সাক্ষী আসে না, ঝুলে আছে গোলা মামলা

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা ছাড়াও ঘাতকেরা বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত ও ভাগনে শেখ ফজলুল হক মণির বাড়িতে হামলা করে সেরনিয়াবাতের চার বছরের নাতি, শেখ মণির অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীসহ যাদের পেয়েছে, তাদেরই হত্যা করেছে। এ ছাড়া খুনিদের কামানের গোলায় মোহাম্মদপুরে শেরশাহ শুরি রোডের বাসায় ১৩ জন মারা যান। এসব ঘটনায় বঙ্গবন্ধু হত্যা ছাড়াও পৃথক তিনটি মামলা হয়। তবে এসব মামলা এখনো ঝুলে আছে।

এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল প্রথম আলোকে বলেন, বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা হত্যা মামলায় চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়েছে। আবদুর রব সেরনিয়াবাত হত্যা মামলার অভিযোগ ১৯৯৯ সালে গঠন করা হয়েছিল। পরে আসামিপক্ষের আবেদনে হাইকোর্ট মামলার কার্যক্রম স্থগিত করে দেন। তিনি বলেন, মোহাম্মদপুর শেরশাহ শুরি রোডের বাসায় কামানের গোলার আঘাতে ১৩ জন মারা যায়। সেই মামলাটিও সাক্ষীর অভাবে ঝুলে আছে। আর শেখ ফজলুল হক মণি হত্যা মামলায় সিআইডির তৎকালীন কর্মকর্তা মুন্সী আতিকুর রহমান চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছেন। মুন্সী আতিকুর রহমান বর্তমানে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার আসামি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট আদালতের সরকারি কৌঁসুলি আবদুস সাত্তার প্রথম আলোকে বলেন, কামানের গোলায় ১৩ জন মারা যাওয়ার মামলাটি এই আদালতে ছিল। বর্তমানে মহানগর দায়রা জজ-৪ আদালতে মামলা বিচারাধীন। আর আবদুর রব সেরনিয়াবাত হত্যা মামলাটিও তাঁর আদালতে নেই। তবে কোন আদালতে আছে জানতে চাইলে বলেন, তা বলতে পারব না।

মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বাইরে থেকে যাওয়া অনেক খুনিই এসব মামলার আসামি। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা থেকে হাইকোর্টের রায়ে যে তিন খুনিকে বাদ দেওয়া হয়, ওই তিন খুনি এসব মামলার আসামি। তিনি বলেন, এসব মামলার বিচার কার্যক্রম দ্রুত শেষ শেষ করা উচিত।

১৯৭৫ সালে ২৭ মিন্টো রোডের হত্যাকাণ্ড
বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি ও তৎকালীন পানি, সেচ এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাত থাকতেন ২৭ নম্বর মিন্টো রোডে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে খুনিরা অস্ত্রের মুখে জোর করে বাড়িতে ঢোকে।

বঙ্গবন্ধুর খুনি সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খান, আজিজ পাশা ও নুরুল হুদার নেতৃত্বে বাসার ভেতরে ঢুকে অস্ত্রের মুখে বাসার সব সদস্যকে ড্রয়িংরুমে জড়ো করে এবং আবদুর রব সেরনিয়াবাতসহ আটজনকে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে। সেদিন আবদুর রব সেরনিয়াবাতের ছেলে আরিফ সেরনিয়াবাত, মেয়ে বেবি সেরনিয়াবাত, চাচাতো ভাই শহীদ সেরনিয়াবাত, নাতি শুকান্ত হাসনাত বাবু (আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর ছেলে), গৃহপরিচারিকা লক্ষ্মীর মা, গৃহপরিচারক পোটকা ও আবদুর রহিম খান রিন্টু নিহত হন। সেদিন এই বাড়িতে ঘাতকের হামলায় আহত হন আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর মা আমেনা বেগম (বঙ্গবন্ধুর বোন), স্ত্রী সাহান আরা বেগম, ভাই আবুল খায়ের আবদুল্লাহ, বোন বিউটি সেরনিয়াবাতসহ আরও তিনজন।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। ওই বছরের ২১ অক্টোবর আবুল হাসানাতের স্ত্রী সাহান আরা বেগম বাদী হয়ে রমনা থানায় এই মামলা করেন। মামলায় মেজর শাহরিয়ার, মেজর আজিজ পাশা, ক্যাপ্টেন মাজেদ, ক্যাপ্টেন নূরুল হুদা হিরুকে আসামি করা হয়। ১৯৯৭ সালের ৩০ জুলাই ১৫ সাবেক সেনা কর্মকর্তাসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। তাঁরা হলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) সৈয়দ ফারুক রহমান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) আবদুল আজিজ পাশা, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) খন্দকার আবদুর রশিদ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) শরিফুল হক ডালিম, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) এস এইচ এম বি নূর চৌধুরী, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মহিউদ্দিন আহমেদ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) এম এ রাশেদ চৌধুরী, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খান, মেজর (অব.) বজলুল হুদা, মেজর (অব.) আহম্মদ শরফুল হোসেন, ক্যাপ্টেন (অব.) নুরুল হুদা, ক্যাপ্টেন (অব.) নাজমুল হোসেন, ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুল মাজেদ, ক্যাপ্টেন (অব.) কিসমত হাসেম ও তাহের উদ্দিন ঠাকুর।

ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত ১৯৯৯ সালের ৪ অক্টোবর অভিযোগ গঠন করেন। আসামিপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০০ সালের ফেব্রুয়ারিতে আসামি তাহের উদ্দিন ঠাকুর মামলাটির স্থগিতাদেশ চেয়ে উচ্চ আদালতে আবেদন করেন। উচ্চ আদালত তিন মাসের জন্য মামলার কার্যক্রম স্থগিত করেন। ২০০১ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার গঠনের পর এ স্থগিতাদেশ দফায় দফায় বাড়তে থাকে। ২০০৩ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি সরকারের প্রতি দেওয়া রুলের শুনানি না হওয়া পর্যন্ত মামলার কার্যক্রম স্থগিত করা হয়।

কামানের গোলা মামলা
১৯৯৬ সালে মামলা দায়েরের পর সাড়ে চার বছর তদন্ত করে ২০০১ সালের এপ্রিল মাসে ১৮ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। অভিযোগপত্রভুক্ত ১৮ আসামির মধ্যে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় পাঁচজনের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে ২০১০ সালে। তাঁরা হলেন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) সৈয়দ ফারুক রহমান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) সুলতান শাহরিয়ার রশিদ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) মহিউদ্দিন আহমেদ, মেজর (অবসরপ্রাপ্ত) বজলুল হুদা ও মেজর (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ। এই পাঁচজনসহ সাবেক তথ্যমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুরকে এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছিল।

মামলার বিবরণে জানা যায়, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আক্রমণের সময় খুনিদের নিক্ষেপ করা কামানের গোলা গিয়ে পড়েছিল মোহাম্মদপুর থানাধীন শেরশাহ শুরি রোডের ৮ ও ৯ নম্বর বাড়িতে। সেখানে নিহত হন রাজিয়া বেগম, তাঁর মেয়ে নাসিমা, হাবিবুর রহমান, আনোয়ারা বেগম, ময়ফুল বিবি, সাবেরা বেগম, আবদুল্লাহ, রফিকুল, সাবিয়া, সাহাবুদ্দিন, আমিনুদ্দিন, কাশেদা, দুই বছরের শিশু আনোয়ারা এবং অজ্ঞাত একজন। এ ঘটনায় আহত হন ১৭ জন। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে ১৯৯৬ সালের ২৯ নভেম্বর রাজিয়ার স্বামী মোহাম্মদ আলী একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। থানা পুলিশের হাত ঘুরে মামলার তদন্তের দায়িত্ব পায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তদন্ত শেষে সিআইডি ২০০১ সালের ৩০ এপ্রিল ১৮ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয়।

ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে মামলাটি বিচারাধীন। ২০০৪ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশেষ এজলাস ব্যবহারের অনুমতি চাওয়া হলে ২০০৭ সালে আইন মন্ত্রণালয় অনুমোদন দেয়। এ পর্যন্ত ৫৮ সাক্ষীর মধ্যে ১৫ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন। বর্তমানে সাক্ষী না আসায় মামলাটি ঝুলে আছে।

শেখ মণির বাসায় হত্যাযজ্ঞ
খুনিরা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ ফজলুল হক মণির বাসায়ও আক্রমণ চালানো হয়। ওই সময় তারা খুন করে শেখ মণি ও তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণিকে। ১৯৯৬ সালের ২০ নভেম্বর ধানমন্ডি থানায় ১৮ জনকে আসামি করে মামলা হয়। সিআইডির তৎকালীন কর্মকর্তা মুন্সী আতিকুর রহমান তদন্ত করে মামলাটিতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেন। মুন্সী আতিকুর রহমান ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার আসামি।