বড় ব্যবসায়ীরা ধরা পড়েনি

রাজধানীতে মাদকবিরোধী অভিযান শুরু হয়েছে ২৫ মে থেকে। ছবি: প্রথম আলো
রাজধানীতে মাদকবিরোধী অভিযান শুরু হয়েছে ২৫ মে থেকে। ছবি: প্রথম আলো
>
  • দেশব্যাপী মাদকবিরোধী অভিযানের শুরু ১৪ মে।
  • রাজধানীতে মাদকবিরোধী অভিযান শুরু ২৫ মে থেকে।
  • চার দিনে রাজধানীর ১০ এলাকায় অভিযান।
  • সমন্বয়হীন অভিযানের কারণে ভালো ফল আসছে না।

ঘটা করে মাদকবিরোধী অভিযানের তিন দিন পর কড়াইলে গিয়ে জানা গেল, বস্তির ভেতরেই বড় মাদক বিক্রেতা রয়ে গেছেন। ধরা পড়েননি। এলাকাবাসী জানলেও পুলিশ খুঁজে পায়নি। আর মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পভিত্তিক বড় মাদক ব্যবসায়ী ইশতিয়াক এবং তাঁর মূল সহযোগীরাও ধরাছোঁয়ার বাইরে।

অভিযানের এই অবস্থা শুধু রাজধানী ঢাকায় নয়, ঢাকার বাইরে যেসব স্থানে ১৫ দিন ধরে অভিযান হয়েছে, সেসব স্থান থেকে ‘ড্রাগ ডিলার’ বা বড় মাদক ব্যবসায়ী বলতে যা বোঝায়, এমন কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। গত তিন দিনে রাজধানীতে মাদকবিরোধী অভিযানে ৩০০ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন।

দেশব্যাপী এই মাদকবিরোধী অভিযানের শুরু ১৪ মে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, গতকাল পর্যন্ত অভিযান ও ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ১০৮ জন নিহত হয়েছেন। বন্দুকযুদ্ধের পাশাপাশি ব্লক রেইড করছে র‍্যাব ও পুলিশ। তবে এই অভিযান শুরুর আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ঘোষণা করেছিলেন, সব বাহিনী থেকে পাওয়া মাদক ব্যবসায়ীদের তালিকা ধরে অভিযান চালানো হবে। সেই অনুযায়ী বাহিনীগুলো দেশব্যাপী মাদক ব্যবসায়ীদের তালিকা তৈরি করে। এরপর তালিকা সমন্বয়েরও উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু সেই তালিকা সমন্বয় শেষ হওয়ার আগেই বিভিন্ন বাহিনী অভিযান শুরু করে। দেখা যায়, র‍্যাব, পুলিশ, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) নিজ নিজ পরিকল্পনামতো অভিযান চালাচ্ছে। একপর্যায়ে অভিযোগ ওঠে, এক বাহিনীর সঙ্গে আরেক বাহিনীর কোনো সমন্বয় নেই। এমনও হয়েছে, এক মাদক ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে পুলিশ ও র‍্যাব একসঙ্গে প্রস্তুতি নিয়েছে। পরে জানতে পেরে এক বাহিনী অভিযানে যাওয়া বাদ দিয়েছে।

অভিযানে অংশ নেওয়া বাহিনীগুলোর একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, সমন্বয়হীন অভিযানের কারণে অভিযানে ভালো ফল আসছে না। যে যার মতো করে অভিযান চালাচ্ছে বলে এখন পর্যন্ত বড় কোনো মাদক ব্যবসায়ীকে ধরা সম্ভব হয়নি। তাঁদের আশঙ্কা, অভিযানের প্রথম পর্যায়ে ভালো পাওয়া না গেলে কাজের কাজ কিছুই হবে না। কালক্ষেপণের সুযোগে বড় ব্যবসায়ীরা গা ঢাকা দেবেন। দেশের ৪০টি জেলায় গত ১৫ দিনে বন্দুকযুদ্ধে যেসব ব্যক্তি নিহত হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে বড় ধরনের কোনো মাদক ব্যবসায়ীর খোঁজ পাওয়া যায়নি।

রাজধানীতে মাদকবিরোধী অভিযান শুরু হয়েছে ২৫ মে থেকে। ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি), সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশ, স্পেশাল আর্মড ফোর্স ডগ স্কোয়াড নিয়ে রাজধানীর ১০টি এলাকায় অভিযান চালায়। ঢাকা মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মাসুদুর রহমান বলেছেন, এ পর্যন্ত রাজধানীতে মাদকবিরোধী অভিযানে ৩০০ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত নজরুল ইসলাম কাজী ওরফে নজু শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীদের একজন। নজু সর্দার ছাড়াও রাজধানীর দক্ষিণখানে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত মো. সুমন মিয়া ওরফে খুকু সুমন বড় ব্যবসায়ী।

