জাতীয় নির্বাচন মাথায় রেখে আ.লীগ-বিএনপির হিসাব

>
  • আগামী ৩০ জুলাই রাজশাহী, সিলেট ও বরিশাল সিটিতে নির্বাচন।
  • ২৬ জুন হবে গাজীপুর সিটি নির্বাচন।
  • নির্বাচনগুলোতে আ.লীগ দেখাতে চায়, উন্নয়নের কারণে মানুষ তাদের সঙ্গে।
  • বিএনপি জনপ্রিয়তা প্রমাণ ছাড়াও সরকার ও ইসির মুখোশ উন্মোচন করতে চায়।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি—দুই দলই মনে করছে, আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলোর প্রভাব পড়বে আগামী জাতীয় নির্বাচনে। তাই জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হিসাব মাথায় রেখে সিটি নির্বাচনের পরিকল্পনা সাজাচ্ছে প্রধান দুই দল।

জাতীয় নির্বাচনের আগমুহূর্তে বড় শহরগুলোর এই নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ দেখাতে চায়, উন্নয়নের পক্ষে মানুষ তাদের সঙ্গে আছে। এ ক্ষেত্রে খুলনার নির্বাচনের কৌশল কাজে লাগাতে চায় দলটি। অন্যদিকে বিএনপি মনে করছে, তাদের সামনে জনপ্রিয়তা প্রমাণের সুযোগ যেমন আছে, তেমনি সরকার ও নির্বাচন কমিশনের (ইসি) মুখোশ উন্মোচনেরও সুযোগ আছে।

অবশ্য বিএনপির কেউ কেউ মনে করছেন, বর্তমান ইসির অধীনে সামনের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে যাওয়ার বিষয়ে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। তবে দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের বড় অংশ কঠিন পরিস্থিতিতেও স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে থাকার পক্ষে। খুলনার মতো নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন হবে-এটা ধরে নিয়েই তাঁরা নির্বাচনে থাকতে চান। এই অংশটি মনে করছে, সে রকম নির্বাচন হলে সরকার ও ইসি আরও বেশি প্রশ্নবিদ্ধ হবে।

আগামী ৩০ জুলাই অনুষ্ঠিত হবে রাজশাহী, সিলেট ও বরিশাল সিটি করপোরেশনের নির্বাচন। এই তিন নির্বাচনের আগে ২৬ জুন হবে গাজীপুর সিটি নির্বাচন। এসব নির্বাচন শেষ হলেই আগস্ট থেকে জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতিতে নামবে ইসি।

নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১৫ মে খুলনা সিটি নির্বাচনে জয় পান আওয়ামী লীগের প্রার্থী। সংঘর্ষে না গিয়ে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রেখে, প্রশাসনকে ব্যবহার করে এবং প্রতিপক্ষকে চেপে ধরে ভোট নেওয়ার কৌশল দেখা গেছে এই নির্বাচনে। একইভাবে খুলনার নির্বাচনে ইসির দুর্বলতাও প্রকাশ পেয়েছে। তাঁদের মতে, এরপর আবার ক্ষমতাসীনদের দাবির মুখে সাংসদদের নির্বাচনী প্রচারে অংশ নেওয়ার সুযোগ দিয়ে সিটি নির্বাচন আচরণ বিধিমালা সংশোধনের উদ্যোগে ইসি সমালোচিত হচ্ছে। এই অবস্থায় জাতীয় নির্বাচনের আগে চার সিটির নির্বাচন হবে ইসির জন্যও বড় পরীক্ষা।

বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সূত্র জানায়, স্থানীয় সরকার নির্বাচন প্রশ্নে দলটির অবস্থান হচ্ছে, সব স্থানীয় সরকার নির্বাচনে তারা অংশ নেবে। দলটি মনে করে, নির্বাচনের ফল যা-ই হোক, বিএনপি লাভবান হবে। কারণ, বর্তমান প্রেক্ষাপটে নির্বাচন মোটামুটি সুষ্ঠু হলেও তাদের প্রার্থী জয়ী হবেন, এতে জনসমর্থন প্রমাণিত হবে। আর সরকারি দল জবরদখল করলে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের মুখোশ উন্মোচিত হবে।

তবে খুলনা সিটি নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে বিএনপির আশঙ্কা, সামনের সিটি নির্বাচনগুলোতে ক্ষমতাসীনেরা আরও বেশি নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন করতে চাইবে। এই অবস্থায় বিএনপির কেউ কেউ মনে করছেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে অংশ নেওয়ার বিষয়েও নতুন করে চিন্তা করার সময় এসেছে। দলটির কোনো কোনো নেতা বলছেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে চার সিটি নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ায় বিএনপির প্রার্থীরা জয়ী হয়েছিলেন। এবার নির্বাচন প্রশ্নে সরকার আরও কঠোর। এই অবস্থায় গাজীপুর সিটি নির্বাচনকে ইসির শেষ পরীক্ষা হিসেবে নিতে চায় বিএনপির একটি অংশ। তারা এই নির্বাচনের ভালোমন্দের ওপর পরের তিন সিটির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পক্ষে।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, এটা সত্য যে দলে একেকজনের একেক ধরনের মত আছে। কাল শুক্রবার তাঁরা তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে বৈঠক করবেন। সে বৈঠকে সবার মতামতের ভিত্তিতে নির্বাচনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।

