সব জানার পরও মাদক রোধে কার্যকর ভূমিকা নেওয়া হয়নি

>
  •  ইয়াবা আসে শুধু টেকনাফ, নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত দিয়ে
  •  পরিত্যক্ত ইয়াবাই বেশি উদ্ধার করেছে বিজিবি ও কোস্টগার্ড
  •  সীমান্ত থেকে মাঠপর্যায়ে মাদকের সব তথ্যই ছিল পুলিশের কাছে

সীমান্তের কোন পথ দিয়ে মাদক ঢুকছে, কোথায় কীভাবে যাচ্ছে, কারা পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে—সব তথ্যই ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর হাতে। তারপরও বাহিনীগুলো মাদকদ্রব্য পাচার ও বিস্তার রোধে কার্যকর ভূমিকা নেয়নি। বরং তাদের অনেক সদস্য মাদক ব্যবসায় জড়িত ব্যক্তিদের সহযোগিতা করেছে, কোথাও কোথাও নিজেরাও মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এই ভূমিকা নিয়ে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), কোস্ট গার্ড, বাংলাদেশ পুলিশ, র‍্যাব ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রথম আলোর কথা হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিরাই মাদকের গডফাদার। তাঁদের ছত্রচ্ছায়ায় এত দিন এসব অবৈধ ব্যবসা চলে আসছে। ফলে বাহিনীর কোনো কোনো সদস্য বা কর্মকর্তা মাদকদ্রব্য প্রতিরোধ বা নির্মূলের চেয়ে মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে হাত মেলাতেই ব্যস্ত ছিলেন।

মাদকের বিস্তার রোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর এই গাফিলতি কীভাবে দেখেন, প্রশ্ন করা হলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘গাফিলতি থাকলেও থাকতে পারে। তবে আমি মনে করি, এই গাফিলতি সব পক্ষেরই ছিল। কে মাদক ব্যবসায় জড়ায়নি? কোন পেশার লোক বাদ আছে, বলেন?’

দেশে মাদকের ভয়াবহ পরিস্থিতি নিয়ে কয়েক দশক ধরে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে। সরকারও মাদককে দেশের প্রধান সমস্যা বলে বারবার উল্লেখ করেছে। কিন্তু মাদকের বিরুদ্ধে কখনো বড় ধরনের অভিযান চালানো হয়নি। এমনকি প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তৃতায় বারবার মাদক নিয়ে কথা বললেও বাহিনীগুলো কখনো সাঁড়াশি অভিযানে নামেনি। গত ৩১ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান শুরুর নির্দেশ দেন। তারপরও অভিযান শুরু হয়নি। সর্বশেষ ৩ মে র‍্যাবের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে এসে প্রধানমন্ত্রী মাদকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়ার পরই বড় ধরনের অভিযান শুরু হয়। ৪ মে থেকে শুরু হওয়া এই অভিযান ও ‘বন্দুকযুদ্ধে’ গতকাল পর্যন্ত ৯৫ জন নিহত হয়েছেন। কিন্তু তারপরও যে প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হলো, এত দিন বাহিনীগুলো এই ভয়াবহ পরিস্থিতি নিয়ে কী করেছে?

মাদকের প্রবেশপথ ও দেশের কোথায় কীভাবে মাদক পৌঁছাচ্ছে, সে-সম্পর্কিত একটি সরকারি প্রতিবেদনে দেখা যায়, মিয়ানমার সীমান্তবর্তী নাফ নদীর জাদিরমুরা পয়েন্ট থেকে শাহপরীর দ্বীপ পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার এলাকা ইয়াবা পাচারের জন্য সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত রুট। তা ছাড়া কক্সবাজার ও বান্দরবান দিয়ে ইয়াবা ঢুকছে দেশে। বাংলাদেশে আসার পর কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কের দুটি পথ দিয়ে বিভিন্ন জায়গায় চলে যাচ্ছে। এ দুটি পথের একটি টেকনাফ হয়ে সদর উখিয়া ও অন্যটি টেকনাফ হয়ে মেরিনড্রাইভ এলজিইডি সড়ক। সমুদ্রপথে ইয়াবা চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ এবং বরিশাল, পটুয়াখালী, ভোলা ও খুলনা এলাকায় চলে যাচ্ছে।

