নিয়োগকর্তারা কেন পার পেয়ে যান?

ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সৌদি আরব থেকে নির্যাতনের শিকার হয়ে ফেরত আসা কয়েকজন নারী। ছবি: প্রথম আলো
ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সৌদি আরব থেকে নির্যাতনের শিকার হয়ে ফেরত আসা কয়েকজন নারী। ছবি: প্রথম আলো
>
  • সৌদিতে তিন বছরে প্রায় দুই লাখ নারী কর্মী গেছেন
  • ফেরত এসেছেন প্রায় ছয় হাজার
  • অভিযোগের সংখ্যা সাড়ে তিন হাজার
  • নির্যাতন, ধর্ষণসহ গুরুতর অভিযোগ
  • নিয়োগকর্তার বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির দৃষ্টান্ত নেই
  • নারী গৃহকর্মীদের ওপর নির্যাতন ঠেকানো যাচ্ছে না

গত তিন বছরে সৌদি আরবে বাংলাদেশ দূতাবাসে দেশটিতে নানাভাবে নির্যাতনের শিকার বাংলাদেশি নারী কর্মীদের সাড়ে তিন হাজার অভিযোগ এসেছে। এসব ঘটনায় সৌদি নিয়োগকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। অবশ্য দূতাবাস ১২-১৩ জন নিয়োগকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থা বলছে, এ রকম তথ্য তাদের জানা নেই। 

সৌদি আরবে বাংলাদেশ দূতাবাস, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি), বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সি (বায়রা), ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডসহ বেসরকারি সংস্থাগুলোয় বিচ্ছিন্নভাবে নারী কর্মীরা এসব অভিযোগ করেছেন। অভিযোগের সংখ্যা তিন বছরে সাড়ে তিন হাজার থেকে পাঁচ হাজার বলে জানা গেছে। শারীরিক নির্যাতন ছাড়াও জোরপূর্বক যৌনকাজে নিযুক্ত করা, গৃহকর্তার মাধ্যমে ধর্ষণের শিকার হওয়া, অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়া, শারীরিক-মানসিক নির্যাতন সহ্য করতে না পরে আত্মহত্যার চেষ্টা করার মতো গুরুতর অভিযোগও আছে।

সৌদি আরবে নারী কর্মী নির্যাতনের বিরুদ্ধে ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তায় নারীদের বিক্ষোভ। ছবি: এএফপি
সৌদি আরবে নারী কর্মী নির্যাতনের বিরুদ্ধে ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তায় নারীদের বিক্ষোভ। ছবি: এএফপি

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, সৌদি কর্তৃপক্ষের কাছে নিয়োগকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ জানানোর ঘটনা খুবই কম ঘটে। মামলাও হয় না। নারী গৃহকর্মীদের সুরক্ষা দেওয়ার বিষয়টি সেখানে প্রাধান্য পায় না। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, যেসব নারী কর্মী নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, তাঁরা কেউ মামলা করতে রাজি হন না। তাঁরা মানসিকভাবে এতটাই বিপর্যস্ত, মামলা চালানোর জন্য সেখানে উপস্থিত থাকতে চান না। যত দ্রুত সম্ভব দেশে পরিবারের কাছে ফিরতে চান। আর বিচারহীনতার এই সুযোগ নিচ্ছে সৌদি নিয়োগকর্তারা। সৌদি নিয়োগকর্তার বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির দৃষ্টান্ত না থাকায় সেখানে নারী গৃহকর্মীদের ওপর নির্যাতন ঠেকানো যাচ্ছে না।

নারীদের অভিযোগের ব্যাপারে বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অভিযোগগুলো বিচ্ছিন্নভাবে সংস্থাগুলো দেখছে। এটার জন্য কোনো একক প্ল্যাটফর্ম নেই। অভিযোগ গ্রহণ ও ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে বড় ধরনের সমন্বয়হীনতা ও নজরদারির অভাব রয়েছে।

সৌদি আরবে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গোলাম মসিহ মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরবে গত তিন বছরে দুই লাখের মতো নারী কর্মী এসেছেন। এর মধ্যে দেশে ফেরত গেছেন প্রায় ছয় হাজার। তাই এ ক্ষেত্রে সফলতার হারই বেশি। এরপরও একজনও নারী কর্মীর ওপর নির্যাতন হোক, সেটা আমরা চাই না।’

