পরিবহন খাত মন্ত্রী সাংসদসহ আ.লীগের নেতাদের কবজায়

রাস্তায় আর কোনো আইনি নিয়ন্ত্রণই এখন নেই বললে চলে। প্রথম আলো ফাইল ছবি
রাস্তায় আর কোনো আইনি নিয়ন্ত্রণই এখন নেই বললে চলে। প্রথম আলো ফাইল ছবি
>
  • প্রভাবশালী রাজনীতিকেরা মালিক-শ্রমিক ইউনিয়নের নেতৃত্বে
  • বিআরটিএ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যবস্থা নেয় না
  • আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তা বেনামে ব্যবসায় যুক্ত
  • ক্ষমতার ছায়ায় থাকা চালকেরাও বেপরোয়া
  • সড়কে অকাতরে প্রাণ যাচ্ছে সাধারণ মানুষের

রাজধানীর বাসমালিক ও চালকদের নিয়ন্ত্রণ এখন সরকারি দল আওয়ামী লীগের হাতে। দলটির মন্ত্রী, সাংসদ, নেতা ও তাঁদের আত্মীয়রাই এখন এই খাতের মূল নিয়ন্ত্রক।

প্রভাবশালী রাজনীতিকেরা পরিবহনের মালিক কিংবা শ্রমিক ইউনিয়নের নেতৃত্বে থাকায় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও ফিটনেসবিহীন, রংচটা, অনুমোদনহীন পরিবহনের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয় না। ক্ষমতার ছায়ায় থাকা চালকেরাও হয়ে ওঠেন বেপরোয়া। ফলে সড়কে অকাতরে প্রাণ যাচ্ছে সাধারণ মানুষের।

দীর্ঘ বছর পরিবহনব্যবসার সঙ্গে যুক্ত একাধিক মালিক, পুরোনো চালকেরা জানান, রাজনৈতিক নেতাদের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তা, সদস্যরা বেনামে বাস, মিনিবাস ব্যবসায় যুক্ত হওয়ার পর পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। রাস্তায় আর কোনো আইনি নিয়ন্ত্রণই এখন নেই বললে চলে।

গত রোববার ফুটপাতে দাঁড়িয়ে বাসের জন্য অপেক্ষায় থাকা শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী যে বাসের চাপায় মারা যায়, শুরু থেকেই সেই জাবালে নূর পরিবহন কোম্পানির অন্যতম পরিচালক ছিলেন নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের শ্যালক সৈয়দ নুরুল হক ওরফে নান্নু। অবশ্য নুরুল হক প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, তিনি এখন আর এই কোম্পানিতে নেই। তিন বছর আগে বাস বিক্রি করে দিয়েছেন।

নৌমন্ত্রী সারা দেশের পরিবহনশ্রমিকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি। তাঁর ভাই হাফিজুর রহমানের মালিকানাধীন কনক পরিবহন ঢাকার তিনটি পথে চলে।

সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নাগরিকেরা প্রতিবাদ করলে পাল্টা হিসেবে শ্রমিকদের মাঠে নামিয়ে দেন মালিক-শ্রমিকনেতারা। গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে আদালত এক চালককে মৃত্যুদণ্ড এবং আরেকজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিলে নৌমন্ত্রী তাঁর সরকারি বাসায় বৈঠক করে ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত দেন। ওই বৈঠকে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির সভাপতি এবং পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী মসিউর রহমানও ছিলেন।

জানতে চাইলে শাজাহান খান গতকাল বুধবার প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, তাঁরা নেতৃত্বে আছেন বলেই পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা আসছে। দুর্ঘটনা কমছে। তিনি বলেন, রাজনৈতিক নেতা হলেই পরিবহন ব্যবসা করা যাবে না বা শ্রমিকনেতা হওয়া যাবে না, এটা তো ঠিক না। এটা তাঁদের পারিবারিক ব্যবসা।

শাজাহান খানের পর এ খাতের বড় নিয়ন্ত্রক ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ। তিনি ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ দক্ষিণ শাখার সহসভাপতিও।

জানতে চাইলে এনায়েত উল্যাহ প্রথম আলোকে বলেন, তিনি ৩৫ বছর ধরে পরিবহন ব্যবসা করছেন। বাংলাদেশের আইনে একটি নির্দিষ্ট পেশার লোক রাজনীতি করতে পারবে না, এমন তো নেই।

সরকারদলীয় দুজন সাংসদ পঙ্কজ নাথ, এ কে এম শামীম ওসমান এবং সাবেক দুই সাংসদ শাহিদা তারেখ ও আশরাফুন্নেছা মোশাররফ পরিবহন ব্যবসায় যুক্ত। এর বাইরে সাংসদের পরিবারের সদস্য, ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ এবং আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা, ঢাকা সিটি করপোরেশনের সরকার-সমর্থক কাউন্সিলরসহ ২০ থেকে ২৫ জনের বাস ব্যবসা আছে। সরকারি কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারাও আত্মীয়দের নামে বাস ব্যবসায় যুক্ত আছেন। মহানগর পুলিশের কয়েকজন বড় কর্মকর্তার আত্মীয়ের বাস রয়েছে কয়েকটি কোম্পানিতে। গত কয়েক বছরে একটি বিশেষ জেলার কিছু ব্যক্তি কয়েকটি নতুন পরিবহন কোম্পানি খুলেছেন।

