গোলাপ, ময়ূর, করলা, বেলপাতার নকশার বাহারি জামদানি

কলকা, গোলাপ, ময়ূর, করলা, বেলপাতা, কাউয়ার ঠেংগি, মন্দিরসহ নানা নকশার জামদানি শাড়ির পসরা বসেছে জাতীয় জাদুঘরের নলিনীকান্ত ভট্টশালী গ্যালারিতে। করলা পাড়ের দুই দিকে দুই রঙের সুতার গঙ্গা-যমুনা শাড়ির দিকেও ক্রেতাদের নজর। কোনো শাড়ির দাম পাঁচ হাজার টাকা, আবার কোনো শাড়ির দাম ২ লাখ ২০ হাজার টাকা। তবে দেড় থেকে দুই লাখের বেশি দামের শাড়িগুলোর কারিগরেরা দাবি করলেন, এগুলো তাঁদের মনগড়া নকশার শাড়ি। আরেক তাঁতি কোনোভাবেই এ শাড়ি নকল করতে পারবেন না।

জাতীয় জাদুঘরে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র কুটিরশিল্প করপোরেশন (বিসিক) ৩৩টি স্টল নিয়ে এ জামদানি শাড়ির প্রদর্শনী ও মেলার আয়োজন করেছে। ২৯ মে থেকে শুরু হওয়া এ প্রদর্শনী চলবে আগামী ৭ জুন পর্যন্ত। সকাল সাড়ে ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত এ প্রদর্শনী সবার জন্য উন্মুক্ত।

মেসার্স মীম জামদানির সেলিম বললেন, ‘সাত বছর বয়স থেইক্যা দাদা, বাবা, বড় ভাইদের সঙ্গে কাজ শিখছি। পড়ালেহা করি নাই। এখন জামদানি সেলিমের নাম সবাই একনামে চিনে। আমার মনগড়া ডিজাইনে ২ লাখ ২০ হাজার টাকা দামের শাড়িও আছে। এক শাড়ি বানাইতেই সময় লাগছে এক বছর। চ্যালেঞ্জ, এই শাড়ি আর কেউ বানাইতে পারবে না।’
মেসার্স মীম জামদানির স্টোরে এ দামি শাড়িগুলো ডিসপ্লেতে রাখা হয়নি। প্রতিবেদক দেখতে চাইলে একটা একটা করে বের করে দাম জানান, কোনোটা ১ লাখ ৭০ হাজার তো আরেকটা ৬০ হাজার। দামি শাড়ির দাম ৩২ হাজার টাকা থেকে শুরু। সেলিম জানালেন, রাজধানীর বিভিন্ন বিপণিবিতানে এই শাড়িগুলোই বিক্রি হবে ৩০ শতাংশ বেশি দামে।

আজিজুল জামদানি ঘরের একজন কারিগর বললেন, শখের তোলা ৮০ হাজার, আর জামদানি তো শখের জিনিস, ৮৫ হাজার টাকার জামদানি কেনার ক্রেতাও আছে।
অবসরপ্রাপ্ত কলেজশিক্ষক রোকেয়া বেগম এবং তাঁর আইনজীবী স্বামী ইউসুফ তপাদার দীর্ঘক্ষণ ধরে এক স্টল থেকে আরেক স্টলে গিয়ে শাড়ি দেখছিলেন। রোকেয়া বেগম জানালেন, তাঁদের বিয়ে হয়েছে ১৯৬৮ সালে। স্বামী তাঁর পছন্দ ও রুচি বুঝতে পারেন। শাড়ি কেনার সময় বেশির ভাগ সময়ই স্বামীর পছন্দ করে দেওয়া শাড়ি কেনা হয়। সংগ্রহের তালিকায় আছে বেশ কয়েকটি জামদানি শাড়ি। প্রদর্শনীতে একটি জামদানি শাড়ি পরে এসেছেন। জানালেন, জামদানি শাড়ি যত্ন করে রাখলে দীর্ঘদিন ভালো থাকে। পরতে আরাম। আর ঐতিহ্য তো আছেই।

