কম্পিউটার কম্পোজের দোকানে ছাপা এনআইডি নিম্নমানের

পলিথিন দিয়ে মোড়ানো জাতীয় পরিচয়পত্র। পাশের অর্থহীন কার্ডটিও এনআইডি হিসেবে সরবরাহ করা হয়েছে।
পলিথিন দিয়ে মোড়ানো জাতীয় পরিচয়পত্র। পাশের অর্থহীন কার্ডটিও এনআইডি হিসেবে সরবরাহ করা হয়েছে।

নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সিদ্ধান্ত ছিল ২০১২ সালের পরে ভোটার হওয়া ৯৩ লাখ ভোটারকে স্মার্টকার্ডের পরিবর্তে আপাতত কাগজে প্রিন্ট ও ল্যামিনেটেড করা জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) দেওয়া হবে। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে এসব কার্ড ছাপার কাজ শেষ করার কথা। কিন্তু ইসি সেই কার্ড এখনো বুঝে পায়নি।

এর কারণ, ইসি যোগ্য প্রতিষ্ঠানকে কাজ না দিয়ে স্মার্ট টেকনোলজিস বিডি নামের নাম-গোত্রহীন একটি প্রতিষ্ঠানকে কার্ড ছাপার কাজ দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি কার্ড ছেপেছে আগারগাঁওয়ে পাসপোর্ট অফিসকে ঘিরে বিভিন্ন বস্তি ও গলির ঝুপড়ি ঘরে গড়ে ওঠা কম্পিউটার কম্পোজ ও লেমিনেটিংয়ের দোকানে। কিছু কার্ড ছাপা হয় নির্বাচন কমিশন ভবনের সপ্তম ও অষ্টম তলায় আইডিয়া প্রকল্পের কর্মকর্তাদের কক্ষে।

এখন অভিযোগ উঠেছে, স্মার্ট টেকনোলজিস বিডি সাইনবোর্ডসর্বস্ব একটি প্রতিষ্ঠান। বাস্তবে ইসি এই প্রতিষ্ঠানের নামে তাদের আইডিয়া প্রকল্পের কিছু কর্মকর্তাকে কার্ড ছাপার কাজ দিয়েছে। কমিশন সচিবালয়ের শীর্ষ একাধিক কর্মকর্তা জানান, প্রতিষ্ঠানটি কার্ড ছাপার কাজ শেষ করেছে এবং তা এখন ইসির কাছে হস্তান্তর করতে চায়। কিন্তু ছাপা হওয়া কার্ড এতটাই নিম্নমানের যে তা গ্রহণ ও বিতরণের অযোগ্য। এসব কার্ডের ভবিষ্যৎ কী, তা নিয়ে এখন বেকায়দায় ইসি।

জানতে চাইলে ইসি সচিবালয়ের সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না। কারণ, এর সঙ্গে কমিশন সচিবালয়ের কোনো সম্পর্ক নেই। এটি একটি পৃথক প্রকল্প। এর একজন মহাপরিচালক আছেন। তাঁকে প্রশ্ন করেন।’

নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আইডিয়া প্রকল্প অবশ্যই কমিশন এবং কমিশন সচিবালয়ের প্রকল্প। তবে এই প্রকল্পের এসব অনিয়ম সম্পর্কে আমরা এখনো কিছুই জানি না।’

অনিয়মের শেষ নেই
ইসি ২০১১ সালের জুলাইয়ে আইডিয়া প্রকল্প গ্রহণ করে। এই প্রকল্পের জন্য বিশ্বব্যাংক থেকে প্রায় ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়। এই প্রকল্পের আওতায় নয় কোটি ভোটারকে স্মার্টকার্ড দেওয়ার কথা। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০১৬ সালের জুনে প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু ইসির জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগ এ কাজের জন্য যথাসময়ে দরপত্র আহ্বান করতে পারেনি।

পলিথিন দিয়ে মোড়ানো জাতীয় পরিচয়পত্র। পাশের অর্থহীন কার্ডটিও এনআইডি হিসেবে সরবরাহ করা হয়েছে।
পলিথিন দিয়ে মোড়ানো জাতীয় পরিচয়পত্র। পাশের অর্থহীন কার্ডটিও এনআইডি হিসেবে সরবরাহ করা হয়েছে।

দরপত্র আহ্বান করলেও ইসি যোগ্য প্রতিষ্ঠানকে কাজ না দিয়ে ওবার্থুর নামের ফ্রান্সের প্রায় দেউলিয়া এক প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়। কিন্তু কয়েক দফা সময় বাড়ানোর পরও প্রতিষ্ঠানটি যথাসময়ে স্মার্টকার্ড ছাপার কাজ শেষ করতে পারেনি। এ অবস্থায় ইসি ওবার্থুরের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করে। বর্তমানে দেনা-পাওনা নিয়ে দুপক্ষের মধ্যে মামলা চলছে।

