আ.লীগে বিভক্তি, আশায় বিএনপি

খন্দকার আজিজুল হক , সেলিম রেজা হাবিব, আহম্মেদ ফিরোজ কবির , কামরুজ্জামান খান
খন্দকার আজিজুল হক , সেলিম রেজা হাবিব, আহম্মেদ ফিরোজ কবির , কামরুজ্জামান খান

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়ার প্রায় দুই যুগ পর ২০১৪ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সাংসদ হন খন্দকার আজিজুল হক। তাঁর বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের অন্তত আটজন নেতা এখানে মনোনয়ন পেতে তৎপরতা শুরু করেছেন। একেক পর্যায়ের নেতা একেকজন মনোনয়নপ্রত্যাশীকে সমর্থন দিয়ে মাঠে থাকায় বাড়ছে বিভক্তি। ক্ষমতাসীনদের এই বিভক্তিকে কাজে লাগিয়ে আসনটি পুনরুদ্ধারে প্রস্তুতি নিচ্ছে দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি

সুজানগর উপজেলা ও বেড়া উপজেলার আংশিক নিয়ে পাবনা-২ আসন। ভোটার সংখ্যা প্রায় ২ লাখ ৩৫ হাজার। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে আসনটিতে জয় পায় বিএনপি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের আহম্মেদ তফিজ উদ্দিন সাংসদ নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৯৮ সালে মৃত্যুবরণ করলে আসনটি শূন্য হয়। উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মুক্তিযুদ্ধের উপসর্বাধিনায়ক এ কে খন্দকার জয়ী হন। ২০০১ সালে সাংসদ হন বিএনপির সেলিম রেজা হাবিব। ২০০৮ সালে আবার জয় পান এ কে খন্দকার। পরে তাঁর লেখা বই নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হলে দল থেকে ছিটকে পড়েন এ কে খন্দকার। ২০১৪ সালে দলীয় মনোনয়ন পেয়ে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সাংসদ হন জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান সহসভাপতি খন্দকার আজিজুল হক।

আওয়ামী লীগে বিভক্তি

নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেড়া উপজেলার ৫টি ও সুজানগরের ১০টি ইউনিয়ন নিয়ে পাবনা-২ আসন। প্রতিটি নির্বাচনে বেড়ার ৫টি ইউনিয়নে বিএনপি বেশি ভোট পায়। এই ভোটের মধ্যে সমতা তৈরি করেন সুজানগরের ১০টি ইউনিয়নের ভোটাররা। ভোটব্যাংকের হিসাব-নিকাশ ও দলীয় বিরোধকে কাজে লাগিয়ে আসন্ন নির্বাচনে প্রার্থী হতে মাঠে নেমেছেন সুজানগর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহম্মেদ ফিরোজ কবির, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা এ কে এম কামরুজ্জামান খান, কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সভাপতি মির্জা আবদুল জলিল, জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর কবির, বেড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুল কাদের, সাবেক সচিব মজিবুর রহমান, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের নেতা আশিকুর রহমান, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি ইমরান সিরাজসহ বেশ কয়েকজন নেতা। প্রত্যেকেই এলাকায় পোস্টার, ব্যানার, বিলবোর্ড লাগিয়ে নিজেদের পক্ষে প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন। অনেকে গ্রামে গ্রামে গিয়ে গণসংযোগ, উঠান বৈঠক ও নেতা-কর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় করছেন। বর্তমান সাংসদ খন্দকার আজিজুল হকও গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন সমানতালে। ইতিমধ্যে ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করেছেন।

দলের কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নির্বাচিত হয়ে সাংসদ খন্দকার আজিজুল হক পছন্দের লোকজন নিয়ে চলাফেরা শুরু করেন। এতে ক্ষুব্ধ হন তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা। সৃষ্টি হয় অভ্যন্তরীণ কোন্দলের। সর্বশেষ ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়াকে কেন্দ্র করে কোন্দল আরও তীব্র হয়।

সুজানগর উপজেলার নাজিরগঞ্জ ইউপির চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক মশিউর রহমান খান বলেন, সাংসদ আজিজুল হক কখনো রাজনীতি করেননি। সাংসদ হয়ে একটি পক্ষের ওপর ভর করেছেন। আওয়ামী লীগকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছেন। এতে সাংসদের ওপর নাখোশ হয়ে অনেকেই নতুন প্রার্থী খুঁজছেন।

আবদুল কাদের বলেন, ‘বর্তমান সাংসদের সঙ্গে তৃণমূল নেতা-কর্মীদের কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি ত্যাগী নেতাদের কোনো মূল্যায়ন করেন না। ফলে আসন্ন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতা–কর্মীরা আমাকে প্রার্থী হিসেবে দেখতে চান। সে অনুযায়ী আমি কাজ করে যাচ্ছি।’