গোলাম মসিহ বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখেন। তাঁর নির্দেশে নারী কর্মীদের সুরক্ষার জন্য সেফহোমে আশ্রয় দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অভিযোগগুলোকে চিহ্নিত করা হচ্ছে। কোনো কর্মীর নিয়োগকর্তার কাছে টাকা পাওনা থাকলে তা আদায় করে দিচ্ছে দূতাবাস। চিকিৎসার প্রয়োজন হলে তাতে সহায়তা করা হচ্ছে। আইনি সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।

দূতাবাসে তিন বছরে সাড়ে তিন হাজার অভিযোগ 
সৌদি আরবে বাংলাদেশের দূতাবাসের হিসাবে, নারী কর্মীদের কাছ থেকে আসা অভিযোগের সংখ্যা সাড়ে তিন হাজার। তবে সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো বলছে, অভিযোগের সংখ্যা সাড়ে চার থেকে পাঁচ হাজার। সৌদি আরবে গত তিন বছরে প্রায় দুই লাখ নারী কর্মী গেছেন। আর ফেরত এসেছেন প্রায় ছয় হাজার।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, নারী কর্মী পাঠানোর জন্য রাতারাতি বেড়ে যাওয়া রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোও নির্যাতনের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার জন্য দায়ী। তারা গ্রাম থেকে নারী কর্মী সংগ্রহ করে কোনো প্রশিক্ষণ ছাড়াই পাঠিয়ে দেয় নিয়োগকর্তার কাছে। কাজের ধরন ও ভাষা না বোঝার কারণে ওই নারীরা হরহামেশাই গৃহকর্তা-কর্ত্রীর কাছে মারধরের শিকার হন। চুক্তি অনুসারে দুই বছর কাজ না করলে জরিমানার শিকার হতে হয় বলে নির্যাতনের শিকার নারীরা ওই সব রিক্রুটিং এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলে তারা ফোন ধরে না।

প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, গত বছর ২ হাজার ৯০৬ জন নারী কর্মী নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়ে সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের সেফহোমে আশ্রয় নেন।

ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের মহাপরিচালক গাজী মোহাম্মদ জুলহাস প্রথম আলোকে বলেন, গত ডিসেম্বরে বোর্ডে প্রবাসী কর্মীদের অভিযোগ জমা নেওয়ার জন্য কলসেন্টার খোলা হয়। গত ছয় মাসে কলসেন্টারে ৯৪০টি অভিযোগ এসেছে। ৯৫ শতাংশ অভিযোগই এসেছে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। এর মধ্যে নারী কর্মীদের অভিযোগও রয়েছে। তাঁরা নানান নির্যাতনের অভিযোগ করে দেশে ফিরে আসতে চান। তাঁদের পরিবারগুলোও এখানে এসে জানতে চায় কীভাবে ফিরিয়ে আনা যাবে।

অভিযোগগুলো কোন প্রতিষ্ঠান থেকে সমন্বয় করা হয়, জানতে চাইলে গাজী মোহাম্মদ জুলহাস বলেন, প্রতিষ্ঠানগুলো যার যার মতো করে অভিযোগ রাখে, ব্যবস্থা নেয়।

জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) কর্মসংস্থান উইংয়ের পরিচালকের দায়িত্বে থাকা আতাউর রহমান বলেন, প্রতিনিয়তই অভিযোগ আসছে। গত সপ্তাহে ৮৪ জন ফেরত এসেছেন মধ্যপ্রাচ্য থেকে। তবে সব ক্ষেত্রেই নির্যাতনের কারণে গৃহকর্মীরা ফিরে আসেন—এমনটি মানতে রাজি নন তিনি। ওই কর্মকর্তা বলেন, লাখো কর্মী কাজ করেন, সেখানে কিছু কিছু ঘটনা ঘটতেই পারে। অভিযোগ এলে দূতাবাস থেকে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। অভিযোগ পাওয়ামাত্র দূতাবাসের সেফহোমে নেওয়া হয়। অনেক কর্মী সেখানে কাজের চাপ নিতে না পেরে এবং অনভ্যস্ততার কারণে ওই দেশের খাবার খেতে না পেরে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এ ছাড়া যথাযথ প্রশিক্ষণ না থাকায় তাঁরা ভাষা বোঝেন না, খাপ খাওয়াতে পারেন না। এ কারণে তাঁরা ফিরে আসতে চান।

