ননদ বাসায়, খোঁজ মেলেনি স্বামী আবদুলের

ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন রোখসানা আকতার। ছবি: প্রথম আলো
ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন রোখসানা আকতার। ছবি: প্রথম আলো

ভারতীয় নাগরিক রোকসানা আকতারের ননদের ঢাকার বাসার খোঁজ পাওয়া গেছে। ননদ এখন ঢাকার বাসাতেই আছেন। তবে এই বাড়ির লোকেরা রোখসানার স্বামী আবদুলের কোনো খবর জানেন না।

গত সোমবার রোখসানার স্বামী আবদুল হক ঘটনার দিন আজিমপুরের ওই বাসা থেকেই বের হয়েছিলেন। স্ত্রী ও বোনকে সঙ্গে নিয়েই আবদুল প্রথমে একজন চিকিৎসকের কাছে যান। এরপর রোখসানাকে কমলাপুর রেলস্টেশনে রেখে বোনকে নিয়ে উধাও হয়ে যান।

পরে কমলাপুরে রেলওয়ে স্টেশনের শৌচাগারে সন্তান প্রসব করেন রোখসানা। এখন তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।

রোখসানার ননদের স্বামীর নাম সোলেমান। তিনি আজিমপুর কবরস্থানে লাশ দাফনের কাজ করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর স্ত্রী (রোখসানার ননদ) বাসায় ফিরে এসেছেন। তবে আবদুল হকের কোনো খবর তাঁরা পাচ্ছেন না।

রোখসানা বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। গত সোমবার রাজধানীর কমলাপুর রেলওয়ে থানার শৌচাগারে সন্তান প্রসব করেন রোখসানা। তার আগেই কমলাপুর স্টেশনে রোখসানাকে ফেলে চলে যান তাঁর স্বামী আবদুল। এখন পর্যন্ত আবদুলের কোনো হদিস পাওয়া যায়নি।

আজ বৃহস্পতিবার সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় রোখসানার। তিনি বাংলা ভাষা বলতে পারেন না, বুঝতেও পারেন না। অন্যদিকে প্রতিবেদক হিন্দি ভাষা বুঝতে পারলেও বলতে পারেন না। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একজন স্পেশাল আয়া রোজিনা বেগম প্রতিবেদক এবং রোখসানার মধ্যে দোভাষীর কাজ করেন।

রোখসানা কথা বলছিলেন খুব কম। রোখসানা বলছিলেন, তাঁর ননদের নাম নিলু। তাঁর স্বামীর নাম সোলেমান। আজিমপুর কবরস্থানের কাছেই ননদের বাসা। ঘটনার দিন ননদের বাসা থেকেই ননদ এবং স্বামী আবদুলের সঙ্গে তিনি বের হন। প্রথমে এক চিকিৎসকের কাছে নিলে চিকিৎসক জানান, রোখসানার পেটেই সন্তান মারা গেছে। এই কথা শোনার পর সেখান থেকে আরেক চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার কথা বলে তাঁরা কমলাপুর স্টেশনে যান। সেখানে রোখসানাকে বসিয়ে রেখেই স্বামী এবং ননদ চলে যান। তারপর স্টেশনের মানুষজনের সহায়তায় স্টেশনের একদম কাছেই সরকারি রেলওয়ে থানার (জিআরপি) টয়লেটে গিয়ে সন্তান প্রসব করেন। পরে রাজধানীর আরেকটি হাসপাতাল হয়ে ১৯ জুন রোখসানা ও তাঁর ছেলে নবজাতককে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

রোখসানার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে আজিমপুর কবরস্থানে খোঁজ নিয়ে সোলেমান নামে দুজনকে পাওয়া যায়। তাঁদের একজন জানালেন, তাঁর বাড়ি চাঁদপুরে। অন্যদিকে আবদুলের বাড়িও চাঁদপুর হওয়ায় কথার এক ফাঁকে সোলেমান জানালেন, আবদুল তাঁর শ্যালক। আবদুলের পুরো নাম আবদুল হক। বয়স ৩০ বা ৩২ বছর হতে পারে। পাঁচ থেকে ছয় বছর আগে আবদুল চট্টগ্রামে এক বিয়ে করেন। সেই ঘরে তাঁর কোনো সন্তান নেই। তারপর আবদুল ভারতের বেঙ্গালুরু যান এবং সেখানে বিয়ে করেন। গত ১০ থেকে ১২দিন আগে নতুন বউ রোখসানাকে নিয়ে বাংলাদেশে আসেন।