ইউসুফ তপাদার বললেন,‘ আমরা যে খুব বেশি কেনাকাটা করি তা না, তবে সব সময় ভালো জিনিসটা কিনতে চেষ্টা করি। জামদানি প্রদর্শনীতে ভালো শাড়িগুলোই পাওয়া যায়।’
এক শাড়ি দেখে রোকেয়া বেগম বলছিলেন, আঁচলের কলকাটা একটু ছোট হলে ভালো লাগত। তখন জামদানির কারিগর বললেন, আপনি অর্ডার দিলে আপনার পছন্দ অনুযায়ী শাড়ি বানিয়ে দেওয়া যাবে।

এবার পঞ্চমবারের মতো জামদানি প্রদর্শনী ও মেলার আয়োজন করা হলো। প্রতিবারই জাতীয় জাদুঘরেই অনুষ্ঠিত হয়েছে।
বিসিকের বিপণন বিভাগের মান নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা রোকেয়া বেগম জানালেন, জামদানির কারিগরেরা চান, ঈদের আগেই যাতে এ প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। বেশি বিক্রি হলে অনেকে কিছুটা কম দামে হলেও শাড়ি বিক্রি করে দেন। এখানে মেলায় অংশ নেওয়া তাঁতিরা এসেছেন বিসিকের নারায়ণগঞ্জের নোয়াপাড়া গ্রামের জামদানি শিল্প নগরী থেকে। ফলে নকল পণ্য বিক্রির সুযোগ নেই। সার্বক্ষণিক নজরদারি করা হয়, যাতে কোনো স্টলে মেশিনে বোনা জামদানি কেউ বিক্রি করতে না পারে।

একজন ক্রেতা কীভাবে বুঝবেন তাঁর কেনা জামদানিটি নকল—এ প্রশ্নের উত্তরে রোকেয়া বেগম জানালেন, নকল জামদানিতে শাড়ির পেছন দিকের সুতাগুলো টান দিলে হাতে ওঠে আসবে, কিন্তু তাঁতে হাতে বোনানো জামদানি শাড়ির সুতা টান দিলে বের হবে না।

জামদানি প্রদর্শনীতে জামদানি কাজের পাঞ্জাবি, ওয়ান পিছ জামা এবং থ্রি পিছও পাওয়া যাচ্ছে বিভিন্ন দামে। বিসিকের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, মঙ্গলবার উদ্বোধনী দিনে বিক্রি হয়েছে ১৮টি শাড়ি ও পাঞ্জাবি। আর বুধবার বেলা তিনটা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে ২৭টি শাড়ি, থ্রিপিস। তবে শাড়ির সংখ্যাই বেশি। গত বছর বিসিকের জামদানি প্রদর্শনী থেকে বিক্রি হয়েছিল প্রায় ৮০ লাখ টাকার পণ্য।

জাদুঘর প্রাঙ্গণেই জামিনা জামদানি উইভিং ফ্যাক্টরির সবুজ মিয়ার মোট ১০টি তাঁত। কয়েক মাস ধরে জাদুঘর কর্তৃপক্ষের আমন্ত্রণে সবুজ মিয়া একটি তাঁত নিয়ে বসেন জাদুঘর প্রাঙ্গণেই শণের ছাউনি দিয়ে তৈরি একটি ঘরে। সবুজ মিয়া জানালেন, ২৫ বছর ধরে তিনি জামদানি বোনেন। এখানে এসে কেউ শাড়ি অর্ডার দিতে চাইলে দিতে পারেন, আবার তৈরি শাড়িও কেউ চাইলে কিনতে পারেন। ঐতিহ্যবাহী জামদানি শাড়ি টিকিয়ে রাখার জন্যই জাদুঘর এ উদ্যোগ নিয়েছে। জাদুঘরের দর্শনার্থীরা সুযোগ পেলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেন সবুজ মিয়ার জামদানি বুনন।