নতুন হয়ে উঠছে পার্কটি

রক্ষণাবেক্ষণের অভাব আর দখল-দূষণের কারণে ৫০ বছরের পুরোনো আজিমপুরের রসুলবাগ শিশুপার্কের অস্তিত্বই লোপ পেতে বসেছিল। নামে শিশুপার্ক হলেও শিশুদের জন্য আদতে সেখানে কিছুই ছিল না। বরং উঁচু দেয়ালের আড়ালে থাকা পার্কটিতে ছিল দখলদারদের দৌরাত্ম্য, মাদকসেবী ও কারবারিদের আড্ডা। এর সঙ্গে বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা ও জমে থাকা আবর্জনার কারণে বছরের বেশির ভাগ সময় জায়গাটিতে পা ফেলার উপায় থাকত না।

এ সবকিছুই এখন অতীত হতে চলেছে। নতুন করে গড়ে তোলা হচ্ছে পার্কটি। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ‘জল সবুজে ঢাকা’ প্রকল্পের আওতায় গত বছর শুরু হওয়া সংস্কারকাজের শুরুতেই ভেঙে ফেলা হয়েছে পার্কের তিন পাশের উঁচু দেয়াল। স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে নিয়ে উচ্ছেদ করা হয়েছে পার্কের ভেতরের ও বাইরের সীমানাদেয়াল ঘেঁষে গড়ে তোলা বাজার, অস্থায়ী দোকানসহ সব ধরনের অবৈধ স্থাপনা। ভেতরের বড় গাছগুলো অক্ষত রেখে চারপাশ ঘিরে লাগানো হয়েছে দৃষ্টিনন্দন কলাবতীর ঝাড়। সঙ্গে করমচা, ঢাক, বিলিম্বি, আমলকী, কামরাঙা, লটকনসহ নানা প্রজাতির দেশি ফলের গাছ। উদ্দেশ্য, পার্কে সময় কাটাতে আসা মানুষের সঙ্গে পাখিদের সহাবস্থানের বিষয়টি নিশ্চিত করা।

পার্কটির নকশা প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠান সাতত্যের প্রধান স্থপতি রফিক আজম বলছেন, নতুন নকশা অনুসারে পার্কে কোনো সীমানাদেয়াল থাকছে না, যাতে এলাকার বাসিন্দাসহ পথচলতি মানুষের সঙ্গে পার্কটির একটি দৃশ্যগত যোগাযোগ তৈরি হয়। এতে পার্কের সঙ্গে তাদের একধরনের আত্মিক সম্পর্কও তৈরি হবে। এ ছাড়া এখানকার জলাবদ্ধতার সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য চওড়া হাঁটাপথের পাশেই খনন করা হয়েছে অপরিসর নালা, যার মাধ্যমে জমিয়ে রাখা বৃষ্টির পানি পরিশোধন করা হবে। এই শোধনাগার তৈরি হবে পার্কের ভেতরে আগেই গড়ে তোলা তিনতলা ভবনের নিচতলায়। সেখানে পরিশোধিত পানি এলাকার বাসিন্দারাও ব্যবহার করতে পারবে।

গত সোমবার দেখা যায়, দেড় বিঘা আয়তনের পার্কটির চারপাশে চওড়া হাঁটাপথ তৈরির কাজ প্রায় শেষের পথে, যার নিচ থেকে চলে গেছে পয়োনালা। পার্কের চারপাশে কলাবতীসহ বিভিন্ন দেশি প্রজাতির ফলের চারা লাগানো হয়েছে। এ ছাড়া রোপণের জন্য আরও কিছু চারা তৈরি আছে। এক পাশে মাঝারি একটি বটগাছের পাশে পাম্পের পানিতে গোসল করছেন স্থানীয় এক ব্যক্তি। তিনতলা ভবনের সামনে গল্প করছেন স্থানীয় কিছু তরুণ। তাঁদের কাছ থেকে জানা গেল, ভবনের নিচতলায় কিছুদিন আগেও একটা ব্যায়ামাগার ছিল। দোতলার অংশে আছে যুবলীগের স্থানীয় এক নেতার কার্যালয়। আর তিনতলায় অনেক দিন থেকেই সিটি করপোরেশনের কিছু কর্মচারী বসবাস করছেন। যদিও ভবনের দেয়ালে টাঙানো একটা ব্যানারে লেখা আছে যে এটি ডিএসসিসির অঞ্চল-৩-এর ভেটেরিনারি কার্যালয়। চোখে পড়ে, দক্ষিণ প্রান্তে পার্কের সীমানা ঘেঁষে রয়েছে একটি মসজিদ।

সাতত্যের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এই মসজিদ ঘিরে তাঁদের আলাদা পরিকল্পনা আছে। সীমানাদেয়াল না থাকার কারণে যেকোনো দিক থেকে মুসল্লিরা এই মসজিদে আসতে পারবেন। মূল নকশার সঙ্গে সংগতি রেখে মসজিদের পাশে একটি আধুনিক অজুখানা তৈরি করা হবে। এ ছাড়া তিনতলা ভবনের দ্বিতীয় তলায় তৈরি করা হবে একটি আধুনিক ব্যায়ামাগার। তিনতলায় থাকবে উন্মুক্ত গ্রন্থাগার। আর ভবনের ছাদে ক্যাফেটেরিয়া।

পার্কটি পড়েছে ডিএসসিসির ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের আওতায়। ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. হাবিবুর রহমান বলেন, পার্কের নকশা চূড়ান্ত করার আগে একাধিকবার স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে বৈঠক করা হয়েছে। প্রতিটি বিষয়ে তাঁদের মতামত চাওয়া হয়েছে। তাঁরা যদি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে না দিতেন, তাহলে পার্কের ভেতরের ও বাইরের অবৈধ স্থাপনাগুলো উচ্ছেদ করা কঠিন হতো।

এদিকে নকশা প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় স্থানীয়দের অংশী করে তোলার বিষয়টিকে সবচেয়ে গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন স্থপতি রফিক আজম। তিনি বলেন, ‘এক অর্থে এই বাসিন্দারাই পার্কটির মূল ব্যবহারকারী। আমরা চেয়েছি এটা যেন তাঁদের সব সামাজিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র হয়ে ওঠে। তাই সংস্কার ও নকশা প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় তাঁদের মতামতের গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে সবচেয়ে বেশি, যাতে তাঁদের ভেতর একটা মালিকানার বোধ তৈরি হয়। এ ক্ষেত্রে পার্কটি পুনরায় দখল হওয়া কিংবা পরিবেশ নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি অনেকখানি কমে আসবে।’

কর্তৃপক্ষ বলছে, এখানে শিশুদের খেলার ব্যবস্থা যেমন থাকবে, তেমনি এলাকার বয়স্ক ব্যক্তি, নারী কিংবা মেয়েশিশুরাও যাতে এখানে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে, সে বিষয়টি বিশেষভাবে খেয়াল রাখা হচ্ছে। গ্রন্থাগারটি উন্মুক্ত থাকবে সবার জন্য। পার্কে থাকবে ওয়াই-ফাইয়ের সুবিধা। চলতি বছরের শেষ দিকে পুরো কাজ শেষ হওয়ার সম্ভাবনা আছে।