওয়ার আগে একটি ছবি তুলেছিলেন তিনি। এক বছর পর সাবিনার মা প্রথম দেখায় তাঁকে চিনতেই পারেননি। এ কোন সাবিনা? তাঁর চেনা সাবিনার সঙ্গে বর্তমান চেহারার কোনো মিল নেই।

নির্যাতনের শিকার হয়ে এখন সাবিনা খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন। সাবিনার (২৫) বাড়ি পিরোজপুরের ইন্দুরকানি উপজেলার চরবলেশ্বর গ্রামে। ১৬ মে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাঁকে। বেশ কিছুদিন ওই হাসপাতালের অর্থোপেডিকস বিভাগে চিকিৎসাধীন থাকার পর সম্প্রতি তাঁকে ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) রাখা হয়েছে।

২০ মে হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, জীর্ণ-শীর্ণ শরীর নিয়ে ঘুমিয়ে আছেন সাবিনা। কেউ বলে না দিলে বোঝার উপায় নেই যে তাঁর বয়স মাত্র ২৫ বছর। বয়স্কদের মতো চোখগুলো গর্তের মধ্যে দেবে গেছে। মুখের হাড়গুলো যেন বেরিয়ে আসতে চাইছে চামড়া থেকে। মাথার চুলগুলো ছেলেদের মতো ছোট ছোট করে কাটা। সেখানে বড় একটি আঘাতের চিহ্ন। ক্ষতস্থানটি অনেকটা শুকিয়ে গেছে। বাঁ হাতের কবজির ওপর ফোলা। সেখানকার হাড় যে ভাঙা, তা দেখেই বোঝা যায়।

অর্থোপেডিকস বিভাগের সহকারী রেজিস্ট্রার মো. নজরুল ইসলাম বলেন, আঘাতজনিত কারণে সাবিনার ডান হাতের কবজির ঠিক ওপরের একটি হাড় ভেঙে গেছে। ওই হাতের কাঁধের অংশটিও জখম। প্রায় দুই মাস আগে ওই ঘটনা ঘটেছে বলে মনে হয়। চিকিৎসা না করানোয় কাঁধের ভাঙা অংশটি আর ঠিক হওয়া সম্ভব নয়। তবে হাতের ভাঙা অংশটি জোড়া লেগে গেছে। ডান ও বাঁ হাত এবং ডান পায়ের ঊরুর মাংসপেশি শক্ত হয়ে গেছে। প্রতিনিয়ত আঘাতের কারণে এটা হতে পারে। দুই পায়েও কিছুটা পচন ধরেছে।

সাবিনার মা মমতাজ বেগম ও বড় বোন হাফিজা খাতুন হাসপাতালে আছেন সাবিনার সঙ্গে। তাঁরা বলেন, সাবিনার স্বামী ভ্যান চালিয়ে পরিবারের খরচ মেটাতেন। কিন্তু দুই সন্তানসহ চারজনের ওই সংসার আর সামান্য আয়ে চলছিল না। এমন সময় পাশের গ্রামের মমতাজ নামের এক নারী সাবিনাকে ঢাকায় থাকা তাঁর এক আত্মীয়ের বাড়িতে কাজ করার প্রস্তাব দেন। থাকা-খাওয়া বাদে প্রতি মাসে ৫ হাজার করে টাকা দেওয়া হবে বলেও জানান। ওই প্রস্তাবে রাজি হয়ে গত বছরের মে মাসে ওই নারীর সঙ্গে ঢাকায় যান সাবিনা। প্রায় এক বছর হয়ে গেলেও কারও সঙ্গে কোনো যোগাযোগই রাখতে দেওয়া হয়নি সাবিনাকে। সঙ্গে একটি মুঠোফোন নিয়ে গেলেও যাওয়ার পর তা কেড়ে নেওয়া হয়।

ঢাকায় যাওয়ার আগে বান্ধবীর সঙ্গে সাবিনা। ছবিতে তিনি বঁায়ে। প্রথম আলো
ঢাকায় যাওয়ার আগে বান্ধবীর সঙ্গে সাবিনা। ছবিতে তিনি বঁায়ে। প্রথম আলো

স্বজনেরা বলেন, ঢাকার ধানমন্ডি এলাকার ৯ নম্বর রোডের ব্যবসায়ী সিদ্দিক আহমেদের বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ শুরু করেন সাবিনা। তাঁকে বেতন দেওয়া হতো ৩ হাজার টাকা। মাস তিনেক আগে চা বানানোর সময় তাঁর পায়ে গরম পানি পড়ে। তাঁকে কোনো চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। ফলে ক্ষত গভীর হয়ে যাওয়ায় সোজা হয়ে হাঁটতে পারেন না তিনি। তাই ঠিকমতো কাজ করতে না পারায় শুরু হয় অমানবিক নির্যাতন। সকাল-বিকেল মুখে কাপড় গুঁজে মোটা লাঠি দিয়ে দরজা বন্ধ করে পেটানো হতো তাঁকে। একের পর এক নির্যাতনে হাতের বাহু থেকে শুরু করে কবজি পর্যন্ত কয়েক জায়গায় ভেঙে যায়। অসুস্থ হয়ে পড়লেও সাবিনাকে কোনো চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। তাঁকে ঠিকমতো খেতেও দেওয়া হতো না। আটকে রাখা হতো বাথরুমে।

সাবিনার মা বলেন, মেয়ের খোঁজখবর না পেয়ে খুঁজতে খুঁজতে ধানমন্ডির ওই বাড়িতে যান। নিজের মেয়েকে দেখে প্রথমে তিনি চিনতে পারেননি। ওই অবস্থায় মেয়েকে নিয়ে আসতে চাইলে একটি সাদা কাগজে তাঁর ও সাবিনার স্বাক্ষর নিয়ে রাখা হয়েছে।

এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য সিদ্দিক আহমেদের সঙ্গে তাঁর মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। খুদে বার্তা (এসএমএস) পাঠিয়েও কোনো সাড়া মেলেনি।

মেয়েকে নিয়ে বাড়িতে এলেও থানায় মামলা করতে পারেননি সাবিনার মা। আগে হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নিয়ে মেডিকেল সার্টিফিকেট নিয়ে আসতে বলে পুলিশ। পরে সবার সহযোগিতায় খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সাবিনাকে সব ধরনের সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার। ওই সেন্টারের প্রধান ও খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার সোনালী সেন বলেন, সাবিনাকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে তাঁরা এখনো মামলা করেননি। মামলা করলে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।