সোলেমান বলেন, গত সোমবার আবদুল বউ নিয়ে তাঁর বাসাতেই ছিলেন। প্রসব জনিত কারণে রোখসানার পানি ভাঙা শুরু হয়। তখন তাঁর স্ত্রী ও আবদুল রোখসানাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান (কোন চিকিৎসক নাম বলতে পারেননি সোলেমান)। সেখানে চিকিৎসক জানান, রোখসানার বাচ্চা মারা গেছে, তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিতে হবে। সোলেমানের স্ত্রী ফোনে সোলেমানকে এ খবর জানিয়ে বাড়ি ফিরে আসেন। আবদুল রোখসানাকে ঢাকা মেডিকেলে নেবেন বলে জানান। কিন্তু তারপর থেকে আবদুল আর রোখসানার কোনো খোঁজ তাঁরা জানেন না।

আজ সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, রোখসানার বিছানার পাশে সরকারি রেলওয়ে থানার (জিআরপি) দুজন নারী পুলিশসহ তিনজন পুলিশ বসে আছেন। রোখসানা খাবার খাচ্ছেন না। চুলে তেল, পানি, চিরুনি লাগেনি কয়েক দিন। যেহেতু কেউ রোখসানার ভাষা বুঝতে পারেন না তাই কথা বলারও উপায় নেই। রোখসানাও কথা বলছেন না। তবে আশপাশের অনেকেই উৎসুক হয়ে রোখসানার খবর নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। তখন রোখসানা হয় ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকছিলেন, কখনো বা তাঁর দুচোখ বেয়ে পানি পড়তে থাকে। স্বামী আবদুলের প্রসঙ্গ আসতেই কান্না বেড়ে যায় তাঁর।

রোখসানার ভাষ্য অনুযায়ী, আবদুল দেখতে ‘খুবসুরত’। দেড় বছর আগে তাঁদের বিয়ে হয়েছে। বেঙ্গালুরুতে আবদুল ফার্নিচারের কাজ করতেন। বিয়ের আগে আবদুল রোখসানার বাড়িতে আসবাবপত্র মেরামতের কাজ করতে যান। সেখান থেকেই তাঁদের পরিচয়। তিন মাস প্রেম করার পর পারিবারিকভাবেই বিয়ে হয়। বাংলাদেশে আসার পর রোখসানার ভারতীয় পাসপোর্ট আবদুলের কাছেই ছিল। রোখসানার কাছে আবদুলের কোনো ছবি নেই, এমনকি কোনো ফোন নম্বরও নেই।

আবদুল রোখসানার সঙ্গে কোনো প্রতারণা করতে পারেন তা বিশ্বাস করতে পারছেন না রোখসানা। তাই তিনি ভারত নয়, আবদুলের কাছেই ফিরতে চান বলে প্রথম আলোকে জানান। রোখসানারা এক ভাই, দুই বোন।

রোখসানার সন্তান বর্তমানে ভর্তি আছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের স্পেশাল কেয়ার বেবি ইউনিটে (স্ক্যাবু)। হাসপাতালের নবজাতক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তোফাজ্জল হোসেন প্রথম আলোকে জানান, মাত্র ১৭শ গ্রাম ওজন নিয়ে নবজাতকের জন্ম হয়েছে। জন্ডিসসহ কিছু জটিলতা দেখা দিয়েছে। প্রথম দিকে নল দিয়ে খাবার দিলেও এখন খাবার বন্ধ আছে। এই মুহূর্তে এ নবজাতককে আশঙ্কামুক্ত বলা যাচ্ছে না।