প্রতিবেদনে দেশীয় ভূখণ্ডে ঢোকার পর মাদক কোথায় কোথায় বিক্রি হয়, সে সম্পর্কেও পরিষ্কারভাবে বলা আছে। যেমন চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার মালিকের নাম উল্লেখ করে ৯টি বাড়ি, ২টি চায়ের দোকানসহ ১৪টি স্থান, দামুড়হুদা উপজেলার ১১টি বাড়িসহ ৮টি স্থান, আলমডাঙ্গা উপজেলার ৯টি বাড়িসহ ৯টি স্থান, জীবননগর উপজেলার একটি চায়ের দোকান, এক ব্যক্তির প্লাস্টিকের দোকান, এক ব্যক্তির প্লেইন শিটের দোকান, একজনের বাড়িসহ মোট ৬টি স্থানের নামের উল্লেখ আছে। বলা হয়েছে, সুনামগঞ্জ সীমান্তে বিএসএফ ও বিজিবিকে হাত করে কাঁটাতারের বেড়ার ভেতর দিয়ে মোটা পাইপ ঢুকিয়ে টানেল তৈরি করে মাদক পাচার করা হচ্ছে।

রেলপথ সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খুলনা-ঢাকা রুটে সীমান্ত, রূপসা ও খুলনা মেইলে ফেনসিডিল, পার্বতীপুর-আক্কেলপুল-সান্তাহার-রাজশাহী রুটে চলাচলকারী উত্তরা এক্সপ্রেসে গাঁজা ও ফেনসিডিল, ঢাকা-ঈশ্বরদী-নাটোর-সান্তাহার রুটে চলাচলকারী দ্রুতযান, একতা, বরেন্দ্র, তিতুমীর, নীলসাগর এক্সপ্রেসে ইয়াবা আনা-নেওয়া করা হয়। মাদকের জমজমাট বিক্রয়কেন্দ্র জয়দেবপুর, টঙ্গী, ভৈরব ও আখাউড়া।

এত সব তথ্য থাকার পরও সীমান্তরক্ষী বাহিনী আসলে কী করছে? বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের পরিচালক (অপারেশনস) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মজিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সংখ্যার দিক থেকে ইয়াবা উদ্ধারে বিজিবি এগিয়ে আছে। সে জন্য পাচারকারীরা স্থলপথ ছেড়ে সমুদ্রপথে যাচ্ছে।

কোস্ট গার্ডের মুখপাত্র লে. কমান্ডার আবদুল্লাহ আল মারুফ প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা শুধু এ বছরের প্রথম ৫ মাসেই ৮০ লাখ ৫০ হাজার ইয়াবা উদ্ধার করেছেন। এর মধ্যে ৮ মে-ই উদ্ধার করা হয়েছে ১৪ লাখ ইয়াবা।

বিজিবি ও কোস্ট গার্ড মাদক উদ্ধার করছে পরিত্যক্ত অবস্থায়। প্রশ্ন উঠেছে, তাঁরা কেন মাদক ব্যবসায়ী গ্রেপ্তার করছেন না—জানতে চাইলে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মজিবুর রহমান বলেন, বড় চালানগুলো ইয়াবা পাচারকারীরা একটা জায়গায় ফেলে যাচ্ছে। গোয়েন্দা তথ্য পেয়ে তাঁরা ঘটনাস্থলে যাচ্ছেন, সেখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসছেন ও পরে ধ্বংস করছেন। বিজিবির কর্মকাণ্ডে তিনি সন্তুষ্ট কি না, এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘তাহলে তো আর মাদকই ঢুকত না দেশে। মাদকের চাহিদা আছে, নেটওয়ার্ক বড়, আমাদেরও হয়তো গাফিলতি আছে।’

কোস্ট গার্ডের মুখপাত্র আবদুল্লাহ আল মারুফ বলছিলেন, মাছ ধরা যেসব ট্রলার বা বোটে করে ইয়াবা আসছে, সেগুলোর গতি আর কোস্ট গার্ডের টহল যানগুলোর গতি প্রায় একই রকম। অনেক সময়ই ধাওয়া দিয়ে তাদের ধরা যাচ্ছে না।

