ঢাকা সিটিতে নির্বাচনের তিন বছর পর সংস্কার হচ্ছে মাঠ-পার্ক

মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডের তাজমহল পার্ক ও খেলার মাঠের উন্নয়নকাজ শুরু করেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। ছবিটি সম্প্রতি তোলা।  প্রথম আলো
মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডের তাজমহল পার্ক ও খেলার মাঠের উন্নয়নকাজ শুরু করেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। ছবিটি সম্প্রতি তোলা। প্রথম আলো


ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মেয়রের অন্যতম নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল পার্ক ও খেলার মাঠ উন্নয়ন। নির্বাচনের পর গত তিন বছরে এ ক্ষেত্রে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি হয়নি। তবে দেরিতে হলেও ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন পার্ক ও খেলার মাঠ উন্নয়নে দুটি আলাদা প্রকল্পের কাজ শুরু করেছে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ২৮০ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘উন্মুক্ত স্থানসমূহের আধুনিকায়ন, উন্নয়ন ও সবুজায়ন’ প্রকল্পের আওতায় ২৬টি পার্ক ও খেলার মাঠের উন্নয়নের কাজ শুরু করেছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনও প্রায় ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘জল সবুজে ঢাকা’ প্রকল্পের আওতায় ৩১টি পার্ক ও মাঠের উন্নয়নকাজ করছে। এই প্রকল্পগুলোতে অর্থায়ন করেছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।

পরিবেশবাদীরা বলছেন, রাজধানীতে প্রয়োজনের তুলনায় খোলা, সবুজ জায়গা খুবই কম। বিদ্যমান পার্ক ও খেলার মাঠগুলোর উন্নয়নের এখনো সুযোগ রয়েছে। সবার আগে এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। আর এগুলোর উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ১৯৯৫ সালের ঢাকা মহানগর উন্নয়ন পরিকল্পনা (ডিএমডিপি) অনুযায়ী সে সময় মাথাপিছু সবুজ পরিসরের পরিমাণ ছিল শূন্য দশমিক ৫ বর্গমিটার। ২০০৯ সালে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) পর্যালোচনায় দেখা যায়, ঢাকায় মাথাপিছু সবুজ পরিসরের পরিমাণ মাত্র শূন্য দশমিক ০৫২ বর্গমিটার। পার্ক ও গণপরিসরের অপর্যাপ্ততা ঢাকার একটি বড় সমস্যা। দুই সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, ঢাকা শহর বর্তমানে পৃথিবীর অন্যতম জনবহুল মহানগরী। অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং উন্মুক্ত স্থান কমার কারণে শহরের সবুজের সমারোহ দিন দিন কমে যাচ্ছে। প্রকল্প দুটি বাস্তবায়িত হলে শিশুদের মানসিক বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি হবে। নাগরিকদের সুস্থ পরিবেশে অবসর সময় কাটানোর সুযোগ তৈরি হবে।

২০১৬ সালে ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ (ডব্লিউবিবি) ট্রাস্ট পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, পরিবেশের দুরবস্থার কারণে রাজধানীর ৪১ শতাংশ বাসিন্দা পার্ক ও মাঠে যান না। নিরাপত্তার অভাবে পার্কে যান না ৩৫ শতাংশ বাসিন্দা। আর ৩৪ শতাংশ বাসিন্দা মনে করেন, পার্ক ও খেলার মাঠগুলোর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা খারাপ। 

উত্তর সিটি করপোরেশন

ডিএনসিসির অধীনে কাগজে-কলমে ২২টি পার্ক আছে। দীর্ঘদিন ধরে পার্কগুলো পড়ে আছে অযত্নে। পার্ক ঘিরে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন দোকান। বসার জায়গা নেই বা থাকলেও বেঞ্চ ভাঙা। পার্কগুলো হয়ে উঠেছে ভবঘুরে ও মাদকাসক্তদের আশ্রয়স্থল।

পার্ক ও মাঠগুলোর উন্নয়নে ২০১৭ সালে ‘ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের উন্মুক্ত স্থানসমূহের আধুনিকায়ন, উন্নয়ন ও সবুজায়ন’ প্রকল্প নেওয়া হয়। এর  আওতায় ২২টি পার্ক ও ৪টি মাঠের উন্নয়ন করা হবে। ডিএনসিসি সূত্র জানায়, চারটি পার্কের কাজ শুরু হয়েছে। বাকি ১৮টির নকশা তৈরি হচ্ছে।

মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডের সি-ব্লকের তাজমহল রোড পার্কের উন্নয়নকাজ শুরু হয়েছে। ১৯৯৭ সালে পার্কটি করার পর আর সংস্কার হয়নি। গতকাল বৃহস্পতিবার গিয়ে দেখা যায়, পার্কের চারপাশ টিন দিয়ে ঘেরা। ভেতরে শ্রমিকেরা কাজ করছেন। ফোয়ারা বসানোর জন্য মাঝখানে গর্ত খোঁড়া হয়েছে। শ্রমিকেরা পার্কের প্রবেশমুখ নির্মাণের কাজ করছেন।

