ট্রলারচালক আশরাফ ইয়াবায় কোটিপতি

আশরাফ আলী
আশরাফ আলী
>
  • ৩ মে চট্টগ্রাম থেকে সৎভাইসহ আশরাফ গ্রেপ্তার
  • গ্রেপ্তারের সময় ১৩ লাখ ইয়াবা উদ্ধার
  • ১৫ মে আদালতে জবানবন্দি দেন আশরাফ।
  • আশরাফের দৃশ্যমান কোনো আয়ের পথ নেই।
  • ইয়াবা বিক্রি করেই আশরাফ কোটিপতি।

পাঁচ বছর আগে ছিলেন মাছ ধরার ট্রলারচালক। মিয়ানমারের এক ইয়াবা ব্যবসায়ীর সঙ্গে পরিচয়ের সূত্র ধরে শুরু করেন ইয়াবা ব্যবসা। উড়োজাহাজে আসা-যাওয়া করেন মিয়ানমারে। পাঁচ বছরে হয়ে যান গাড়ি, চট্টগ্রাম শহরে জমি ও ফ্ল্যাটের মালিক। তাঁর নাম আশরাফ আলী। বাড়ি বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে। আদিনিবাস মিয়ানমারের মংডু।

৩ মে চট্টগ্রাম নগরের হালিশহরের শ্যামলী আবাসিক এলাকার একটি ভাড়া বাসা থেকে সৎভাই মো. হাসানসহ আশরাফ আলীকে গ্রেপ্তার করে নগর গোয়েন্দা পুলিশ। এ সময় ১৩ লাখ ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। সেটা ছিল প্রথমবারের মতো মিয়ানমার থেকে চট্টগ্রামে সরাসরি ইয়াবা বড়ি নিয়ে আসা কারও গ্রেপ্তারের ঘটনা। উড়োজাহাজে মিয়ানামার গিয়ে, স্পিডবোটে করে ইয়াবার চালানটি নিয়ে আসা হয়েছিল। ১৫ মে চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম আবু সালেম মোহাম্মদ নোমানের আদালতে জবানবন্দি দেন আশরাফ।

আশরাফের মতো অবৈধভাবে কোটি টাকার মালিক হওয়া ইয়াবা ব্যবসায়ীদের সম্পদের অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। জানতে চাইলে প্রথম আলোকে এ তথ্য জানিয়েছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের চট্টগ্রামের পরিচালক আকতার হোসেন। নগর গোয়েন্দা পুলিশ সূত্র জানায়, পড়ালেখা বেশি করতে পারেননি আশরাফ। নিজের নামটি লিখতে পারেন। বেড়ে ওঠা বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে। সাত ভাই-বোনের মধে৵ সবার বড় তিনি। সেখানে থেকে ১৯৮৬ সালের দিকে চট্টগ্রামে চলে আসেন। এরপর মাছ ধরার ট্রলার চালানো শুরু করেন। সেই সময় শীর্ষস্থানীয় মাদক ব্যবসায়ী মো. মোজাহেরের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। গত বছরের ১৫ এপ্রিল পতেঙ্গার অদূরে বঙ্গোপসাগরের মোহনায় একটি ট্রলার থেকে ২০ লাখ ইয়াবা বড়ি জব্দ করে র‍্যাব। একই দিন নগরের পাঁচলাইশ এলাকার একটি বাড়ি থেকে মো. মোজাহেরকে গ্রেপ্তার করা হয়। মোজাহের এখন কারাগারে।

মোজাহের ছাড়াও ওই সময় মিয়ানমারের মংডুর আবদুর রহিমের সঙ্গে আশরাফের পরিচয় হয়। শুরুতে মিয়ানমার থেকে অবৈধভাবে আসা বিভিন্ন পণ্য পাচারকারীদের সহকারী ছিলেন। পরে ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হন। মোজাহের ও রহিমের সঙ্গে হওয়া পূর্বপরিচয়কে কাজে লাগান আশরাফ।

২০০০ সালের দিকে সৌদি আরবে চলে যান আশরাফ। সেখানে রহিমের সঙ্গে তাঁর আবার দেখা হয়। তিনি মিয়ানমারের নাগরিক লা-মিমের সঙ্গে আশরাফের পরিচয় করিয়ে দেন। সৌদি আরব থেকে দেশে আসা-যাওয়ার মধে৵ থাকতেন আশরাফ। দেশে আসলেও চালাতেন ট্রলার। সর্বশেষ গত বছরের ৭ অক্টোবর আশরাফ সৌদি আরব থেকে দেশে আসেন।

