বন্ধুর আমন্ত্রণে গিয়ে খুন হন পুলিশ কর্মকর্তা

মামুন ইমরান
মামুন ইমরান
>
  • মামুনকে হত্যা করা হয় বনানীর একটি ফ্ল্যাটে 
  • মামুনের লাশ গাজীপুরের একটি বাঁশঝাড়ে ফেলা হয়
  • পেট্রল দিয়ে বস্তায় থাকা লাশে আগুন দেওয়া হয় 
  • মঙ্গলবার পুলিশ মামুনের পোড়া লাশ উদ্ধার করে
  • মামুনকে হত্যায় ১০ জনের বিরুদ্ধে মামলা

বন্ধু রহমত উল্লাহর সঙ্গে বনানীর একটি বাসায় আড্ডায় গিয়েছিলেন পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) পরিদর্শক মামুন ইমরান খান (৩৪)। সেখানে যাওয়ার পর বুঝতে পারেন চক্রের ফাঁদে পড়েছেন। চক্রটির লক্ষ্য ছিল রহমত উল্লাহকে ভয়ভীতি দেখিয়ে আপত্তিকর ছবি তুলে ‘ব্ল্যাকমেল’ করা। কিন্তু মামুন সেখানে থাকায় তাঁদের পরিকল্পনায় বিঘ্ন ঘটে। চক্রের লোকজন তাঁদের দুই বন্ধুকেই বেদম মারধর করেন। একপর্যায়ে পুলিশ কর্মকর্তা মামুন মারা যান।

মামুন হত্যা মামলার তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ঘটনার এমন বর্ণনাই দিয়েছেন। তাঁরা বলছেন, হত্যার পর লাশ গুমের কাজে চক্রটির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন মামুনের বন্ধু রহমত উল্লাহ। রহমতের গাড়িতে করেই বস্তায় ভরে মামুনের লাশ গাজীপুরের কালীগঞ্জের উলুখোলায় একটি বাঁশঝাড়ে ফেলা হয়। এরপর সাত লিটার পেট্রল ঢেলে বস্তার ওপর আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। গত মঙ্গলবার গাজীপুরের কালীগঞ্জ থানার পুলিশ মামুনের পোড়া লাশ উদ্ধার করে।

পুলিশ বলছে, মামুনকে হত্যা করা হয়েছে বনানীর একটি বাড়ির দোতলার ফ্ল্যাটে। এ ঘটনায় রহমতসহ ১০ জনের নাম উল্লেখ করে বনানী থানায় হত্যা মামলা করেছেন মামুনের ভাই জাহাঙ্গীর আলম খান। রহমতকে গ্রেপ্তার দেখিয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের পূর্ব বিভাগ। রহমত পেশায় প্রকৌশলী। ঢাকা মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মাসুদুর রহমান জানিয়েছেন, গতকাল আদালত রহমতকে সাত দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দিয়েছেন।

রহমত ছাড়া মামলার বাকি নয় আসামি হলেন শেখ হৃদয় ওরফে আপন, স্বপন, দিদার, মিজান, আতিক, রবিউল, সুরাইয়া আক্তার ওরফে কেয়া, মেহেরুন নেসা স্বর্ণা ওরফে আফরিন এবং ফারিয়া বিনতে মীম ওরফে মাইশা। আসামির তালিকায় থাকা তিন নারী মডেল হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিয়ে থাকেন বলে জানিয়েছে পুলিশ।

পুলিশ জানায়, নিহত মামুন অবিবাহিত, তিনি মধ্য বাসাবো এলাকায় বড় ভাই জাহাঙ্গীরের সঙ্গে থাকতেন। মামলার এজাহারে নিহত মামুনের বড় ভাই উল্লেখ করেছেন, গত রোববার বিকেলে অফিস থেকে বাসায় ফেরেন মামুন। এরপর সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে তিনি বের হন। রাতে আর ফেরেননি। পরদিন সোমবার দুপুরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন তিনি অফিসে যাননি। এরপর তিনি বিষয়টি এসবি কর্তৃপক্ষকে জানান এবং এ বিষয়ে সবুজবাগ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন।

তদন্তসংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, রোববার সন্ধ্যায় মামুন তাঁর বন্ধু রহমত উল্লাহকে ফোন করেছিলেন। রহমত তখন নিজের গাড়িতে বনানীতে বান্ধবী আফরিনের আমন্ত্রণে পার্টিতে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন। তিনি মামুনকেও সেখানে আসতে বলেন। মোটরসাইকেল নিয়ে মামুন সেখানে যান। সেখানে আগে থেকেই কয়েকজন নারী-পুরুষ ছিলেন, যাঁরা রহমতের পূর্ব পরিচিত।