অভিযোগ আছে, বিজিবি ও কোস্ট গার্ডের কোনো কোনো অসাধু সদস্য ইচ্ছা করে আসামি গ্রেপ্তার করেন না, বরং পাচারে সহযোগিতা করেন।

গত ২৮ মার্চ পিরোজপুর পৌরসভার ঝাটকাঠি এলাকা থেকে ৩৬০টি ইয়াবাসহ মো. আকাইদ (২৫) নামের কুমিল্লা বিজিবি ১০ ব্যাটালিয়নের এক সদস্যকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গ্রেপ্তার আছেন কোস্ট গার্ডের সদস্য লাট মিয়া ওরফে ইমন (২৮)। চট্টগ্রামে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের হাতে ধরা পড়েন তিনি। পুলিশ জানায়, তিনি শাহপরীর দ্বীপে কোস্ট গার্ডে কর্মরত ছিলেন। এক মাদক ব্যবসায়ীর সঙ্গে জুটি বেঁধে মাদকের টাকা ভাগাভাগি করে নিতেন।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধেও মাদক বেচাকেনার অভিযোগ আছে। গত বছরের নভেম্বরে কিশোরগঞ্জ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সহকারী পরিচালক আনোয়ার হোসেন খান ভৈরবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা কামনাশীষ সরকারকে জব্দ তালিকায় না থাকা ৬৮ কেজি গাঁজা, ২৪ বোতল ফেনসিডিলসহ গ্রেপ্তার করেন। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক জামালউদ্দীন আহমেদ অবশ্য মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের দুর্বলতা ও জনবলের অভাবকে দায়ী করেছেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি আমরা কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি। মাদক আছে, তাঁরা মাদক খুঁজে পাবেন না কেন?’

মাদক ব্যবসায় যুক্ত থাকার সবচেয়ে বেশি অভিযোগ পুলিশের বিরুদ্ধে। পুলিশের ঊর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তা বলেন, কোন থানার কোথায় কে ব্যবসা করছে, সে সম্পর্কে পুলিশের চেয়ে বেশি আর কেউ জানে না। সব তথ্য থাকার পরও পুলিশ মাদক প্রতিরোধে অভিযান না চালিয়ে বরং ব্যবসায়ীদের সঙ্গের সম্পৃক্ত হয়েছে, এমন অনেক অভিযোগ আছে। গত ১১ ফেব্রুয়ারি পুলিশের ত্রৈমাসিক অপরাধ পর্যালোচনা সভায় দেশের সব জেলার পুলিশ সুপার ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে ঢাকার একজন উপকমিশনার বলেন, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নিয়োগ-বদলি-পদায়নে লাখ লাখ টাকা চান ওসি ও এসআইদের কাছে। তাঁরাও মরিয়া হয়ে মাদক বিক্রেতাদের কাছ থেকে টাকা তোলেন।

অবশ্য পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি মিডিয়া) সহেলি ফেরদৌস প্রথম আলোকে বলেন, অপরাধ থেকে পুলিশ সদস্যরা পুরোপুরি মুক্ত ছিলেন, তা বলা যাবে না। তবে যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেছে, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, মাদক নির্মূল এককভাবে পুলিশের দায়িত্ব নয়। নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা পুলিশের আছে বলেই মাদকটা মহামারি আকারে ছড়ায়নি।

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নুরুল হুদা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমলযোগ্য অপরাধ আগেভাগে প্রতিরোধ করা পুলিশের দায়িত্ব। চাপ ছিল না ঠিক আছে, মাদক ব্যবসায়ী গ্রেপ্তারে কেউ বারণ করেছিল?’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পুলিশের বার্ষিক কাজের মূল্যায়ন প্রতিবেদন আছে। সেখানে জবাবদিহির সুযোগ আছে। তা ছাড়া বাহিনীগুলো কেন কার্যকর উদ্যোগ নেয়নি, সে সম্পর্কে সংসদীয় স্থায়ী কমিটি জবাব চাইতে পারে, আদালত চাইলে সুয়োমোটো করতে পারেন।