এই মন্ত্রী, সাংসদ, নেতা ও প্রভাবশালী ব্যক্তির বেশির ভাগই বাস কোম্পানির মালিক হয়েছেন ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর। এর আগে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে সাবেক গণপূর্তমন্ত্রী মির্জা আব্বাসসহ সে সময়ের সরকারদলীয় সাংসদ-নেতারা ঢাকায় পরিবহন ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতেন। এখন তাঁদের বেশির ভাগই প্রত্যক্ষভাবে এই ব্যবসায় নেই।

নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের ভাই আজিজুর রহমান খানের নামে থাকা কনক পরিবহন প্রথমে মিরপুর পল্লবী থেকে আবদুল্লাহপুরের মধ্যে ২০টি বাসের অনুমতি পায়। পরে গাবতলী থেকে কালশী, আবদুল্লাহপুর হয়ে কামারপাড়া পর্যন্ত আরও ২০টি বাসের অনুমতি দেওয়া হয় এই কোম্পানিকে। সর্বশেষ মিরপুরের ধউর থেকে খিলক্ষেত হয়ে কমলাপুর পর্যন্ত ৩০টি বাস পরিচালনার অনুমতি পেয়েছে তারা।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর বিহঙ্গ পরিবহন কোম্পানি চালু করেন আওয়ামী লীগের সাংসদ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক পঙ্কজ নাথ। ঢাকা ও এর আশপাশে পাঁচটি রুটে এই কোম্পানির অধীনে ২৪০টি বাস চলাচলের অনুমতি দিয়েছে পরিবহন কমিটি।

নারায়ণগঞ্জের সরকারদলীয় সাংসদ এ কে এম শামীম ওসমানের পরিবহন কোম্পানির নাম জেড এন করপোরেশন। ঢাকার গুলিস্তান থেকে নারায়ণগঞ্জের পথে এই কোম্পানির শীতাতপনিয়ন্ত্রিত (এসি) ৫০টি বাস চলার অনুমতি পেয়েছে।

আরও যাঁরা বাসের মালিক
ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের সভাপতি মাইনুল হোসেন খান ওরফে নিখিল চলন পরিবহন কোম্পানির চেয়ারম্যান। মিরপুরের সাংসদ কামাল আহমেদ মজুমদারের ভাই আনোয়ার হোসেন মজুমদারের কোম্পানির নাম মোহনা পরিবহন। আনোয়ার মজুমদার ঢাকা মহানগর উত্তর শাখা আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক।

ঢাকা মহানগর উত্তর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর ফরিদুর রহমান ওরফে ইরান দেশ বাংলা পরিবহন কোম্পানির চেয়ারম্যান। পুলিশের সাবেক আইজি এ কে এম শহীদুল হকের ভাই এ কে এম ইসমাইল হকের পরিবহন কোম্পানির নাম গ্লোরী এক্সপ্রেস। শরীয়তপুর জেলা আওয়ামী লীগের এই নেতা নড়িয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানও।

সংরক্ষিত আসনের সাবেক নারী সাংসদ ও মহিলা লীগের সাবেক সভাপতি আশরাফুন নেছা মোশাররফের পরিবহন কোম্পানির নাম স্বপ্ন সার্ভিসেস। আওয়ামী মোটরচালক লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা মহানগর উত্তর শ্রমিক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক কালু শেখ তিন-চার বছরের মধ্যে তিনটি পরিবহন কোম্পানির অনুমোদন পেয়েছেন। এগুলো হচ্ছে ওয়েলকাম, মৌমিতা ট্রান্সপোর্ট ও স্বজন পরিবহন।

ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ উত্তর শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক জহিরুল হকের পরিবহন কোম্পানির নাম ভিআইপি ক্ল্যাসিক।

প্রজাপতি পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ছিলেন সাবেক নারী সাংসদ শাহিদা তারেখ (দীপ্তি)। এখনো ওই কোম্পানিতে তাঁর বাস চলে। মিরপুর ১৪ নম্বর থেকে সাভারের পথে চলা ক্যান্টনমেন্ট পরিবহনের এমডি পারভীন হোসেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক গাজী মেজবাউল হোসেনের বোন। ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক অজয় কর খোকনের পরিবহন কোম্পানির নাম এ কে পরিবহন।

সাধারণত প্রভাবশালী ব্যক্তি, রাজনীতিক ও প্রশাসনের সঙ্গে সুসম্পর্ক রয়েছে এমন ব্যক্তিরা চেয়ারম্যান বা এমডি হয়ে পরিবহন কোম্পানি খোলেন। তবে তাঁদের বাস খুব কম। একটিমাত্র বাসের মালিকও অনেক সময় প্রভাবশালী হওয়ায় কোম্পানির চেয়ারম্যান বা ব্যবস্থাপনা পরিচালক বনে যান। তাঁর অধীনে অন্য অনেক মালিক বাস চালান।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অংশীদার ব্যক্তিরা পরিবহন খাত যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করছেন, তাতে তাঁরা চাইলে এ খাতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারতেন। কিন্তু তাঁরা তাঁদের ক্ষমতাকে জনস্বার্থের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছেন। এ জন্য দুর্ঘটনায় প্রাণহানি, সড়কে বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য বাড়ছে।