ইলিশের নামে 'চন্দনা বিক্রি'

শিমুলিয়া ঘাটে বিক্রির জন্য সাজিয়ে রাখা হয়েছে মাছ। অভিযোগ উঠেছে, ইলিশের নামে এসব হোটেলে বিক্রি করা হয় চন্দনা মাছ।  প্রথম আলো
শিমুলিয়া ঘাটে বিক্রির জন্য সাজিয়ে রাখা হয়েছে মাছ। অভিযোগ উঠেছে, ইলিশের নামে এসব হোটেলে বিক্রি করা হয় চন্দনা মাছ। প্রথম আলো

‘পদ্মার ইলিশ, তাজা ইলিশ, আসেন আসেন।’ মুন্সিগঞ্জের মাওয়ার শিমুলিয়া ঘাটের হোটেলের কর্মচারীরা এভাবে হাঁকডাক দিয়ে যাত্রীদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন। কিন্তু এসব হোটেলে কি আসলেই পদ্মার ইলিশ বিক্রি হয়?

অভিযোগ উঠেছে, পদ্মাপাড়ের এই ঘাটের হোটেলগুলোতে পদ্মা বা চাঁদপুরের মেঘনার ইলিশ খুব কমই রাখা হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ইলিশের নামে বিক্রি হয় চন্দনা। কেবল হোটেল নয়, লঞ্চেও চলছে এই অবস্থা।

লঞ্চে পদ্মা পেরিয়ে ফরিদপুর যাবে ঢাকার ওয়ারীর ওয়াকিল হোসেনের পরিবার। ঢাকা থেকে বাসে সকালে রওনা হয়েছে। ভাঙা রাস্তা আর যানজটের কারণে শিমুলিয়া ঘাটে পৌঁছাতেই ঘনিয়ে এল দুপুর। শিমুলিয়া ঘাট টার্মিনালে নেমে স্ত্রী আর দুই সন্তানকে নিয়ে লঞ্চঘাটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। এ সময় হোটেল কর্মচারীদের চিৎকার শুনে ছেলে বায়না ধরল ইলিশ ভাজা খাবে। ওয়াকিল বললেন, পরে একটি হোটেলে গিয়ে দুই সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে তিনি ইলিশ ভাজা খেলেন। প্রতি টুকরা মাছের দাম নেওয়া হয়েছে এক শ টাকা করে। কিন্তু ইলিশের স্বাদ বা গন্ধ কিছুই পেলেন না তিনি।

ঘাট সূত্র জানায়, ঘাটের হোটেলগুলোতে শতকরা ৯০ ভাগ বিক্রি হয় চন্দনা। আসল বা পদ্মা-মেঘনার ইলিশ রাখা হয় বড়জোর ১০ ভাগ। ঘাটে চন্দনা বিক্রির একটি সিন্ডিকেটও গড়ে উঠেছে।

সম্প্রতি শিমুলিয়া ঘাটের বিভিন্ন হোটেল ঘুরে দেখা যায়, থালাভর্তি মাছের টুকরা সাজিয়ে রাখা হয়েছে। হোটেলের কর্মচারীরা পদ্মার তাজা ইলিশের গুণগান করে যাত্রীদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন।

মোল্লা ঘরোয়া হোটেলের মালিক আবদুল জব্বার বলেন, ‘ইলিশের দাম বেশি বলে পাবলিক চাপ দেয়। তাই চন্দনা মাছ বিক্রি করি। শুনেছি চন্দনা বার্মা থেকে আসে। এর আরেক নাম লাছা।’

ভান্ডারি মোল্লা হোটেলের মালিক কাশেম মোল্লা বলেন, ‘আমাগো কাছে অরিজিনাল ইলিশও আছে। ভালো কাস্টমার পাইলে বাইর করি।’

ওই দিন দুপুরে ঘাটে বাঁধা ছিল ১৫টির মতো লঞ্চ। কিছু যাবে মাদারীপুরের শিবচরের কাঁঠালবাড়ি, কিছু শরীয়তপুরের জাজিরার মাঝিরকান্দি ঘাট। সব লঞ্চেই খাবারের ব্যবস্থা আছে। একটি লঞ্চে তখনো যাত্রী ওঠেনি। বাবুর্চি ফ্রিজের ওপর সাজিয়ে রাখা মাছের টুকরা দেখিয়ে বললেন, এগুলো রান্না হবে কিছুক্ষণ পর। প্রতি টুকরা বিক্রি হবে ৪০ থেকে ৬০ টাকা। এ রকম চারটি লঞ্চ ঘুরে একই দৃশ্য দেখা গেল। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক লঞ্চগুলোর সুপারভাইজাররা বলেন, এগুলো আসল ইলিশ নয়, চন্দনা।

কর্মচারীদের কথার সূত্র ধরে এগিয়ে গিয়ে ঘাটের এক পাশে দেখা গেল বেশ কয়েকটি আড়তঘর। একটি ঘরে গেলে ব্যবস্থাপক পরিচয় দেওয়া আবদুল কুদ্দুস বলেন, তাঁদের কাছে বর্তমানে ইলিশ মাছ নেই।

ঘাট সূত্র জানায়, রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থেকে ট্রাকযোগে কার্টনভর্তি চন্দনা মাছ আসে ভোরে। প্রতি কার্টনে ২০ কেজি করে মাছ থাকে। হোটেল ও  লঞ্চগুলোতে প্রতি কেজি সরবরাহ করা হয় ২০০ টাকা দরে। আর পদ্মার ইলিশ বলতে যা বোঝায় তা প্রায় আসেই না। চাঁদপুরের কিছু ইলিশ আসে। বিক্রি হয় ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা প্রতি কেজি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি আড়তের ব্যবস্থাপক বলেন, তিনি শুনেছেন মিয়ানমার থেকে চট্টগ্রাম হয়ে এসব চন্দনা আসে।

আড়তদার হারুন মিয়া বলেন, অনেক ক্রেতাই ৩০-৪০ টাকা দিয়ে ইলিশ খেতে চান। তাই চন্দনার চাহিদা বেশি।

শিমুলিয়া-রানীগাঁও হোটেল সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফয়সল খান বলেন, বর্তমানে ইলিশের মৌসুম। স্বাভাবিক ইলিশই বিক্রি হওয়ার কথা। কিন্তু অন্য মাছ কেন আসে ও বিক্রি হয়, সেটা খতিয়ে দেখা দরকার।