আহত তরিকুলকে সরকারি হাসপাতাল ছাড়তে হলো

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের হামলায় আহত তরিকুলকে গতকাল রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।  ছবি: প্রথম আলো
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের হামলায় আহত তরিকুলকে গতকাল রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ছবি: প্রথম আলো
>
  • তরিকুল বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতা
  • কদিন আগে তরিকুল হামলার শিকার হন
  • অভিযোগ ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে
  • গতকাল বিকেলে তরিকুলকে হাসপাতাল ছাড়তে বলা হয়

ভাঙা পা। সারা গায়ে ব্যথা। দুই-তিনজন না ধরলে উঠে বসতেও পারছেন না। এই অবস্থায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ছুটি দেওয়া হয়েছে তরিকুল ইসলামকে। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে তরিকুলকে রাজশাহী নগরের লক্ষ্মীপুর এলাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তাঁর ছোট বোন দুঃখ করে বলছিলেন, ‘ভাই কী অপরাধ করেছে। ভাই কি সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসাটাও পাবে না!’

তরিকুল ইসলাম বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক। আহ্বায়ক ছাড়া এই কমিটির সবাই যুগ্ম আহ্বায়ক। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র। তাঁকে গুরুতর আহত অবস্থায় গত মঙ্গলবার রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৩১ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়েছিল। সেদিনই তাঁর ঊরু থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত ব্যান্ডেজ করে দেওয়া হয়।

গতকাল দুপুরে কথা বলার জন্য হাসপাতালে গেলে তরিকুলের বড় ভাই তৌহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সাংবাদিক পরিচয় পেলে পুলিশ কাউকেই তরিকুলের সঙ্গে কথা বলতে দিচ্ছে না।

তখনই নগরের মতিহার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহাদাত হোসেন খানের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয়। তরিকুলের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগ অথবা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোনো মামলা বা অভিযোগ দিয়েছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোনো অভিযোগ নেই। তাহলে কেন তাঁকে পুলিশ হেফাজতে রাখা হয়েছে, এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নিরাপত্তার জন্যই তাঁকে পুলিশি হেফাজতে রাখা হয়েছে। তাহলে কেন পুলিশ কথা বলতে দিচ্ছে না জানতে চাইলে তিনি বলেন, কথা বলতে তো বারণ করা হয়নি। তারপরই তরিকুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়। তখনো পুলিশ বাইরে বসা ছিল। অবশ্য ততক্ষণে দায়িত্বরত চিকিৎসক তাঁকে ছাড়পত্র দিয়ে গেছেন। তরিকুলের ছোট বোন ফাতিমা খাতুন বলেন, তাঁরা কাকুতি-মিনতি করে বলছেন যে তাঁর ভাই হাসপাতাল থেকে যাওয়ার মতো সুস্থ হননি। তবু হাসপাতালের কেউ তাঁদের কথা শুনছেন না। তিনি বলেন, চাকরি নয়, সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাটাও কি তাঁরা পাবেন না!

হাসপাতাল ছাড়ার আগে তরিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা দুই ভাই ও এক বোন লেখাপড়া করেন। বাবা কৃষিকাজ করেন। বাবার একার পক্ষে তিন ভাইবোনের পড়াশোনার খরচ চালানো খুবই কষ্টকর হয়। তিনি বলেন, ‘খুব বড় একটা স্বপ্ন ছিল পাস করে বিসিএস পরীক্ষা দেব। একজন বিসিএস ক্যাডার হব। বাবার কষ্ট...’ এটুকু বলার পর তিনি আর কোনো কথা বলতে পারেননি। কাঁদতে থাকেন। একটু পর স্বাভাবিক হন।

হামলাকারীদের চেনেন কি না, জানতে চাইলে তরিকুল বলেন, তিনি কাউকে চেনেন না। পরে ভিডিও দেখে সহপাঠীরা তাঁদের পরিচয় জানতে পেরেছেন। তিনি জেনেছেন মিশু নামের একজন তাঁকে প্রথম আঘাত করেছিলেন। হাত দিয়ে ঠেকাতে গেলে সেটি এসে তাঁর ঠোঁটের ওপর লাগে। এরপর কয়েকজন মিলে পেটাতে শুরু করেন। তরিকুল বলেন, ‘আমি কাকুতি-মিনতি করে বলেছি আমাকে আর মারবেন না। আমি মরে যাব। তবু কেউ ছাড়েনি। শেষ পর্যন্ত আমার জ্ঞান ছিল। আমি যখন নড়ার শক্তি হারিয়ে ফেলেছি তখনো একজন এসে লাঠি দিয়ে একটা বাড়ি দিয়ে গেল। আমি আর কথা বলতে পারিনি।’

