খুলনার চেয়েও এক ধাপ এগিয়ে

>
  • ৪২৫ কেন্দ্রের মধ্যে ৪১৬ টির ফল
  • ভোট পড়েছে ৫৭.২ %
  • জাহাঙ্গীর আলমের প্রাপ্ত ভোট ৪,০০, ০১০
  • হাসান উদ্দিন সরকারের প্রাপ্ত ভোট ১,৯৭, ৬১১
  • খুলনার অভিজ্ঞতা থেকে আ. লীগের নির্বাচনী কৌশলে পরিবর্তন
  • পাল্টা কৌশল বিএনপি নিতে পারেনি
বেসরকারিভাবে নির্বাচিত মেয়র জাহাঙ্গীর আলম।  ছবি: প্রথম আলো
বেসরকারিভাবে নির্বাচিত মেয়র জাহাঙ্গীর আলম। ছবি: প্রথম আলো

ভোটের দিন কেন্দ্র নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে খুলনার চেয়ে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এক ধাপ এগিয়ে রয়েছে আওয়ামী লীগ। এজেন্টদের কেন্দ্রছাড়া করার ক্ষেত্রে নেওয়া হয়েছে অভিনব কৌশল। আর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের একটি অংশকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার অভিযোগ উঠেছে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, মূলত বিএনপির মেয়র প্রার্থীর এজেন্টদের কেন্দ্রছাড়া করার পরই বিভিন্ন কেন্দ্রে ব্যালটে সিল মেরে বাক্স ভর্তি করার ঘটনাগুলো ঘটেছে। এতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের একটা অংশের বড় ভূমিকা ছিল। খুলনার নির্বাচনে বিএনপিকে মাঠছাড়া করার জন্য পুলিশ যেভাবে বাসা-বাড়িতে অভিযান চালিয়েছিল, গাজীপুরের ক্ষেত্রেও তা হয়েছিল। তবে তা খুলনার মতো তীব্র ছিল না। তফসিল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচনের দিন পর্যন্ত গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে শখানেক। খুলনার অভিজ্ঞতা থেকে আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী কৌশলে পরিবর্তন আনলেও সেটা মোকাবিলা করার মতো পাল্টা কৌশল বিএনপি নিতে পারেনি। কেন্দ্র থেকে এজেন্ট বের করে দিলে প্রতিরোধ শুরু হয়ে যাবে; বিএনপির প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার ঘোষণা দিলেও বাস্তবে তার কিছুই হয়নি। সে চেষ্টাও ছিল না। বরং বেলা একটায় ভোট বন্ধের দাবি জানিয়ে তিনি ঘরে ফিরে যান।

বিএনপির নির্বাচন পর্যবেক্ষক দলের প্রধান কাজী মাহবুব উল হক বলেন, খুলনায় এজেন্টদের ভয়ভীতি দেখিয়ে কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে গাজীপুরে তিন সেট এজেন্ট প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। প্রথম সেট আটক বা দুর্ঘটনার শিকার হলে দ্বিতীয় সেট, সেটিতেও কাজ না হলে তৃতীয় সেট দিয়ে নির্বাচন করা হবে। কাজী মাহবুব উল হকের দাবি, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সবাইকেই বের করে দেওয়া হয়েছে।

গাজীপুর জেলা ছাত্রলীগ ও পৌর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি এবং বর্তমানে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের নির্বাহী সদস্য মো. আবদুল হাদীর বিশ্লেষণ, বিএনপির পরাজয়ের একাধিক কারণ রয়েছে। বিএনপির নেতা-কর্মীরা ভোটের দিন মাঠেই ছিলেন না। তাঁদের ভোটারদের কেন্দ্রে আনতে বিএনপির কোনো লোকজনকে দেখা যায়নি। গত পাঁচ বছরে বিএনপির মেয়র এম এ মান্নান তেমন কোনো কাজ করতে পারেননি। তা ছাড়া এবারের প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকারের শারীরিক অবস্থা ভালো নয়। নির্বাচনে এর একটা প্রভাব থাকে। অন্যদিকে জাহাঙ্গীর ভোটকে টার্গেট করে ১০ বছর ধরে কাজ করেছেন। গাজীপুর সিটির এমন কোনো এলাকা নেই, যেখানে জাহাঙ্গীরের সামাজিক সম্পর্ক বা ব্যক্তিগত যোগাযোগভিত্তিক কর্মী নেই।

যেভাবে এজেন্টরা উধাও
ভোটের পরদিন বিভিন্ন পর্যায়ে খোঁজখবর করে এবং বিএনপির নেতা ও উধাও হয়ে যাওয়া এজেন্টদের অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কাউকে ভোটের আগের রাতে, ভোটের দিন ভোরে বাড়ি থেকে, সকালে কেন্দ্রের ভেতর ও বাইর থেকে তুলে নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে।