বায়রার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শামীম আহমেদ চৌধুরী মনে করেন, বিদেশে বাংলাদেশের এত বড় কর্মসংস্থানের জায়গাটি শুধু মৌখিক অভিযোগের কারণে প্রশ্নবিদ্ধ করা যাবে না। তিনি বলেন, প্রতি মাসে ১২ থেকে ১৪ হাজার নারী কর্মী গৃহকর্ম, পোশাকশিল্প কারখানায় কাজ নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে যাচ্ছেন। এঁদের মধ্যে ৮০ শতাংশ নারীই ভালো আছে। উপার্জন করে পরিবারের সচ্ছলতা ফিরিয়ে এনেছেন। এ কারণে কোনো অভিযোগ এলে দূতাবাসের প্রথমেই উচিত হবে ঘটনা সঠিকভাবে তদন্ত করা।

সৌদিরা বাংলাদেশের নারী কর্মীদের কেন চান?

মধ্যপ্রাচ্যে নারী গৃহকর্মীদের অত্যাচার, নির্যাতন, ধর্ষণের অভিযোগের জের ধরে বিভিন্ন সময়ে ইন্দোনেশিয়া, কেনিয়া, নেপাল ও ফিলিপাইন সেখানে গৃহকর্মী পাঠানো নিষিদ্ধ করে। পরে কেনিয়া ও নেপাল নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। কুয়েতে গত দুই বছরে ফিলিপাইনের ১৯৬ নারী কর্মীকে হত্যা ও গত বছর ছয় হাজার নারী কর্মীকে শারীরিক ও যৌন নির্যাতন এবং ধর্ষণের অভিযোগ এনে এ বছর থেকে সেখানে নারী কর্মী পাঠানো নিষিদ্ধ করে ফিলিপাইন। এর প্রেক্ষাপটে নারী কর্মীদের সুরক্ষা ও পারিশ্রমিক বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য সৌদি আরবের সঙ্গে রীতিমতো দর-কষাকষিতে নামে দেশটি। শেষ পর্যন্ত ফিলিপাইন থেকে নতুন নারী কর্মী নেওয়ার ক্ষেত্রে সৌদি আরবই নিষেধাজ্ঞা জারি করে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, সৌদি আরবের জন্য নারী গৃহকর্মী পাওয়ার সবচেয়ে বড় উৎস ছিল ফিলিপাইন ও ইন্দোনেশিয়া। সে পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের দিকে ঝুঁকেছে দেশটি। বাংলাদেশ দর-কষাকষিতেও পিছিয়ে আছে। মাসে ২০ হাজার টাকা করে একেক গৃহকর্মীকে দেওয়ার কথা হলেও দেওয়া হচ্ছে ১৬ হাজার টাকা। একদিকে সস্তা শ্রম, অন্যদিকে সুরক্ষা নিয়ে কঠোর পদক্ষেপ না থাকায় বাংলাদেশ হয়ে পড়েছে নারী গৃহকর্মী সংগ্রহে ভালো উৎস।

এর আগে নারী কর্মীদের নানা নির্যাতনের শিকার হওয়ার ঘটনা প্রকাশ হতে থাকলে সমালোচনার মুখে সরকার এ বিষয়ে অনাগ্রহ দেখানো শুরু করে। এ ব্যাপারে একাধিক সূত্র প্রথম আলোকে জানায়, ২০১৫ সালে সৌদি সরকার বাংলাদেশ সরকারকে একপ্রকার চাপ প্রয়োগ করে নারী কর্মী পাঠাতে বাধ্য করে। তারা বলে দেয়, নারী কর্মী না পাঠালে পুরুষ কর্মী নেওয়া হবে না। মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলার অনুমতি না থাকায় সূত্রগুলো নাম প্রকাশে রাজি হয়নি।

আগে ২৯টি তালিকাভুক্ত রিক্রুটিং এজেন্সি পুরুষ কর্মী পাঠাত। নারী কর্মী পাঠানোর অতিরিক্ত চাপ সামাল দিতে রিক্রুটিং এজেন্সির সংখ্যা ২০১৫ সালে রাতারাতি বেড়ে ৫৫৯টি হয়। প্রতিটি রিক্রুটিং এজেন্সিকে এখন নারী কর্মী পাঠাতে হয়। 

অভিযোগ জমলেও পার পেয়ে যান সৌদি নিয়োগকর্তারা
গতকাল রোববার রাতে সৌদি আরব থেকে ফেরত আসা এক নারীর সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রথম আলো। তিনি এতটাই অসুস্থ ছিলেন যে কথা বলতে পারেননি। তাঁর হয়ে কথা বলেন তাঁর মেয়ে। তিনি জানান, আসার পর থেকেই তাঁর মা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। নির্যাতনের ঘটনায় তাঁর মা সৌদি আরবে কোনো মামলা করেছিলেন কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, না, কোনো মামলা হয়নি। মা সেখান থেকে বাড়ি ফিরতে পেরেছেন—এতেই তাঁরা খুশি।

বেশ কিছুদিন আগে সৌদিতে এক বয়স্ক নারীকে দেখভালের কথা বলে তাঁকে যৌন ব্যবসার কাজে নিযুক্ত করার অভিযোগ তোলেন এক নারী। এত ভয়াবহ একটি ঘটনা ঘটলেও তিনি কোনো মামলা করেননি। কেন করেননি, তা জানতে চাওয়া হলে ওই নারী বলেন, তিনি আর একমুহূর্ত সৌদি আরবে থাকতে চান না।

ঘটনাটি তুলে ধরে বাংলাদেশ অভিবাসী নারী শ্রমিক অ্যাসোসিয়েশনের (বোমসা) পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, নির্যাতনের যেসব ঘটনা ঘটছে, এককথায় তা ভয়াবহ। বেশ কিছুদিন আগে ওই নারী কর্মী সৌদি আরব থেকে জানান, এক বয়স্ক নারীকে সেবাযত্নের কথা বলে তাঁকে নেওয়া হয়েছিল। পরে তাঁকে দিয়ে ওই বয়স্ক নারী যৌন ব্যবসায় লাগিয়েছেন। ওই বাড়িতে প্রতিদিন ৮ থেকে ১০ জন করে সৌদি যুবক আসত। তাঁকে ওই যুবকদের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে বাধ্য করা হতো।


সুমাইয়া ইসলাম জানান, ওই নারীর অভিযোগ জানার পর তিনি মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করেন। পরে দূতাবাসের হস্তক্ষেপে ওই নারীকে দেশে ফেরত আনা হয়। এত বড় একটি ঘটনা ঘটলেও ভুক্তভোগী নারীটি মামলা করেননি। মামলা করলে কয়েক মাস সৌদি আরবে অবস্থান করতে হবে। কিন্তু সেখানে তিনি কিছুতেই আর থাকবেন না বলে জানিয়েছিলেন।

সুমাইয়া ইসলাম বলেন, নির্যাতনের এমন নানা ঘটনা ঘটছে। গৃহকর্তা ধর্ষণ করছে, গৃহকর্ত্রী মারধর করছে। অনেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেও সফল হন না। কোনো কোনো নারী সেখানে যাওয়ার পর পরিবারগুলো আর খোঁজ পাচ্ছে না। নির্যাতনের শিকার হয়ে প্রতিদিন সৌদি আরব থেকে নারী শ্রমিকদের ফিরে আসা অব্যাহত রয়েছে।

ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল ইসলাম হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘নারী কর্মীদের এত অভিযোগের তথ্য পেলেও সৌদি নিয়োগকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো দৃষ্টান্ত আমরা পাইনি। সৌদি আরব দেশটিতে নারীদের সুরক্ষার জন্য সম্প্রতি আইনে সংস্কার এনেছে। আইনে বিদেশ থেকে আসা নারী কর্মীদের সুরক্ষা দেওয়ার কোনো বিধান নেই। নারী কর্মীদের সুরক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থাসহ (আইএলও) কোনো আন্তর্জাতিক সনদেও সৌদি আরব অনুস্বাক্ষর করেনি। এতে মনে হয়, যেন সৌদি আরব ভেবেই নিয়েছে, নারী কর্মীদের সঙ্গে যা ইচ্ছা, তা-ই করা যায়।’

