প্রার্থীদের চোখ শ্রমিক ভোটে

যেদিকে চোখ পড়ে, শুধু নির্বাচনী পোস্টার। যেন পোস্টারের নগরী। গতকাল সকালে গাজীপুরের টঙ্গীর কলেজগেট এলাকায়।  ছবি: প্রথম আলো
যেদিকে চোখ পড়ে, শুধু নির্বাচনী পোস্টার। যেন পোস্টারের নগরী। গতকাল সকালে গাজীপুরের টঙ্গীর কলেজগেট এলাকায়। ছবি: প্রথম আলো

ঈদের ছুটি কাটাতে গ্রামে যাওয়া সব শ্রমিক যাতে ভোটের দুই দিন আগে গাজীপুর শহরে ফিরে আসতে পারেন, সে তৎপরতা চালাচ্ছেন মেয়র ও কাউন্সিলর পদপ্রার্থীরা। শ্রমিকদের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ রাখা, তাঁদের জন্য বাস ভাড়ার ব্যবস্থা করা, এমনকি উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন উপজেলায় বাস পাঠানোর কথাও ভাবছেন প্রার্থীরা।

গাজীপুর সিটি নির্বাচনে মোট ভোটার ১১ লাখ ৩৭ হাজার ৭৩৬ জন। এর মধ্যে অন্তত ২ লাখ শহরের বিভিন্ন কারখানার শ্রমিক বলে মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা জানান। নির্বাচনে জয়-পরাজয়ে শ্রমিকদের ভোট গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে মনে করছেন তাঁরা। ঈদের ছুটি শেষে গাজীপুর শহরের বিভিন্ন কারখানা খুলবে ২৩ ও ২৪ জুন। আবার ২৪ জুন রাত ১২টায় শেষ হবে আনুষ্ঠানিক প্রচারণা। তার আগেই শ্রমিকদের ফিরে আসা নিশ্চিত করতে চান প্রার্থীরা। ২৬ জুন গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন।

গাজীপুর সিটি করপোরেশন এলাকায় ৫০০-এর বেশি পোশাক কারখানা রয়েছে। এ ছাড়া টঙ্গী এবং কোনাবাড়ি এলাকায় বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) দুটি শিল্পনগরী রয়েছে। এর বাইরে পানীয়, জুতা, যন্ত্রাংশসহ বিভিন্ন ধরনের ভারী শিল্পকারখানা রয়েছে। শ্রমিকদের বেশির ভাগের বাড়ি উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন উপজেলায়।

আওয়ামী লীগের মেয়র পদপ্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, শ্রমিক ভোটকে প্রাধান্য দিচ্ছেন তিনি। বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর সমর্থন নিয়েছেন। নির্বাচনের আগে শ্রমিকদের ফেরত আনার চেষ্টা চালাচ্ছেন। কারখানার মালিকদেরও সেভাবে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। শ্রমিকদের ফিরিয়ে আনতে বিভিন্ন ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদপ্রার্থীরাও কাজ করছেন।

অন্যদিকে বিএনপির মেয়র পদপ্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার বলেন, একসময় তিনি শ্রমিক রাজনীতি করতেন। শ্রমিকদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক আছে। তবে ভোটের জন্য কোনো প্রলোভন দেখাতে রাজি নন তিনি।

শহরের ছয়দানা এলাকার একটি চায়ের দোকানে গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে কথা হয় স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে। চায়ের দোকানি আরাফাত আলী বলেন, ‘যে প্রার্থীর ২০টা শ্রমিক ভোট আছে, সে ২০ হাজার টাকা খরচ করে হলেও শ্রমিকদের আনার
ব্যবস্থা করবে।’ গ্রামে যাওয়া শ্রমিকদের ফিরিয়ে আনতে নিজের সাধ্যমতো সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন বলে জানান গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ১ নম্বর ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ-সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী মামুন মণ্ডল। তিনি বলেন, ঈদ করতে শ্রমিকেরা দেশের যে প্রান্তেই যাক না কেন তাঁদের ফিরিয়ে আনতে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। 

একই কথা জানান ৩ নম্বর ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ-সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী সাইজ উদ্দীন মোল্লা। শ্রমিকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন বলে জানান তিনি।

জাহাঙ্গীর ব্যস্ত পথসভায়
শতাধিক মোটরসাইকেল এবং গাড়ির বহর নিয়ে গতকাল সকালে গণসংযোগে বের হন জাহাঙ্গীর আলম। ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সুরাবাড়ি ধানসিঁড়ি স্কুল মাঠে পথসভা দিয়ে প্রচারণা শুরু করেন তিনি। পর্যায়ক্রমে ১ থেকে ১২ নম্বর ওয়াডের্র স্কয়ার গেট, লতিফপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠ, তুরাগ ঈদগাহ মাঠ, হাতিমারা ঈদগাহ মাঠসহ ১৫টি পথসভায় বক্তব্য দেন তিনি।

