বনভূমির পরিমাণ নিয়ে বিতর্ক

রোহিঙ্গা বসতি স্থাপনের জন্য চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে উজাড় হয়েছে পাঁচ হাজার একর বনভূমি। কক্সবাজারেরই আরেক উপজেলা মহেশখালীর সংরক্ষিত বনের ২০০ একর জায়গা গত মে মাসে অধিগ্রহণ করা হয়েছে অপরিশোধিত তেলের ডিপো ও পাইপলাইন স্থাপনের জন্য। দেশের বিভিন্ন এলাকায় বনের জায়গায় গড়ে উঠছে অর্থনৈতিক অঞ্চল ও বিদ্যুৎকেন্দ্র। এ অবস্থায় দেশে প্রাকৃতিক বনভূমি কমবে, এটাই স্বাভাবিক।

জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থা (এফএও) চলতি মাসের ৯ জুলাই বনবিষয়ক এক প্রতিবেদনে (দ্য স্টেট অব গ্লোবাল ফরেস্ট-২০১৮) বলেছে, বাংলাদেশের মোট ভূখণ্ডের সাড়ে ১৩ শতাংশ বনভূমি। তবে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় এই তথ্য মানতে নারাজ। মন্ত্রণালয়ের দাবি, দেশের মোট আয়তনের ১৭ শতাংশ বনভূমি (বন ও বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা)।

প্রধান বন সংরক্ষক মোহাম্মদ সফিউল আলম চৌধুরীর দাবি, দেশে বনভূমি কমার কোনো কারণ নেই।

বনভূমি পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচ (জিএফও) ও ওয়ার্ল্ড রিসোর্স ইনস্টিটিউট (ডব্লিউআরআই) গত ২৭ জুন প্রকাশ করা এক প্রতিবেদনে বলছে, গত সাত বছরে বাংলাদেশে ৩ লাখ ৩২ হাজার একর বনভূমি উজাড় হয়েছে। প্রতিবেদনটির শিরোনামেও রয়েছে বাংলাদেশের নাম। এতে বলা হয়েছে, প্রতিবছর বিশ্বে বাংলাদেশের সমপরিমাণ বনভূমি উজাড় হয়ে যাচ্ছে।

জিএফও এবং ডব্লিউআরআইয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বনভূমি উজাড় হওয়ার দিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে চট্টগ্রাম অঞ্চল। ২০১০ সালে দেশের মোট বৃক্ষসম্পদের ৬০ শতাংশ ছিল এই এলাকায়। গত সাত বছরে তা কমে প্রায় ১০ শতাংশ হয়েছে।

দুটি আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিবেদনে তুলে ধরা তথ্য সঠিক বলে মনে করেন সাবেক প্রধান সংরক্ষক ইউনুস আলী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বিভিন্ন সরকারি সংস্থার নামেই প্রায় দুই লাখ হেক্টর বনভূমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। যার বেশির ভাগ চট্টগ্রাম বিভাগে। তাঁর দাবি, চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন জেলায় যেসব জেলা প্রশাসক দায়িত্ব পালন করেছেন, তাঁরা বন সংরক্ষণের বিষয়টি সঠিকভাবে অনুধাবন করেননি। ফলে তাঁরা আবাসন থেকে শুরু করে নানা প্রকল্পে বনের জমি বেশি করে বরাদ্দ দিয়েছেন। এ ছাড়া পার্বত্য চুক্তির পর সেখানে সরকারি কোনো একক সংস্থা বন ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নেই। ফলে পার্বত্য অঞ্চলেও দ্রুত বনভূমি কমছে।

দেশে বনভূমির পরিমাণ কমে যাওয়া এবং বনভূমির পরিমাণ প্রকাশ করা আন্তর্জাতিক দুটি সংস্থার তথ্য নিয়ে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে প্রথম আলো। বন বিভাগ এবং পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের দাবি, দেশে বনভূমি কমে যাওয়ার হিসাব সঠিক নয়। আর দেশে বনভূমির পরিমাণও মোট ভূখণ্ডের সাড়ে ১৩ নয়, ১৭ শতাংশের বেশি।

এ বিষয়ে পরিবেশ ও বনসচিব আবদুল্লাহ আল মোহসীন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে ও বিভিন্ন উন্নয়নকাজে বনের জমি ব্যবহৃত হচ্ছে। তাই সরকার বিদ্যমান বনভূমি রক্ষা করার পাশাপাশি বনের বাইরে বৃক্ষরোপণের উদ্যোগ নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে সফলতা এসেছে। ফলে দেশে বনভূমির পরিমাণ না কমে দিন দিন বাড়ছে বলে দাবি করেন তিনি।

বন খাতে এসডিজি পূরণ কঠিন হবে

ডব্লিউআরআই এবং জিএফওর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ২০১০ সালে বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকার পরিমাণ ছিল ১৮ লাখ হেক্টর, যা বাংলাদেশের মোট আয়তনের ১২ দশমিক ৯ শতাংশ।

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন করতে গেলে বাংলাদেশকে বনভূমির পরিমাণ ২২ শতাংশে নিয়ে যেতে হবে। জাতিসংঘের কাছে এই অঙ্গীকার করেছে সরকার।

বন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে বনভূমি বরাদ্দ দিতে থাকলে এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা পূরণ দুরূহ হয়ে যাবে।

প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থাগুলোর আন্তর্জাতিক জোট আইইউসিএন ২০১৭ সালে ফরেস্ট অ্যান্ড ওয়াটার (বন ও পানি) শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলেছে, বনভূমি শুধু জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক সম্পদের আধারই নয়, সুপেয় পানি ধরে রাখে বৃক্ষ। ফলে কোনো এলাকায় বনভূমি কমে গেলে সেখানে মরুকরণ, ভূমিধস ও প্রাকৃতিক বিপর্যয় বেড়ে যায়।

পরিবেশ ও বন নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা আরণ্যক ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, যেকোনো দেশের মোট ভূখণ্ডের ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকতে হয়। বাংলাদেশে তা নেই। এর মধ্যে প্রতিবছরই বন উজাড় হচ্ছে। বনের জমিতে কোনোভাবেই স্থাপনা গড়ে তোলা যাবে না। বন রক্ষায় সবার আগে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।