দুর্নীতির নতুন দ্বার
আইডিয়া প্রকল্পের আওতায় নয় কোটি ভোটারকে স্মার্টকার্ড দেওয়ার কাজ যখন শুরু হয়, তত দিনে দেশের ভোটার সংখ্যা ১০ কোটি ছাড়িয়ে যায়। তখন কমিশন সিদ্ধান্ত নেয়, ২০১২ সালের পরে ভোটার হওয়া ৯৩ লাখ ভোটারকে আইডিয়া প্রকল্পের আওতায় কাগজে প্রিন্ট করা সাধারণ মানের কার্ড সরবরাহ করা হবে।

বিশ্বব্যাংকের শর্ত অনুযায়ী ২০১৭ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে সব ধরনের কার্ড ছাপার কাজ শেষ করার কথা। সে জন্য ইসি ৯৩ লাখ কার্ড ছাপার জন্য ২০১৭ সালের অক্টোবরে দরপত্র আহ্বান করে। দরপত্রে অংশ নিয়ে ক্রিয়েটিভ বাংলাদেশ সর্বনিম্ন ৫ কোটি ৩১ লাখ টাকায়, দ্বিতীয় সর্বনিম্ন দরদাতা এম এন মল্লিক অ্যান্ড কোম্পানি ৭ কোটি ৮৩ লাখ টাকায় এবং সর্বোচ্চ দরদাতা স্মার্ট টেকনোলজিস বিডি ৮ কোটি ৯৬ লাখ টাকায় কার্ড ছাপার দরপ্রস্তাব করে।

জানা যায়, স্মার্ট টেকনোলজিস বিডিকে সামনে রেখে মূলত ঠিকাদারির কাজটি করেছেন ইসির আইডিয়া প্রকল্পের কয়েকজন কর্মকর্তা।

অলিগলি ও উদ্যানে কার্ডের ছড়াছড়ি
দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী স্মার্ট টেকনোলজিস ডিসেম্বরের মধ্যে কার্ড সরবরাহ করতে পারেনি। তারা কার্ড ছাপার কাজ শেষ করে ফেব্রুয়ারিতে। নিজেদের ছাপার যন্ত্র না থাকায় তারা আগারগাঁওয়ের বিভিন্ন কম্পিউটার কম্পোজের দোকানে কার্ড ছাপা ও লেমিনেটিংয়ের কাজ দেয়। একাধিক দোকান মালিকের সঙ্গে কথা বলে এর সত্যতা পাওয়া গেছে।

আগারগাঁওয়ে একটি কম্পিউটার কম্পোজের দোকানের পাশের উদ্যানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এনআইডি
আগারগাঁওয়ে একটি কম্পিউটার কম্পোজের দোকানের পাশের উদ্যানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এনআইডি

সরেজমিনে আগারগাঁওয়ের বিভিন্ন গলি ও ফাঁকা উদ্যানে অসংখ্য পরিত্যক্ত কার্ড পড়ে থাকতে দেখা গেছে। জানা যায়, দ্রুত কাজ শেষ করতে আইডিয়া প্রকল্পের কর্মকর্তাদের কক্ষেও কার্ড ছাপার কাজ হয়েছে এবং কার্ড লেমিনেটিং করার ক্ষেত্রে নিজেদের দপ্তরের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ব্যবহার করেছে। কর্মচারীরা জানান, এ কাজের জন্য তাঁদের কার্ডপ্রতি ৩৫ পয়সা করে দেওয়া হয়েছে।

ইসি সচিবালয় সূত্র জানায়, শেষ পর্যন্ত কার্ড ছাপার কাজ শেষ হলেও তা মানসম্মত না হওয়ায় ইসির বাছাই কমিটি এসব কার্ড গ্রহণ করতে আপত্তি জানায়। গতকাল সোমবার ইসি সচিবালয়ে শতাধিক নমুনা কার্ড পরীক্ষা করে দেখা গেছে, দরপত্রের শর্ত উপেক্ষা করে কার্ডে নিম্নমানের কাগজ ব্যবহার করা হয়েছে। কার্ড লেমিনেটিং না করে তা সাধারণ মানের পলিথিন দিয়ে আটকানো হয়েছে। কয়েকটি কার্ড পাওয়া গেছে, যেখানে ভোটারের নাম-ঠিকানা কিছুই নেই, শুধু নম্বর আছে।

জানতে চাইলে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক মো. সাইদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইডিয়া প্রকল্পের কর্মকর্তারা কার্ড ছাপার কাজ করেছে বা আগারগাঁওয়ের বিভিন্ন দোকানে কার্ড ছাপা হয়েছে, এসব তথ্য সঠিক নয়। তা ছাড়া আমাদের কাছে কার্ড কে ছেপেছে বা কোথায় ছাপা হয়েছে, তা বড় ব্যাপার নয়। বড় ব্যাপার হলো কার্ড মানসম্মত কি না। কার্ড মানসম্মত নয়, তাই আমরা এখন পর্যন্ত কার্ড গ্রহণ করিনি। কারণ, আমরা ভোটারের কাছে মানসম্মত কার্ড পাঠানোর ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’