বিকেল পাঁচটার দিকে জাহাঙ্গীর আলম পথসভা করেন গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ১১ নম্বর ওয়ার্ডের নছের মার্কেট এলাকায়। সেখানে তিনি বলেন, গত পাঁচ বছরে গাজীপুরে পরিকল্পিত কোনো উন্নয়ন হয়নি। আধুনিক ও পরিকল্পিত, পরিচ্ছন্ন, সবুজ শহর গড়তে দলমত-নির্বিশেষে সবার কাছে একবার সুযোগ চান তিনি।

দলের মেয়র প্রার্থীকে জয়ী করতে সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে নেমেছে বলে ওই পথসভায় বলেন গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমত উল্লা খান। তিনি বলেন, শিল্পকারখানায় সমৃদ্ধ গাজীপুর উন্নয়নে পিছিয়ে। গাজীপুরের উন্নয়নে নৌকা প্রতীকে ভোট দিতে হবে।

পথসভায় আরও উপস্থিত ছিলেন গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আফজাল হোসেন সরকার, কালিয়াকৈর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রেজাউল করিম, কোনাবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আক্কাস, কেন্দ্রীয় যুবলীগের সহসভাপতি সেলিম আজাদ প্রমুখ।

প্রচারণায় বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা
দলের প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকারের পক্ষে গতকাল পৃথকভাবে গণসংযোগ ও পথসভায় অংশ নেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা। গাজীপুর জেলা বিএনপির কার্যালয় প্রাঙ্গণে ও ২৮ নম্বর ওয়ার্ডের হাড়িনাল এলাকায় গণসংযোগ ও পথসভা করেন তাঁরা।
হাড়িনাল এলাকার পথসভায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, খুলনা ও গাজীপুর এক নয়। খুলনার মতো কারচুপি গাজীপুরে করলে ক্ষমতাসীনদের শিকড়ে নাড়া লাগবে।

পথসভায় আরও বক্তব্য দেন বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এ কে এম ফজলুল হক ও শামা ওবায়েদ, কেন্দ্রীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক আবদুস সালাম আজাদ প্রমুখ।

হাসান উদ্দিন সরকার গতকাল শহরের ইছরদী, জাঝর, অ্যারাবিয়ান গার্মেন্ট, বটতলা, টিঅ্যান্ডটি, শিলমুন, মরকুন এলাকায় গণসংযোগ ও পথসভা করেন। ইছরদী এলাকার পথসভায় তিনি বলেন, জাহাঙ্গীর আলম কথায় কথায় কেন্দ্রীয় সরকারের কথা বলছেন। সিটি করপোরেশনের মতো স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপ করার কোনো সুযোগ নেই। নিজের যোগ্যতাবলেই স্থানীয় সরকার পরিচালনা করতে হয়। নিজের যোগ্যতা না থাকলে কেন্দ্রীয় সরকার এসে স্থানীয় সরকার পরিচালনা করবে না।

এসব পথসভায় উপস্থিত ছিলেন গাজীপুর জেলা বিএনপির সভাপতি ও কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এ কে এম ফজলুল হক, সাধারণ সম্পাদক কাজী ছাইয়েদুল আলম, সিনিয়র সহসভাপতি সালাহ উদ্দিন সরকার প্রমুখ।

জনগণের মুখোমুখি প্রার্থীরা
গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের দুটি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থীদের নিয়ে গতকাল জনগণের মুখোমুখি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)। সকালে ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের ৬ জন কাউন্সিলর প্রার্থী এবং বিকেলে ৩৫ নম্বর ওয়ার্ডের ৪ জন প্রার্থী জনগণের মুখোমুখি হন। এলাকার বাসিন্দা ও ভোটাররা প্রার্থীদের নানা প্রশ্ন করেন। প্রার্থীরাও বিভিন্ন বিষয়ে ভোটারদের কাছে অঙ্গীকার করেন।

আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ
জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ এনেছেন হাসান উদ্দিন সরকার। রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে গতকাল লিখিত অভিযোগে তিনি বলেন, নির্বাচনী প্রক্রিয়ার শুরু থেকেই আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী ও তাঁর সমর্থকেরা একের পর এক আচরণবিধি লঙ্ঘন করে সুষ্ঠু নির্বাচনী পরিবেশ নষ্ট করছেন। আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী বিধিবহির্ভূতভাবে রঙিন ছবিযুক্ত চার রঙের বিলবোর্ড, ব্যানার, পোস্টার, সাইনবোর্ড মহাসড়কের দুই পাশসহ শহরের বিভিন্ন এলাকায় স্থাপন করেছেন। যা সিটি করপোরেশন নির্বাচন আচরণ বিধিমালার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

অভিযোগ পাওয়ার কথা জানিয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তা রকিব উদ্দিন মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির মেয়র প্রার্থী এর আগেও চারটি অভিযোগ করেছেন। সবগুলো অভিযোগ তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।