পুলিশ বলছে, গ্রেপ্তার রহমত জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন ওই বাড়িটি ভাড়া নিয়ে একটি চক্র ব্ল্যাকমেলিংয়ের ব্যবসা ফেঁদেছিল। তবে তিনি বিষয়টি বুঝতে পারেননি। তাঁদের সেদিনের শিকার ছিলেন রহমত। সে কারণে তাঁরা রহমতের সঙ্গে মামুনকে প্রত্যাশা করেননি। সেখানে যাওয়ার পর তাঁরা রহমতকে জবরদস্তি করা শুরু করেন নারীদের সঙ্গে আপত্তিকর ছবি তোলার জন্য। রহমত বাধা দিলে শুরু হয় মারধর। মামুন ঠেকাতে গেলে তাঁকেও মারধর করা হয়। একপর্যায়ে মামুন পুলিশ হিসেবে নিজের পরিচয় দেন, পরিচয়পত্রও দেখান। মারধর কিছুক্ষণের জন্য থামে। এরপর চক্রের অন্তত তিনজন মিলে মামুনকে মারধর শুরু করলে একপর্যায়ে তিনি ঢলে পড়েন। তখন সবাই ভাবেন মামুন মারা গেছেন।

তদন্তসংশ্লিষ্ট ওই কর্মকর্তা বলেন, মামুনের মৃত্যুর পরে লাশ গুম করার পরিকল্পনা শুরু করেন চক্রের সদস্যরা। তখন লাশ গুমের পরিকল্পনায় চক্রের সঙ্গে যোগ দেন মামুনের বন্ধু রহমতও। রহমতের পরিকল্পনাতেই লাশটি প্রথমে বস্তায় ভরা হয়। সোমবার সকাল আটটার দিকে বস্তায় ভরা লাশটি দোতলা থেকে নামিয়ে মামুনকে রহমতের গাড়ির পেছনে তোলা হয়। এরপর তাঁরা গাজীপুরের দিকে রওনা হন। দিনভর গাজীপুরের বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাঘুরি করে লাশ ফেলার জায়গা খোঁজেন তাঁরা।

পুলিশ জানায়, একপর্যায়ে সন্ধ্যার আগে তাঁরা কালীগঞ্জের উলুখোলায় রাস্তার পাশের একটি বাঁশঝাড়ে বস্তাটি ফেলে দেন। আগে থেকে কিনে রাখা সাত লিটার পেট্রল বস্তার ওপর ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে তাঁরা সবাই ওই জায়গা ছাড়েন।

কর্মকর্তারা জানান, মামুন নিখোঁজ হওয়ার সংবাদ পেয়ে ডিবির পূর্ব বিভাগ তদন্ত শুরু করে প্রথমেই রহমত উল্লাহকে শনাক্ত করে। তাঁকে ধরেই তদন্ত এগিয়ে যায় ও অন্যদের শনাক্ত করা হয়। বনানীর যে ফ্ল্যাটটিতে হত্যার ঘটনা ঘটেছে, সেটি তালা মেরে রেখেছে ডিবি।

আসবাব ছাড়া বাড়িতে পার্টি
গতকাল বনানীর ওই বাড়িতে গিয়ে জানা যায়, বাড়িটির মালিক সাবেক মন্ত্রী ও বিএনপি নেতা আলমগীর কবীর। নজরুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তির নামে গত মে মাসে মাসিক ৪৫ হাজার টাকায় বাড়িটি ভাড়া নেওয়া হয়। সেখানে বায়িং হাউস, মায়ের আঁচল নামের একটি বৃদ্ধাশ্রম ও ‘মিডিয়া অফিস’ করার কথা বলেছিলেন ভাড়াটেরা। দুই জোড়া টেবিল-চেয়ার ও একটি তোশক নিয়ে বাড়িটিতে ওঠেন ভাড়াটেরা। নজরুলের নামে বাড়ি ভাড়া নেওয়া হলেও এখানকার কার্যালয় দেখভাল করতেন শেখ হৃদয়। দিদার নামে তাঁর একজন কর্মী এখানে সার্বক্ষণিক থাকতেন।

বাড়িটির তত্ত্বাবধায়ক মিরাজ বলেন, মে মাসে ভাড়া নেওয়ার পর থেকে তাঁরা কোনো আসবাবও আনেননি। ভাড়াও দিচ্ছিলেন না। এ কারণে তাঁদের বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দেন মালিক। তবে তাঁরা সব ভাড়া একসঙ্গে পরিশোধ করে ১৬ জুলাই থেকে ওই ফ্ল্যাটের ডেকোরেশন শুরু হবে বলে জানিয়েছিলেন।

ওই বাড়িটিতে গিয়ে কথা বলার সময় কিছু গাড়িচালক জড়ো হন। তাঁরা জানান, ওই ভাড়াটেরা আসার পর থেকে প্রায়ই মোটরসাইকেলে করে তরুণেরা ওই বাড়িতে তরুণীদের নিয়ে আসতেন। গাড়িতে করেও তরুণ-তরুণীদের আনাগোনা ছিল।

বাড়িটিতে কোনো সিসি ক্যামেরা নেই। ঘটনার পর পুলিশ ওই বাড়ির এক নিরাপত্তাকর্মীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে গেছে।

আরও পড়ুন:
পুলিশ পরিদর্শক মামুনকে খুনে জড়িত ১০-১২ জন শনাক্ত