শরিফুল ইসলাম আরও বলেন, বাংলাদেশ দূতাবাসের উচিত অভিযোগ ওঠা সৌদি নিয়োগকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সৌদি সরকারের সঙ্গে দেনদরবার করা। আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোকেও সৌদি সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে। নারী কর্মী নির্যাতনের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোর চাপে কাতার এ ব্যাপারে দেশটির আইনে কিছু সংস্কার এনেছে বলে তিনি জানান। 

অভিযোগের তুলনায় মামলা কমই হয় বলে স্বীকার করেন সৌদি আরবে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গোলাম মসিহ। তবে ১২ থেকে ১৩ জন নিয়োগকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন।

রাষ্ট্রদূত বলেন, শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগে ১২ থেকে ১৩ জন সৌদি নিয়োগকর্তার বিরুদ্ধে মামলায় সহায়তা করেছে দূতাবাস। সৌদি সরকার ওই নিয়োগকর্তাদের জেল-জরিমানাও করছে। এ ব্যাপারে সৌদি আইন অত্যন্ত কড়া এবং সৌদি সরকার এ ইস্যুতে অত্যন্ত আন্তরিক বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

কুয়েতে ফিলিপাইনের এই নারী গৃহকর্মীকে হত্যার ঘটনায় ফিলিপাইনে বিক্ষোভ। ছবি: রয়টার্স
কুয়েতে ফিলিপাইনের এই নারী গৃহকর্মীকে হত্যার ঘটনায় ফিলিপাইনে বিক্ষোভ। ছবি: রয়টার্স

অভিযোগের তুলনায় এ সংখ্যা অপ্রতুল স্বীকার করে তিনি বলেন, মামলা করার ক্ষেত্রে নির্যাতনের শিকার মেয়েরাই আগ্রহী হন না। মামলা নিষ্পত্তি হওয়া পর্যন্ত অন্তত তিন থেকে চার মাস এখানে থাকতে হবে। নির্যাতনের শিকার নারীরা সেই সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চান না। তাঁরা মামলা করার চেয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি ফিরে যেতে চান।

রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘নারী কর্মীদের ক্ষেত্রে আমাদের মূল সমস্যা হচ্ছে প্রশিক্ষণের অভাব। কাজে অদক্ষ গ্রামের মেয়েদের পাঠানো হয় বেশি। তারা কখনো শহরও দেখেনি। এখানে এসে খাপ খাওয়াতে পারেন না।’

তবে পারিশ্রমিক বাড়ানোর ক্ষেত্রে সৌদি সরকারের সঙ্গে আলোচনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রদূত। তিনি বলেন, এখন একজন নারী গৃহকর্মী ১৬ হাজার টাকা বেতন পান। এটা অত্যন্ত কম। এটাকে বাড়িয়ে ৩০ হাজার টাকা করার প্রস্তাব করা হবে।

বোমসা পরিচালক সুমাইয়া ইসলামের মতে, সুরক্ষার বিষয়টি নারী কর্মী নিয়োগের চুক্তিতে প্রাধান্য দিতে হবে। ওই নারীদের নিয়োগ দেওয়ার আগেই দক্ষ করে গড়ে তুলতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। যেভাবে রিক্রুটিং এজেন্সির সংখ্যা বেড়েছে, তাতে কঠোর পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা রাখা দরকার, যাতে তারা ভালো নিয়োগকর্তার কাছে নারী কর্মী নিয়োগ করতে বাধ্য হয়।

বায়রার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শামীম আহমেদ চৌধুরী বলেন, গত শনিবার বায়রার এক বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, নারী কর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য প্রতি মাসে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর কাছ থেকে তাদের পাঠানো কর্মীদের মাসিক প্রতিবেদন বায়রা, প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়, বিএমইটি ও দূতাবাসে জমা দিতে হবে। এর ফলে আগামী ছয় মাসের মধ্যে পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হবে বলে তিনি দাবি করেন।