মাতৃত্বকালীন জটিলতায় ১৩ শতাংশ নারীর মৃত্যু

প্রজননক্ষম বয়সে (১৫-৪৯) নারীদের যে মৃত্যু হচ্ছে, তার ১৩ শতাংশই ঘটছে সন্তান জন্ম দেওয়ার সময়। মাতৃস্বাস্থ্য নিয়ে কর্মরত ব্যক্তিরা বলছেন, গর্ভধারণ কোনো অসুস্থতা নয়। তাই এ কারণে মায়েদের মারা যাওয়ার কথা নয়। মায়েদের প্রতি অবহেলা ও অবজ্ঞার কারণেই এ মৃত্যু ঘটছে। অথচ মাতৃমৃত্যুর কারণগুলো প্রতিরোধযোগ্য।

গত বছরের নভেম্বরে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ মাতৃমৃত্যু ও স্বাস্থ্যসেবা জরিপ ২০১৬: প্রাথমিক প্রতিবেদন’-এ নারীদের মৃত্যুর এই পরিসংখ্যান উল্লেখ করা হয়েছে। সরকার এর আগে আরও দুটি মাতৃমৃত্যু ও স্বাস্থ্যসেবা জরিপ প্রকাশ করে ২০০১ ও ২০১০ সালে। ২০০১ সালের জরিপে বলা হয়েছিল, ২০ শতাংশ নারীর মৃত্যুর কারণ ছিল মাতৃত্বসংক্রান্ত। ২০১০ সালে তা কমে ১৪ শতাংশে দাঁড়ায়। ছয় বছরের ব্যবধানে তা হয় ১৩ শতাংশ। ২০ থেকে ৩৪ বছর বয়সী নারীরা বেশি মারা যাচ্ছেন মাতৃত্বকালীন জটিলতায়। এর বাইরে ক্যানসারে ২৪ শতাংশ এবং রক্ত সংবহনতন্ত্রজনিত কারণে ২৩ শতাংশ নারী মারা যাচ্ছেন।

সরকারের তৃতীয় এই জরিপমতে, বর্তমানে বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যুর হার ১৯৬। অর্থাৎ এক লাখ জীবিত শিশুর জন্ম দিতে গিয়ে ১৯৬ জন মায়ের মৃত্যু হচ্ছে। গর্ভধারণজনিত জটিলতা, প্রসবকালে বা প্রসবের পর ৪২ দিনের মধ্যে কোনো প্রসূতির মৃত্যু হলে তাকে মাতৃমৃত্যু বলা হয়।

সরকারের তিনটি জরিপের তথ্য অনুযায়ী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে সন্তান প্রসবের হার বেড়েছে। ২০০১ সালের মাতৃমৃত্যু জরিপে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রসবের হার ছিল মাত্র ৯ শতাংশ, ২০১০ সালে তা হয় ২৩ শতাংশ এবং ২০১৬ সালের জরিপে তা হয়েছে ৪৭ শতাংশ। এখন পর্যন্ত ৫৩ শতাংশ মায়ের অদক্ষ প্রসব সহায়তাকারীর হাতে অনিরাপদ প্রসব হচ্ছে। সারা দেশে শুধু ৩ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্র স্বাভাবিক প্রসবের জন্য ন্যূনতম মানদণ্ড পূরণ করছে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ইশতিয়াক মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিদিন প্রায় ১৬ জন নারী বা প্রতিবছর ৫ থেকে ৬ হাজার মা সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা যাচ্ছেন, যার ৯৫ শতাংশই প্রতিরোধযোগ্য। তাই এই মৃত্যু কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

সরকারের ২০১০ সালের জরিপ অনুযায়ী প্রসবকালে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে ৩১ শতাংশ, খিঁচুনিতে ২০ শতাংশ, প্রসব জটিলতা বা দীর্ঘ সময় ধরে প্রসবের কারণে ৭ শতাংশ, গর্ভপাতের কারণে ১ শতাংশ, পরোক্ষ কারণ (হৃদ্‌রোগ, জন্ডিস ইত্যাদি) ৩৫ শতাংশ, সরাসরি অন্যান্য কারণ ৫ শতাংশ এবং অজানা কারণে ১ শতাংশ মায়ের মৃত্যু হয়। ২০১৬ সালের জরিপেও দেখা যাচ্ছে, রক্তক্ষরণে ৩১ শতাংশ এবং খিঁচুনির কারণে ২৪ শতাংশ মায়ের মৃত্যু হচ্ছে।

দ্বিতীয় ও তৃতীয় জরিপে গবেষক দলের সদস্য কামরুন নাহার প্রথম আলোকে বলেন, জরিপগুলোতে মাতৃমৃত্যুর কারণ, কোন কোন জায়গায় গুরুত্ব দিতে হবে, সব বলা আছে। মাতৃমৃত্যুর পেছনে বড় কারণ হিসেবে রক্তক্ষরণ ও খিঁচুনি প্রতিবারই চিহ্নিত হচ্ছে। কিন্তু এই দুটি কারণকে প্রতিরোধের জন্য যেভাবে কর্মসূচি হাতে নেওয়ার কথা, তা দেখা যাচ্ছে না।

স্ত্রী ও প্রসূতিরোগ বিশেষজ্ঞদের সংগঠন ওজিএসবির প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক লায়লা আরজুমান্দ বানু বলেন, সন্তান গর্ভে আসার আগে থেকেই জন্ম পরিকল্পনা করে সে অনুযায়ী অগ্রসর হতে হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত বিষয়টি খুব অবহেলিত। সম্প্রতি ঢাকার একটি ঘটনায় দেখা গেছে, শিক্ষিত পরিবার হলেও সন্তান প্রসবের সময় মাকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নেওয়া হয়নি। বাড়িতে অদক্ষ প্রসব সহায়তাকারী নানাভাবে চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়ার পর সেই মাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হয় মুমূর্ষু অবস্থায়। তখন চিকিৎসকদের আর কিছুই করা সম্ভব হয়নি।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জেমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথের অধীনে মিডওয়াইফারি এডুকেশন প্রোগ্রামের প্রধান সেলিনা আমীন বলেন, মিডওয়াইফ সেবাকে গুরুত্ব দিলে মায়ের মৃত্যু উল্লেখযোগ্য হারে কমানো সম্ভব। স্বাভাবিক প্রসবের জন্য মাকে সহযোগিতা করা, কাউন্সেলিং করা এবং জটিলতা দেখা দিলে রেফারাল ব্যবস্থা করেন। চিকিৎসক বা নার্সের পক্ষে একজন মায়ের পেছনে এত সময় ব্যয় করা সম্ভব হয় না।

নিরাপদ মাতৃত্ব নিয়ে মোট ১৪টি দেশে কাজ করে হুয়াইট রিবন অ্যালায়েন্স। নেটওয়ার্কটির বাংলাদেশের ন্যাশনাল কো-অর্ডিনেটর ফারহানা আহমেদ বলেন, গত বছর গলাচিপার ডাকুয়া ইউনিয়নে একটি কার্যক্রমে প্রসব পরিকল্পনাসহ বিভিন্ন বিষয় অন্তঃসত্ত্বা নারী ও তঁার পরিবারকে জানানো হয়। সরকারের স্বাস্থ্যকর্মীদের সম্পৃক্ততায় ওই কার্যক্রমে এক বছরে ইউনিয়নটিতে কোনো মা মারা যাননি।