তবে দলটির নীতিনির্ধারকদের বড় অংশ যেকোনো পরিস্থিতিতে স্থানীয় নির্বাচনে থাকার পক্ষে। তাদের যুক্তি হচ্ছে, নির্বাচনে থাকলে দল আলোচনায় থাকবে, মানুষের কাছে যাওয়ার সুযোগ থাকবে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হচ্ছে যে এই সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হয় না, হবে না। পুলিশ-প্রশাসন ও দলের প্রভাবশালীদের দিয়ে নির্বাচন হবে, সেটা খুলনায় প্রমাণ হয়েছে। সামনে জাতির সামনে আরও প্রমাণ মিলবে।

আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, খুলনা সিটি নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ আগের চেয়ে বেশি আত্মবিশ্বাসী। তারা মনে করছে, ভালো প্রার্থী দিয়ে, নেতা-কর্মীরা ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে থাকলে এবং বিএনপিকে কিছুটা চাপে রাখা গেলে জয়ী হওয়া সম্ভব। একাধিক নেতা প্রথম আলোকে বলেন, সরকার টানা দুই মেয়াদে অনেক উন্নয়নকাজ করেছে। তারা দেশে-বিদেশে দেখাতে চায়, উন্নয়নের পক্ষে মানুষ তাদের সঙ্গে আছে। তাঁদের মতে, আর সিটি নির্বাচনগুলোতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা হেরে গেলে চাপে থাকা বিএনপির নেতা-কর্মীরা চাঙা হবেন। ক্ষমতাসীনদের জনপ্রিয়তা নেই-বিএনপির এই দাবিও প্রতিষ্ঠিত হবে। আওয়ামী লীগ এটি হতে দিতে চায় না।

আওয়ামী লীগের সূত্র জানায়, দলটি মনে করছে, খুলনা সিটি নির্বাচনের কৌশল ও ফলাফল তাদের জন্য আগামী নির্বাচনের কৌশল প্রণয়ন সহজ করে দিয়েছে। খুলনার মতো এই তিন সিটিতেও বিএনপির নেতা-কর্মীদের অনেকের নামে মামলা আছে। এতে নির্বাচনের মাঠ নিজেদের দখলে রাখা আওয়ামী লীগের জন্য আরও সহজ হবে।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খান প্রথম আলোকে বলেন, স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচনগুলোর জন্য আওয়ামী লীগ আরও আগে থেকেই প্রস্তুতি নিচ্ছে। এসব জায়গায় জরিপ করে প্রার্থীদের কার কী অবস্থান তা পাওয়া গেছে। তিনি বলেন, জনগণ তাঁদের তিনটি কারণে ভোট দেবে। প্রথমত, মানুষ বুঝেছে নৌকায় ভোট দিলেই তাদের উন্নয়ন নিশ্চিত হবে। দ্বিতীয়ত, মানুষ দেখেছে অন্য দলে ভোট দিলে তারা উন্নয়ন বাদ দিয়ে দলীয় রাজনীতিতেই ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তৃতীয়ত, অতীতে বিএনপি ক্ষমতায় ছিল, কিন্তু কোনো উন্নয়ন করতে পারেনি। তাদের সে সক্ষমতাও নেই।

বিএনপির একাধিক নেতা জানান, বিকল্পধারা, গণফোরাম, জেএসডি, নাগরিক ঐক্যসহ ২০-দলীয় জোটের বাইরের কিছু রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আগামী সংসদ নির্বাচনকেন্দ্রিক সমঝোতায় পৌঁছানোর চেষ্টা আছে। গাজীপুর সিটি নির্বাচনের মধ্য দিয়েই এটা শুরু করতে চায় বিএনপি। কয়েকটি দলেরও এ বিষয়ে আগ্রহ আছে। তবে সমঝোতা হবে কি না, তা এখন পর্যন্ত নিশ্চিত নয়।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, দলগুলো নির্বাচনে জয়ী হতে নানা চেষ্টা করবে। কিন্তু ইসির দায়িত্ব হলো কেউ যেন কারচুপি বা অন্যায় করতে না পারে এবং সবাই সমান সুযোগ পায়, তা নিশ্চিত করা। তিনি বলেন, রংপুর সিটি নির্বাচনের মাধ্যমে ইসি আস্থা অর্জন করেছিল। কিন্তু খুলনায় নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচনগুলোর মাধ্যমে আস্থাহীনতা দূর করতে ইসির পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি বলে মত দেন তিনি।