এমন অনেকের সঙ্গে প্রথম আলোর কথা হয়েছে। তবে বেশির ভাগই এখনো আতঙ্কে আছেন, নাম প্রকাশ করে গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিতে ভয় পাচ্ছেন।
বিএনপির প্রার্থীর মিডিয়া সেলের প্রধান মাজহারুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, গ্রেপ্তার এড়াতে এজেন্টদের বাড়িতে না থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। তাতেও লাভ হয়নি। অনেককে কেন্দ্রের ভেতর বুথ থেকেও সাদাপোশাকের পুলিশ বা ডিবি তুলে নিয়ে গেছে।

তুলে নিয়ে গোপন স্থানে রেখে ভোট শেষ হওয়ার পর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, এমন ৪২ জন সম্পর্কে জানা গেছে, যাঁরা বিএনপির প্রার্থীর নির্বাচনী এজেন্ট বা কেন্দ্র কমিটির সদস্য ছিলেন।

তাঁদের মধ্যে রয়েছেন আঞ্জুমান হেদায়েতুল উম্মত কেন্দ্রের এজেন্ট হাবীবুর রহমান, টিডিএইচ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের এজেন্ট ফারুক হোসেন, ধীরাশ্রম জি কে আদর্শ উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রের এজেন্ট সেলিম রেজা, সাহারা খাতুন কিন্ডারগার্টেন কেন্দ্রের এজেন্ট মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর আলম, ধূমকেতু স্কুল কেন্দ্রের এজেন্ট আবদুল হামিদ, শ্রমকল্যাণ কেন্দ্র থেকে সাবেক পৌর কমিশনার শরিফ মিয়া, শরিফপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র থেকে মনির হোসেন, টঙ্গী থানা ছাত্রদলের সহসভাপতি শাহাব উদ্দিন, আমবাগ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র থেকে শ্রমিক দলের নেতা বজলুর রহমান, পুবাইল রোমানিয়া মাদ্রাসা কেন্দ্র থেকে খোরশেদ মিয়া, সাবেক কাশিমপুর ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবদুল আজিজ মাস্টার; ধূমকেতু কেন্দ্র থেকে শাহাব উদ্দিন, ক্যারিয়ার লাইফ স্কুল কেন্দ্রের আবদুল কাদির, ৪৭ নম্বর ওয়ার্ডের আহম্মদ, ১৫ নম্বর ওয়ার্ড ভোগড়া মধ্যপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র থেকে গিয়াস উদ্দিন, টঙ্গী কিন্ডারগার্টেন কেন্দ্র থেকে সোহাগ প্রমুখ।

ভোটের দিন সকালে টঙ্গীর নোয়াগাঁও এম এ মজিদ মিয়া উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে প্রবেশের সময় আটক করা হয় বিএনপির প্রার্থীর এজেন্ট আলমগীর হোসেনকে। একইভাবে আরিচপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র কমিটির সদস্য কাজী শাহীন, বনমালা এলাকা থেকে ছাত্রদলের নেতা রাজন ও বিএনপির কর্মী জাকির এবং ৪৬ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক কাজী নজরুলকে আটক করা হয়।

টঙ্গী থানা ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শাহ আলম ও শিমুলতলী কেন্দ্রের প্রধান এজেন্ট মোতালেব, মদিনাতুল উলুম মাদ্রাসা কেন্দ্রের এজেন্ট মো. মুন্নাকে ভোটের আগের সন্ধ্যায় বিলাসপুর বটতলা থেকে আটক করা হয়। ভোট শেষ হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর মুন্নাসহ ছয়জনকে কাপাসিয়া রোডের এক জায়গায় নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়।

৩১ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি আইনজীবী হাসানুজ্জামান, ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের আমির হোসেন, তৈজউদ্দিন উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রর এজেন্ট আবু বকর সিদ্দিককে ভোট শুরুর পর কেন্দ্র থেকে ডেকে নিয়ে আটক করা হয়। পরে অনেক রাতে ছেড়ে দেওয়া হয়।

তুলে নেওয়া ও ফেরার গল্প
৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের গাছা কলমেশ্বর আদর্শ বিদ্যালয় কেন্দ্রের ভেতর থেকে ভোটের দিন দুপুর পৌনে ১২টার দিকে ধানের শীষের এজেন্ট মোহাম্মদ ইদ্রিছ খানকে তুলে নেন সাদাপোশাকের একদল ব্যক্তি।

ইদ্রিছ খান প্রথম আলোকে বলেন, ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে চার ব্যক্তি কথা আছে বলে তাঁকে ঘরের বাইরে আসতে বলেন। তিনি বাইরে গেলে একজন এসে তাঁর বাঁ হাত ধরেন। আরেকজন কাঁধে ধরে হাঁটতে বলেন। এ সময় তিনি জানতে চান, ‘ভাই, কোনো সমস্যা?’ জবাবে ওই ব্যক্তি বলেন, ‘সমস্যা না, আপনাকে হেল্প করছি। নিরাপদে সরিয়ে দিচ্ছি।’

পরে রাস্তার পাশে দাঁড়ানো একটি হাইয়েস মাইক্রোবাসে তাঁকে তোলা হয় এবং একটি লাঠি দিয়ে কয়েকটি আঘাত করা হয়। চান্দনা চৌরাস্তা পুলিশ বক্সের কাছে এলে তাঁকে নামিয়ে একই ধরনের আরেকটি গাড়িতে তোলা হয়। পরে তাঁকে জেলা পুলিশ লাইনের একটি বড় কক্ষে নিয়ে রাখা হয়।