স্থানীয় বাসিন্দা আকবর আলী বলেন, দীর্ঘদিন পার্কটি অযত্নে পড়ে ছিল। আবাসিক এলাকার ভেতর প্রাকৃতিক পরিবেশের এই পার্কটি নতুন করে সাজালে পরিবার নিয়ে লোকজন আসতে পারবে। তবে এটি ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে।

পার্ক রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রে স্থানীয় বাসিন্দাদের যুক্ত করা জরুরি বলে মনে করেন ডিএনসিসির প্যানেল মেয়র মো. ওসমান গণি। তিনি বলেন, পার্কের নকশা তৈরির ক্ষেত্রেও স্থানীয় লোকজনের মতামত নেওয়া হয়েছে। স্থানীয় লোকের অংশগ্রহণ ছাড়া স্থাপনার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা কঠিন। পার্কগুলোর ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার ক্ষেত্রে তাদের যুক্ত করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হবে।

দক্ষিণ সিটি করপোরেশন

ডিএসসিসির প্রকৌশল দপ্তর সূত্র জানায়, ‘জল সবুজে ঢাকা’ প্রকল্পে ১৯টি পার্ক ও ১২টি মাঠ সংস্কারে উদ্যোগ নিয়েছে ডিএসসিসি। এর মধ্যে ২৯টি পার্ক ও মাঠের সংস্কারকাজ শুরু হয়েছে।

গত বছরের ৮ আগস্ট লালবাগের শহীদ আবদুল আলীম খেলার মাঠ ও রসুলবাগ পার্কের সংস্কারকাজ উদ্বোধন করা হয়। গতকাল বৃহস্পতিবার দেখা যায়, শহীদ আবদুল আলীম খেলার মাঠের ভেতর কংক্রিটের বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি করা হচ্ছে। মাঠের ভেতর ইট-পাথর ও বালু স্তূপ করে রাখা। তবে কোনো নির্মাণশ্রমিককে কাজ করতে দেখা যায়নি।

লালবাগের ঢাকেশ্বরী রোডের বাসিন্দা আশরাফুল ইসলাম বলেন, শ্রমিকেরা একদিন কাজ করলে তিন দিন তাদের দেখা যায় না। কাজ খুবই ধীরগতিতে চলছে। এর মধ্যে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বৃষ্টি হওয়ায় কাজের গতি আরও কমে গেছে।

জানতে চাইলে ডিএসসিসির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আসাদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, আগামী বছরের জুনের মধ্যে এই প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা। বৃষ্টিতে কাজে কিছুটা বিঘ্ন ঘটছে। দুই সিটি করপোরেশনই পার্ক উন্নয়নে প্রাধান্য দিয়েছে প্রকৃতিকে। সংস্কার হওয়া পার্কগুলোতে থাকবে হাঁটাপথ, আলাদা সাইকেল লেন, শিশুদের খেলার জায়গা, নারীদের জন্য বিশেষ স্থাপনা, ব্যায়ামাগার, নামাজের স্থান, খাবারের দোকান ও পাঠাগার।

পার্ক ও খেলার মাঠ উন্নয়ন নিয়ে কাজ করছেন বেসরকারি সংগঠন ডব্লিউবিবি ট্রাস্টের কর্মসূচি ব্যবস্থাপক মারুফ হোসেন। তিনি বলেন, শেষ পর্যন্ত নগরের পার্ক ও খেলার মাঠগুলোর উন্নয়ন শুরু হয়েছে। বাসার কাছাকাছি ছিমছাম, সুন্দর পার্ক হলে এলাকাবাসী সময় কাটাতে সেখানে বেশি বেশি যাবেন। পার্ক ও মাঠগুলোর সংস্কার করা হলে এবং রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করলে সব বয়সীরা এগুলো ব্যবহার করতে পারবে।

ডিএনসিসি

২৮০ কোটি টাকার প্রকল্প, ২২টি পার্ক ও ৪টি খেলার মাঠ উন্নয়ন।

ডিএসসিসি

২০০ কোটি টাকার প্রকল্প, ১৯টি পার্ক ও ১২টি খেলার মাঠ উন্নয়ন।

পরিবেশের দুরবস্থার কারণে রাজধানীর ৪১ শতাংশ বাসিন্দা

পার্ক ও মাঠে যান না।

নিরাপত্তার অভাবে পার্কে যান না

৩৫ শতাংশ বাসিন্দা।

সূত্র : ডব্লিউবিবি ট্রাস্ট

ঢাকায় মাথাপিছু সবুজ পরিসরের পরিমাণ মাত্র ০.০৫২ বর্গমিটার। 

সূত্র: ২০০৯ সালের িবশদ অঞ্চল পরিকল্পনা।