উড়োজাহাজে যান, ট্রলারে ফেরেন

১৩ লাখ ইয়াবার চালানটি আনার জন্য চলতি বছরের ৭ এপ্রিল উড়োজাহাজে করে আশরাফ মিয়ানমার যান। সেখানে ইয়াঙ্গুনে একটি হোটেলে অবস্থান করেন। মিয়ানমারের নাগরিক লা-মিমের কাছ থেকে ইয়াবা বড়ি সংগ্রহ করার পর সাগরপথে ইয়াবা আনার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু সাগর উত্তাল থাকায় রওনা দিতে দেরি হয়। গত ৩০ এপ্রিল ইয়াঙ্গুন থেকে একটি ট্রলার ও স্পিডবোটে করে ইয়াবা নিয়ে রওনা দেন। সেন্ট মার্টিন দ্বীপের কাছাকাছি সমুদ্রে ট্রলার থেকে ইয়াবাগুলো স্পিডবোটে স্থানান্তর করা হয়। এরপর আশরাফ নিজেই স্পিডবোট চালিয়ে চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা দেন। পথে কুতুবদিয়া চ্যানেলে ঝড়ের কবলে পড়ে স্পিডবোট উল্টে গেলে অন্য একটি মাছ ধরার ট্রলারের সাহায্যে ইয়াবার বস্তা উদ্ধার করেন। এরপর ওই ট্রলারের সহায়তায় ইয়াবাগুলো ২ মে চট্টগ্রামের ভাটিয়ারী জেলেপাড়া ঘাটে নিয়ে আসেন। জেলেদের বলেছিলেন, এগুলো প্রসাধনসামগ্রী।

দৃশ্যমান আয়ের পথ নেই

চট্টগ্রাম নগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, আশরাফের দৃশ্যমান কোনো আয়ের পথ নেই। ২০১৩ সালের পর ইয়াবা বিক্রি করেই তিনি চট্টগ্রাম শহরের অলংকার মোড় ও সদরঘাট এলাকায় দুটি ফ্ল্যাট কিনেছেন। বাকলিয়া এলাকায় জায়গা কিনে ভবন নির্মাণের জন্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ থেকে অনুমোদনও নিয়েছেন। স্ত্রী রাহামা আক্তারের নামে রয়েছে প্রাইভেট কার। গাড়ি, ফ্ল্যাট ও জায়গা মিলে কোটি টাকারও বেশি সম্পত্তির মালিক আশরাফ। শুধু ইয়াবা পাচার করেই তিনি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। তাঁর আরও সম্পদ রয়েছে কি না তদন্ত চলছে।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নগর গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক মো. কামরুজ্জামান বলেন, আশরাফের কাছ থেকে পাওয়া তথে৵র ভিত্তিতে আরও তিন ইয়াবা ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁরাও পুলিশকে জানিয়েছেন, ইয়াবা পাচার করে কোটিপতি হয়েছেন ট্রলারচালক আশরাফ।

আশরাফের এখন পর্যন্ত নগরের ও আর নিজাম রোডে দুটি ব্যাংক হিসাবের তথ্য পেয়েছে পুলিশ। তবে এগুলোর মাধ্যমে কোনো লেনদেন করতেন না। হুন্ডির মাধ্যমে ইয়াবা কেনাবেচার টাকা লেনদেন করতেন বলে জানিয়েছে পুলিশ।

বোনের ভাষ্য

নিজের দুটি ফ্ল্যাট থাকলেও আশরাফ ভাড়া থাকতেন হালিশহর এলাকায় একটি বহুতল ভবনে, মাসে ২৫ হাজার টাকা ভাড়ায়। পুলিশ অভিযান চালানোর পর বাসাটিতে থাকেন না তাঁর স্ত্রী-সন্তানেরা। তাঁরা এখন আত্মীয়ের বাসায় রয়েছেন। বারবার চেষ্টা করেও তাঁর স্ত্রী রাহামা আক্তারের সঙ্গে কথা বলা যায়নি।

আশরাফের ছোট বোন জান্নাতুল ফেরদৌস ২৪ মে সন্ধ্যায় মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ভাইয়ের ইয়াবা ব্যবসার বিষয়টি তাঁরা পাঁচ মাস আগে জানতে পারেন। তখন তাঁরা তাঁকে সতর্ক করেছিলেন। আশরাফ দেশে কিছুই করেন না স্বীকার করেন জান্নাতুল ফেরদৌস। তাঁর দাবি, ভাইদের মধে৵ একজন অস্ট্রেলিয়া, দুজন সৌদি আরব, দুজন মালয়েশিয়া থাকেন। তাঁদের টাকায় ফ্ল্যাট, জমি ও গাড়ি কিনেছেন। তাঁরাই আশরাফের সংসার খরচ চালান। ফ্ল্যাট, জমির নিবন্ধন আশরাফের নামে কেন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বড় ভাই হিসেবে তাঁর নাম রয়েছে।