গতকাল বিকেল চারটার দিকে তরিকুলকে হাসপাতাল ছাড়তে বলা হয়। তিন-চারজন ধরে তাঁকে হাসপাতালের বিছানা থেকে ট্রলিতে তোলেন। তখন ব্যথায় কাতরাচ্ছিলেন তিনি। হাসপাতালের বাইরে ট্রলি থেকে নামিয়ে একটি ভ্যানে তোলা হয়। ভ্যানে করেই তাঁকে নগরের লক্ষ্মীপুরে অবস্থিত একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই হাসপাতালের দায়িত্বশীল একজন চিকিৎসক নিজের নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, তরিকুলের একটা পা ভেঙে গেছে। তাঁর অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন পড়তে পারে। তবে ব্যথা কমলে আবার এক্স-রে করার পরে তাঁরা নিশ্চিত হয়ে বলতে পারবেন। এ জন্য সময় লাগবে। কত সময় লাগতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখনো এক-দুই সপ্তাহ লাগতে পারে।

স্বজনদের আপত্তির মুখে কেন এই রোগীকে ছাড়পত্র দেওয়া হলো, জানতে চাইলে অর্থোপেডিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সুব্রত কুমার প্রামাণিক প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের রোগীর ক্ষেত্রে যা চিকিৎসা প্রয়োজন, তাই দেওয়া হয়েছে। যদি ‘পজিশন’ ঠিক থাকে, তাহলে এই ব্যান্ডেজেই ঠিক হয়ে যাবে। ১৫ দিন পর তাঁরা এক্স-রে করে দেখবেন। সব রোগীকেই এই অবস্থায় ছুটি দেওয়া হয়।

তরিকুলকে হাতুড়িপেটা করছেন ছাত্রলীগ কর্মী আবদুল্লাহ আল মামুন। ২ জুলাই বিকেলে।  ছবি: প্রথম আলো
তরিকুলকে হাতুড়িপেটা করছেন ছাত্রলীগ কর্মী আবদুল্লাহ আল মামুন। ২ জুলাই বিকেলে। ছবি: প্রথম আলো

হামলাকারীদের পরিচয়
ভিডিও দেখে হামলাকারীদের পরিচয় পাওয়া গেছে। কয়েকজন হামলার অভিযোগ স্বীকারও করেছেন। হাতুড়ি দিয়ে শিক্ষার্থী তরিকুল ইসলামের ওপর হামলা চালান বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সহসম্পাদক আবদুল্লাহ আল মামুন। তাঁর বাড়ি রাজশাহীর পবা উপজেলার হরিয়ান এলাকায়। আবদুল্লাহ আল মামুনকে ফোন করা হলে তিনি ফোন ধরেননি।

হামলার সময় রামদা হাতে দেখা গেছে লতিফুল কবির ওরফে মানিককে। তিনি ইতিহাস বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী ও মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কমান্ডের নেতা। তাঁর বাড়ি লালমনিরহাট বলে জানা গেছে।

বড় লাঠি হাতে হামলা চালিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান ওরফে মিশু। তাঁর বাড়ি রাজশাহীর পবা উপজেলার কাটাখালী এলাকায়। হামলার ব্যাপারে জানতে চাইলে মেহেদী হাসান প্রথম আলোকে বলেন, তিনি প্রথম আঘাত করেননি। ভিডিওটা প্রথম থেকে দেখলে বোঝা যাবে। তবে হামলায় ছিলেন বলে স্বীকার করেন।

তরিকুল ইসলামের মাথায় লাথি মারতে দেখা যায় ইতিহাস বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী রমিজুল ইসলাম ওরফে রিমুকে। তিনি ছাত্রলীগের সহসভাপতি। তাঁর বাড়ি নাটোর বলে জানা গেছে। রমিজুল ইসলাম স্বীকার করেছেন তিনি হামলার সময় ঘটনাস্থলে ছিলেন।

এ ছাড়া পরিচয় পাওয়া গেছে হামলাকারীদের এমন আরও ছিলেন, আইন বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হাসান লাবন, ফলিত গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সহসভাপতি আহমেদ সজিব ও বঙ্গবন্ধু হল শাখার সহসভাপতি মিজানুর রহমান সিনহা।

হামলার বিষয়ে ছাত্রলীগের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোটা আন্দোলনের নামে সেদিন যাঁরা এসেছিলেন তাঁদের ভেতরে প্রচুর শিবির ঢুকে পড়েছিল। তারা পতাকা বহনের নামে লাঠি বহন করছিল। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে চেষ্টা করা হচ্ছিল কেউ যেন কোটা আন্দোলনের নামে বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্থিতিশীল করতে না পারে।’

তরিকুলের ওপরে হামলার বিষয়ে তিনি বলেন, ওদের মোকাবিলা করতে গিয়েই ওই ঘটনাটি ঘটেছে। তাদের মোকাবিলা না করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ অস্থিতিশীল হয়ে যেত। এ ব্যাপারে জড়িত ছাত্রলীগের কোনো নেতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না, জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ড. ফরিদ খান কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপরে হামলার প্রতিবাদে নগ্ন পায়ে শহীদ জোহার মাজারে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের নৃশংস ঘটনা যারাই ঘটাক, ছাত্রলীগ হোক বা অন্য কেউ, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত, যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা না ঘটে।

এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের ১৪ জন শিক্ষক গতকাল বৃহস্পতিবার গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে সংবাদ সম্মেলন করে এ হামলার বিচার দাবি করেছেন।