পুলিশ পরিদর্শক মামুনকে খুনে জড়িত ১০-১২ জন শনাক্ত

মামুন ইমরান খান
মামুন ইমরান খান

বৃদ্ধ জায়েদা বেগম বললেন, ‘কোথায় গেলি মামুন? তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে আই।’ বউমা নূর জাহান তখন শাশুড়িকে বলেন, ‘মামুন আর কোনো দিন বাসায় ফিরবে না মা।’ ঢাকার পুলিশের বিশেষ শাখায় (এসবি) পুলিশ পরিদর্শক হিসেবে কর্মরত মামুন ইমরান খান ওরফে মামুনের লাশ পাওয়া গেছে গতকাল মঙ্গলবার গাজীপুরের জঙ্গলে।

মামুনের পরিবার বলছে, গত রোববার (৮ জুলাই) অফিস শেষে ঢাকার বাসাবোর বাসায় ফেরেন বিকেলে। সন্ধ্যার দিকে মোটরসাইকেল নিয়ে বেরিয়ে যান। যেখানেই তিনি থাকেন না কেন, রাত ১০টার আগেই বাসায় ফিরে আসেন। তবে সেদিন রাত ১২টা বাজলেও বাসায় ফেরত আসেনি মামুন।

তখন তাঁর বড় ভাই জাহাঙ্গীর মামুনের মোবাইলে ফোন দিলে বন্ধ পান। পরদিন (৯ জুলাই) সকালে জাহাঙ্গীর সবুজবাগ থানায় হাজির হয়ে মামুনের বাসায় না ফেরার কথা জানিয়ে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। তদন্তের দায়িত্ব সবুজবাগ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. সালাহ উদ্দিন। নিখোঁজ সংবাদ পাওয়ার পর আর পাঁচটা ঘটনা যেভাবে তদন্ত করতে হয়, সেভাবে তদন্ত শুরু করেন এসআই সালাহ উদ্দিন। 

বুধবার দুপুরে সালাহ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রথমে মামুন স্যারের মোবাইল নম্বর থেকে সর্বশেষ কোন জায়গা থেকে কথা হয়েছে, তা খুঁজে বের করি। দেখি, মামুন স্যারের সর্বশেষ অবস্থান বনানীর চেয়ারম্যান বাড়ি এলাকা।’
পুলিশ কর্মকর্তা মামুনের নিখোঁজ সংবাদ পাওয়ার পর তদন্তে নামে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। মামুনের মোবাইল ফোনের সূত্র ধরে মামুনকে যে বাসায় ফেলে খুন করা হয়, তা জানতে পারে ডিবি। মামুন হত্যার প্রধান সন্দেহভাজন রহমত উল্লাহ নামের একজনকে শনাক্ত করতে সক্ষম হয়।

কোথায় খুন হন মামুন
বনানীর চেয়ারম্যানবাড়ি এলাকার একটি বাসাতে ফেলে মামুনকে খুন করা হয়। বনানী থানার কাছাকাছি এলাকাতে বাসাটির অবস্থান। ছয়তলা বাসার মালিক সাবেক একজন প্রতিমন্ত্রী। সপরিবারে তিনি সেখানে বসবাস করেন। বাসাটির দুই পাশে বড় কোনো ভবন নেই। বাঁ পাশে খোলা জায়গা। সামনে তিনটি গাড়ি কেনাবেচার শোরুম।
দুই মাস আগে নজরুল ইসলাম নামের এক লোক বাসার দুই তলার একটি কক্ষ ভাড়া নেন। বাসার ব্যবস্থাপক মিরাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ভাড়া নেওয়ার পর বাসায় কেউ থাকতেন না। দিদার নামের এক নিরাপত্তারক্ষী ওই বাসাতে থাকতেন। দু–একটি চেয়ার-টেবিল ছাড়া আর কিছুই ছিল না বাসার মধ্যে। মাঝেমধ্যে শেখ ঋদি নামের এক লোক সেখানে আসতেন।
মিরাজুল জানান, গতকাল ভোরে পুলিশ বাসায় আসে। বাসার এক নিরাপত্তারক্ষীকে নিয়ে গেছেন। কারণ, সেদিন রাতে তিনিই দায়িত্বে ছিলেন।
মামুন যে ফ্ল্যাটে খুন হয়েছেন, এর পাশের ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছেন এম এ বাশার। বাসাতেই ফুলের দোকান বসিয়েছেন তিনি। বাশার বললেন, পাশের ফ্ল্যাটে কী হয়েছে, সে খবর তিনি জানেন না। তবে বাসায় মাঝেমধ্যে লোকজনের আসা-যাওয়া ছিল। বাসার ব্যবস্থাপক মাইনও দাবি করেন, সেদিন কী ঘটেছিল, তা তিনি জানেন না।
বাসার ব্যবস্থাপক জানান, গতকাল পুলিশ বাসার তালা ভেঙে ভেতরে ঢোকে। পরে বাসায় পুলিশ তালা ঝুলিয়ে দিয়ে গেছে।
সাবেক প্রতিমন্ত্রীর বাসায় ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা (সিসি ক্যামেরা) না থাকলেও বাসার সামনের দুটি গাড়ির শোরুমের সামনে আছে ক্যামেরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা প্রথম আলোকে জানান, পুলিশ গতকালই সেদিনকার সিসিটিভির ভিডিও ফুটেজ নিয়ে গেছে। বলে গেছে, এক পুলিশ কর্মকর্তাকে বাসায় খুন করা হয়েছে। রাতেও সিসিটিভি চালু ছিল। কোন গাড়ি কখন কীভাবে ঢুকেছিল, কে কীভাবে ঢুকেছে, তা সবই আছে।
বাসার মালিক সাবেক ওই প্রতিমন্ত্রী প্রথম আলোকে বলেন, বাসায় সেদিন কী ঘটেছে. তা তিনি জানেন না। গতকাল পুলিশ এসেছিল। পুলিশ যেসব তথ্য চেয়েছিল, তা দেওয়া হয়েছে। তদন্তে তিনি সহায়তা করবেন।