গতকাল মঙ্গলবার কড়াইল বস্তির এরশাদ মাঠে বসে কথা হচ্ছিল এলাকার লোকজনের সঙ্গে। কাছেই কড়াইল বস্তির জামাইবাজার এলাকা। স্থানীয় একজন বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কড়াইল বস্তির ভেতরে জামাইবাজার অংশে অন্তত দুজন বড় ব্যবসায়ী আছেন। একজন রীতিমতো অফিস বসিয়েছেন। তাঁকে পাহারা দেন ২০-৩০ জন উঠতি বয়সের তরুণ। এই প্রতিবেদকের অনুরোধে তিনি ওই অফিস ও বস্তির ভেতরে মাদক ব্যবসায়ীর বাড়ি দেখিয়ে দেন। অফিসের দেয়ালে নতুন চুনকাম লেগেছে। সামনে সব সময় কেউ না কেউ পায়চারি করে। গতকালও কয়েকজনকে পায়চারি করতে দেখা যায়। তারা সবাই ‘সেলস ম্যান’ (বিক্রয়কর্মী) বলে জানান ওই ব্যক্তি। আগে বেশ কয়েকবার এই ব্যবসায়ী গ্রেপ্তার হলেও এ দফায় তিনি গ্রেপ্তার এড়াতে পেরেছেন। ওই বাসিন্দা আরও এক ব্যবসায়ীর নাম জানান। তিনি ক্ষমতাসীন দলের একজন নেতার ভাই। বউবাজার অংশেও এমন কয়েকজন ব্যবসায়ী আছেন বলে জানান তিনি। জামাইবাজারের আরও কয়েকজন বাসিন্দাও এসব ব্যবসায়ীর কথা জানেন। তবে তাঁরা ভয়ে কিছু বলতে চান না। পুলিশকে জানিয়েছেন কি না এমন প্রশ্নে তাঁরা বলেন, এর আগে দু-একবার মাদকসহ ধরিয়ে দিয়েছেন। কয়েক দিন পর এলাকায় ফিরে এসে তাঁরাই উল্টো হুমকি-ধমকি দেন, প্রশাসনের লোকের সঙ্গে ওঠবস করেন। তাঁরা সাহস পান না। এলাকাবাসীর দাবি, কড়াইলে যাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাঁরা ছোটখাটো বিক্রেতা ও মাদকসেবী।

পুলিশের অভিযানে এই ব্যবসায়ীরা ধরা পড়েননি কেন? জানতে চাইলে বস্তির আরেকজন বাসিন্দা বলেন, ‘অভিযানটা করার দরকার আছিল আচমকা। পুলিশ আইসে, বৈঠক করসে। মাদক ব্যবসায়ীরা কি বইসা থাকব ধরা খাওনের লাইগা? পলায়া গ্যাছে। বাকিদের মোবাইলে খবর দিয়া দিসে।’

অভিযানের ফল খুব সন্তোষজনক নয়। ছবি: প্রথম আলো
অভিযানের ফল খুব সন্তোষজনক নয়। ছবি: প্রথম আলো

শুক্রবার রাতে পুলিশ ও শনিবার র‍্যাব রাজধানীর বড় মাদকের আখড়া জেনেভা ক্যাম্পে অভিযান চালায়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তালিকায় জেনেভা ক্যাম্পের ৪৯ জন বিক্রেতার নাম আছে। এখানকার মূল জোগানদাতা ইশতিয়াক, তাঁর প্রধান সহযোগী নাদিম ওরফে পঁচিশ। দুজনের কাউকেই গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ ও র‍্যাব।

জেনেভা ক্যাম্পের একজন প্রবীণ বাসিন্দা প্রথম আলোকে বলেন, ‘অভিযানে যাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাঁরা কি আর বড় কোনো ব্যবসায়ী? যাঁরা বড় ড্রাগ ডিলার, তাঁরা গাড়িতে করে আসেন। কাজবাজ করে চলে যান। তাঁদের না ধরতে পারলে লাভ কী আতঙ্ক সৃষ্টি করে?’ তিনি আরও বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান চালানোর দরকার আছে। কিন্তু কেউ যেন হয়রানি না হয়, সেদিকেও নজর দেওয়া উচিত।

রোববার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে বিপুলসংখ্যক পুলিশ ডগ স্কোয়াড নিয়ে অভিযান চালায়। তেজগাঁও থানার একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, অভিযানে তাঁর থানার সব সদস্যের বাইরে ৬০০ জন অংশ নেন। ফল খুব সন্তোষজনক নয়। ওই কর্মকর্তার মতে, আগে রেললাইনের ঝুপড়িগুলোতে মাদকের আসর বসত, বেচাকেনাও হতো। কয়েক মাস ধরে ধারাবাহিক অভিযানে পরিস্থিতি এখন মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে। একেবারে মাদক নির্মূল হয়ে যায়নি, তবে পরিস্থিতি আগের তুলনায় ভালো। এত বিরাট ফোর্স নিয়ে অভিযান করার কোনো প্রয়োজন ছিল বলে মনে করেন না তিনি।

মাদকবিরোধী অভিযানে যুক্ত আছেন ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগের এমন একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, মাদকের ব্যবসাটা যদি শুধু মাদক ব্যবসায়ীরা করতেন, তাহলে অভিযানটা সহজ হতো। এই ব্যবসার চক্রটা বিশাল। স্বল্প মেয়াদে এই অভিযানটা হয়তো কাজে আসবে। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে এ ধরনের অভিযানে মাদক নির্মূল করা যাবে না।