ইদ্রিছের ভাষ্য, সেখানে তাঁর আগে নিয়ে যাওয়া হয় ৩৬ জনকে। তিনি ৩৭ নম্বর। তারপর আরও ৫ জনকে সেখানে নেওয়া হয়। ওই কক্ষে মোট ৪২ জন ছিলেন বলে ইদ্রিছের দাবি।

অবশ্য গাজীপুর পুলিশ লাইনের আবাসিক পরিদর্শক (আরআই) আবুল কালাম আজাদ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশ লাইনে এমন কাউকে আটক করে রাখা হয়েছিল কি না, তাঁর জানা নেই। তিনি ভোটের দায়িত্ব পালনে বাইরে ছিলেন।

ইদ্রিছ খান প্রথম আলোকে বলেন, বিকেল সাড়ে চারটার দিকে একজন এসে বললেন, ‘আপনারা চিন্তা করবেন না। সবাইকে একটু দূরে নিয়ে ছেড়ে দেব।’ ইদ্রিস বলেন, ‘এরই মধ্যে সাত-আটটি বড় মাইক্রোবাস গাড়ি আনা হলো। একটা গাড়িতে ছিলাম আমরা ছয়জন এবং ডিবি পুলিশ ছিল চারজন। আমাদের গাড়ির পেছনের সিটে বসানো হলো। আমাদের গাড়িটা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের সালনা ব্রিজ অতিক্রম করার পর বাম পাশে একটি সিএনজি স্টেশনে নিয়ে গাড়িতে গ্যাস নেওয়া হচ্ছিল। ডিবি পুলিশ চালককে ৭০০ টাকার গ্যাস নিতে বলল। কিন্তু দূরের যাত্রা হওয়ায় চালক গ্যাস নিল ১২০০ টাকার। অতিরিক্ত ৫০০ টাকার গ্যাস নেওয়ায় চালকের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে পুলিশ এবং ৫০০ টাকা চালককে দিতে বলে। কিন্তু চালক জানায়, তার কাছে কোনো টাকা নেই। পরে পেছনে থাকা আটক ব্যক্তিদের কাছ থেকে ৫০০ টাকা নিয়ে গ্যাস বিল দেওয়া হয়।’

ইদ্রিছ বলেন, সন্ধ্যায় তাঁদের তিনজনকে ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল উপজেলার বগমারা এলাকায় গাড়ি থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়। সেখান থেকে রাতে বাসায় ফেরেন। কাশিমপুরের আবদুল আজিজ মাস্টারসহ বাকি তিনজনকে নিয়ে ভালুকার দিকে চলে যায়।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে গাজীপুরের পুলিশ সুপার হারুন-অর রশিদ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিএনপির কোনো এজেন্টকে আটক বা তুলে নেওয়ার কোনো তথ্য আমার কাছে নেই। কারও বিরুদ্ধে স্পষ্ট অভিযোগ থাকলে তো পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পারে। আসামি ধরে নিয়ে ছেড়ে দেব কেন?’

বাড়ি থেকে তোলার গল্প
ভোটের দিন সকাল সাতটার দিকে উত্তর ধীরাশ্রমের বাসা থেকে পুলিশ তুলে নিয়ে যায় তরুণ আইনজীবী সেলিম রেজাকে। তিনি ধানের শীষের একজন এজেন্ট। ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, এমন সময় পুলিশ এসে তাঁকে ধরে নিয়ে যায়। তড়িঘড়ি করে তাঁকে একটি মাইক্রোবাসে তুলে পুলিশ লাইনে নেওয়া হয়। মঙ্গলবার বিকেল চারটার পর তিনিসহ নয়জনকে একটি গাড়িতে তুলে কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ার পরিষদ রোডে নামিয়ে দেওয়া হয়।

সেলিম রেজা গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ওরা যখন রাস্তায় নামিয়ে দেয়, তখন তাঁর কাছে টাকা ছিল না। বাসায় ফোন করলে বিকাশে এক হাজার টাকা নিয়ে তারপর তিনি রাতে বাড়ি ফেরেন।

কারাগারে পাওয়া গেছে যাঁদের
ভোটের আগের দিন সন্ধ্যায় শহরের ধীরাশ্রম এলাকা থেকে ছয়জনকে তুলে নিয়ে যায় সাদাপোশাকের পুলিশ। তাঁরা হলেন আনোয়ার হোসেন, কবির হোসেন, মজিবুর, হেলেন বাদশা, আলমগীর ও মোশাররফ বাদশা। একই সময় সামন্তপুর এলাকা থেকে আমির, ইকবালসহ চারজনকে তুলে নেওয়া হয়। গতকাল বুধবার তাঁদের সন্ধান পাওয়া গেছে যে তাঁরা ঢাকার কেরানীগঞ্জে কেন্দ্রীয় কারাগারে আছেন।