কীভাবে খুন, কখন খুন
মামুনের পরিবার বলছে, মামুন ছোটবেলা থেকে সংস্কৃতিমনা। নাটকের অভিনয় করতে ভালোবাসেন। বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে মামুনের একাধিক নাটক প্রচারিত হয়েছে। বাসার ব্যবস্থাপক মিরাজ জানান, বাসা নেওয়ার সময় মালিকেরা বলেন, বাসায় মাঝেমধ্যে আসতেন শেখ হৃদি। মাঝেমধ্যে তিনি তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে বাসায় আসতেন। আরও অনেক লোক বাসায় আসা-যাওয়া করত।
মামুনকে এর আগে কোনো দিন এ বাসায় আসতে দেখেননি বলে জানান মিরাজ। মামুন খুনে আটক রহমত উল্লাহ পুলিশ কর্মকর্তা মামুনের পূর্বপরিচিত। রহমত থাকেন আশকোনা এলাকায়। কীভাবে খুন করা হয়, সে ব্যাপারে ডিবির পরিদর্শক শেখ মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সন্ধ্যার পর রহমতই মামুনকে নিয়ে ওই ফ্ল্যাটে ঢোকেন। তখন সেখানে ১০ থেকে ১১ জন লোক ছিল। একপর্যায়ে মামুনের সঙ্গে হাতাহাতি হয়। মামুন তখন পরিচয় দেন, তিনি পুলিশ পরিদর্শক। তখনই সবাই মিলে রাত সাড়ে নয়টার দিকে মামুনকে শ্বাসরোধে হত্যা করে।
পুলিশ কর্মকর্তা শেখ মাহবুবুর বলেন, মধ্যরাতে মামুনের লাশ তোলা হয় প্রাইভেটকারে। পরে পেট্রল দিয়ে লাশ আগুনে পুড়িয়ে ফেলে আসে জঙ্গলে। মামুনকে যাতে কেউ চিনতে না পারে, সে জন্য এ ব্যবস্থা করে খুনিরা।
বাসার এক লোক প্রথম আলোকে বলেন, রাত ১২টার পর একটি কালো রঙের গাড়ি বাসায় ঢুকেছিল।
কারা ওই বাসায় আসা-যাওয়া করতেন, তা ঠিকমতো লেখা যে হতো না তার প্রমাণ মিলেছে খাতায়। দেখা গেল, ৮ জুলাই রাতে মামুন যে ফ্ল্যাটে খুন হন, সেই বাসায় কারা ঢুকেছিল, তাদের নাম উল্লেখ নেই। তবে খাতায় দিদার ও হৃদয় নামের দুজনের নাম আছে। এই দুজন যে মামুন খুনে জড়িত ছিলেন, সে প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ।
এ ছাড়া মামুন খুনে জড়িত—এমন আটজনের নাম পুলিশ জানতে পেরেছে। এদের মধ্যে আছে তিনজন নারী। বনানী থানা সূত্র বলছে, গতকাল দিবাগত রাতে নিহত মামুনের বড় ভাই জাহাঙ্গীর ১০ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেছেন। রহমত উল্লাহ, স্বপন, দিদার, মিজান, আতিক, শেখ হৃদয়, রবিউল, সুরাইয়া আক্তার রেখা, মেহেরুন নেসা ও ফারিয়া বিনতে মিম।
কী জন্য সেদিন অনেক লোক ফ্ল্যাটে জড়ো হয়েছিল, তা বলতে পারেননি বাসার ব্যবস্থাপক মিরাজ।

কেন খুন
মামুনের জন্ম, বেড়ে ওঠা—সবই ঢাকায়। তবে তাঁর গ্রামের বাড়ি নবাবগঞ্জে। বাবা আজহার আলী খান রেলে চাকরি করতেন। পরিবার নিয়ে ঢাকায় থাকতেন।
আজহার ও জায়েদা দম্পতির পাঁচ ছেলে ও এক মেয়ে। মামুন সবার ছোট। ১৫ বছর ধরে বাসাবোতে বড় ভাই জাহাঙ্গীরের ভাড়া বাসায় থাকেন।
তাঁর ভাবি নূর জাহান কিংবা ভাই জাহাঙ্গীর ধারণাও করতে পারছেন না মামুনকে কেন খুন করা হলো। ভাবি নূর জাহান জানালেন, এক বছর আগে মিশন থেকে ফিরে আসে মামুন। তাঁর বিয়ের জন্য কয়েকটা মেয়েও দেখা হয়। কিন্তু পছন্দ হয়নি। তা ছাড়া অর্থ কিংবা অন্য কোনো বিষয়ে কারও সঙ্গে মামুনের বিরোধ আছে কি না, তা তাঁদের জানা নেই। মামুন তাঁর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কোনো তথ্য তাঁদের জানাতেন না। বাসায় আসার পর বড় ভাইয়ের মেয়ে ও মায়ের সঙ্গে সময় কাটাতেন।
মামুনকে কেন খুন করা হলো, সে ব্যাপারে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার (পূর্ব) খোন্দকার নুরুন্নবী প্রথম আলোকে বলেন, মামুন কেন খুন হলো, তার সুনির্দিষ্ট কারণ জানার সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে। কারা কারা জড়িত ছিল, তা মোটামুটিভাবে জানা গেছে। তাদের সবাইকে গ্রেপ্তার করে বিচারের মুখোমুখি করা হবে।