তবে সুজানগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও পৌরসভার মেয়র আবদুল ওহাব বলেন, বর্তমান সাংসদ বিগত বছরগুলোতে দুই উপজেলাতেই ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন। তিনি সার্বক্ষণিক তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের পাশে থাকেন। কিছু নেতা সুবিধাবঞ্চিত হয়ে এবং কিছু নেতা এই আসনের প্রার্থী হওয়ার জন্য সাংসদের বিরুদ্ধে লেগেছেন। একেকজন নেতা একেকজন প্রার্থীকে সমর্থন দিয়ে সাংসদের বিরুদ্ধে কথা বলছেন।

সুজানগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. শাহিনুজ্জামান বলেন, ‘আমরা আওয়ামী লীগের বিজয় চাই। বর্তমান সাংসদ নেতা-কর্মীদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। দলে তাঁর কোনো অবস্থান নেই। অন্য যাঁরা মনোনয়নের প্রত্যাশা করছেন, তাঁরাও নেতা-কর্মীদের থেকে বিচ্ছিন্ন। এঁদের মধ্যে কামরুজ্জামান খান দলকে সংগঠিত রাখায় আমরা তাঁকে সমর্থন দিয়েছি।’

সাংসদ খন্দকার আজিজুল হক বলেন, ‘আমি স্বচ্ছতা ও নীতিনৈতিকতা নিয়ে চলেছি। অনৈতিক সুবিধা না দেওয়ায় হাতে গোনা কয়েকজন বিপক্ষে গেছেন এটা ঠিক, তবে দুই উপজেলার ১৬টি ইউনিয়নের ১১ জন চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের ৩২ জন সভাপতি ও সম্পাদকের ২৬ জন আমার সঙ্গে আছেন। নির্বাচনী এলাকার জনগণও আমার সঙ্গে আছেন। যাঁরা বিপক্ষে গেছেন, তাঁদের পক্ষে নিলে অন্যরা বিপক্ষে যেতেন।’

সুযোগ সন্ধানে বিএনপি

আসনটি পুনরুদ্ধারে এবার মরিয়া বিএনপি। ২০০১ সালের নির্বাচনে আসনটিতে সেলিম রেজা হাবিব সাড়ে ৮ হাজার ভোটে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মির্জা আবদুল জলিলকে পরাজিত করেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে তিনি প্রায় ২২ হাজার ভোটে আওয়ামী লীগের এ কে খন্দকারের কাছে পরাজিত হন। ফলে আসনটি নিয়ে বিএনপি এবার আশাবাদী। দলীয় নেতা-কর্মীদের সুসংগঠিত রাখতে কাজ করছেন ঊর্ধ্বতন নেতারা। দীর্ঘদিন ধরে মাঠে লেগে আছেন সাবেক সাংসদ ও বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য সেলিম রেজা হাবিব। এ ছাড়া দলের অপর কার্যনির্বাহী সদস্য হাসান জাফির, সুজানগর থানা বিএনপির সহসাংগঠনিক সম্পাদক আসলাম হোসেনসহ বেশ কয়েকজন নেতা মনোনয়ন প্রত্যাশা করে গণসংযোগ করছেন। ভোটারদের শুভেচ্ছা জানিয়ে বিলবোর্ড, ব্যানার, পোস্টার টাঙিয়েছেন।

বিএনপি নেতারা বলছেন, অভ্যন্তরীণ কোন্দল আগামী সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জন্য অন্তরায় হবে। অন্যদিকে দমন-পীড়নে সাধারণ জনগণ দলটির ওপর অতিষ্ঠ। ফলে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে এখানে ভোটাররা বিএনপিকেই ভোট দেবেন।

বেড়া উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মো. রইজ উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, ‘পাবনা-২ আসনে বিএনপির ভোটব্যাংক আছে। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে বিএনপির জয় নিশ্চিত। ফলে কেন্দ্রীয় নির্দেশনা অনুযায়ী নেতা–কর্মীদের সুসংগঠিত রাখতে কাজ করে যাচ্ছি। নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি হলে দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’

এ কে এম সেলিম রেজা হাবিব বলেন, ভোট না করে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ ভোটের কদর বোঝেনি। উন্নয়নের নামে নিজেদের পকেট ভরিয়েছে। দমন নীতি দিয়ে মানুষের মুখ বন্ধ রাখতে চেয়েছে। সাধারণ জনগণ এর পরিবর্তন চায়। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছি।