জঙ্গির কথোপকথনের নথি ৩৪ হাজার পৃষ্ঠা

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি
>
  • শোক দিবসের র‍্যালিতে বোমা হামলার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে অভিযুক্ত আকরাম হোসেন খান নিলয়
  • আকরাম মোবাইল চ্যাটে দেশে ও বিদেশে কথা বলতেন।
  • ৩৪ হাজার পৃষ্ঠার রেকর্ড উদ্ধার করেছে পুলিশ
  • বিদেশে থাকা দুই বাংলাদেশি ‘জঙ্গি’র খোঁজ পাওয়া গেছে।

জাতীয় শোক দিবসের র‍্যালিতে বোমা হামলার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে অভিযুক্ত আকরাম হোসেন খান নিলয়। দেশি–বিদেশি জঙ্গিদের সঙ্গে তাঁর কথোপকথনের ৩৪ হাজার পৃষ্ঠার রেকর্ড উদ্ধার করেছে পুলিশ। এই রেকর্ড থেকে মিলেছে বিদেশে থাকা দুই বাংলাদেশি ‘জঙ্গি’র খোঁজ।

পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের কর্মকর্তারা বলছেন, আকরাম হোসেন খান নিলয় মোবাইল চ্যাটে দেশে ও বিদেশে কথা বলতেন। ফরেনসিক পরীক্ষার পর তাঁরা ৩৪ হাজার পৃষ্ঠার যে রেকর্ডটি পেয়েছেন, সেটি এখনো দেখে শেষ করতে পারেননি। কিন্তু এর মধ্যেই এক ডজন ‘জঙ্গি’র সঙ্গে আকরামের যোগাযোগের প্রমাণ পাওয়া গেছে। যেসব জঙ্গির সঙ্গে আকরামের যোগাযোগ হয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য তানভীর ইসলাম ওরফে আবু ইমরান ও আসিফ আজাদ। তানভীর আফগানিস্তানের খোরাসান ও আসিফ সিরিয়ার রাকা থেকে আকরাম হোসেন খানের সঙ্গে কথা বলতেন। ওই কথোপকথনে মালয়েশিয়া থেকে একজনের আসা–যাওয়ার উল্লেখ আছে। আছে ভারত থেকে অস্ত্র সরবরাহকারী এক ব্যক্তির নামও।

তানভীর ইসলাম ওরফে আবু ইমরান ইরান হয়ে আফগানিস্তানে যান ২০১৬ সালের মাঝামাঝি। তাঁর বাবা আর্মি ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের বেসামরিক কর্মকর্তা। থাকতেন রাজধানীর মাটিকাটা এলাকায়। কুয়েতের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন থেকে এমবিএ করেন। চাকরি করতেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। আফগানিস্তানে যাওয়ার মাস চারেক আগে তিনি বিয়ে করেন।

তানভীর আফগানিস্তান থেকে আকরামকে লিখেছেন, তাঁর ধারণা, তিনিই সেখানে পৌঁছানো প্রথম বাংলাদেশি। কেউ আগ্রহী হলে কোন পথে কীভাবে তাঁর কাছে পৌঁছাতে হবে, সে পথও বাতলে দিয়েছেন তানভীর।

কর্মকর্তারা বলছেন, সম্প্রতি আফগানিস্তানের খোরাসান থেকে মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা চালানোর দাবি করে বাংলায় একটি ভিডিও প্রকাশ করা হয়। তানভীর ওই দলটিতে ছিলেন কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

জঙ্গি আসিফ আজাদ সবশেষ ছিলেন সিরিয়ার রাকায়। গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিল। তাঁর একজন আত্মীয় নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, আসিফ যে সিরিয়ার রাকায় গিয়ে আইএসে যোগ দিয়েছে, পরিবারের সদস্যরা গত মাসের শুরুতেও এ খবর জানতেন না। পরিবারের লোকজন জানতেন, আসিফ তুরস্কের কোনো একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন।

পুলিশ জানতে পারে, ২০১৬ সালের মার্চে ইরানের ইউনিভার্সিটি অব তেহরানের একটি সেমিনারে অংশ নেওয়ার কথা বলে আসিফ আজাদ ঢাকা ছাড়েন। পরে সেখান থেকে সিরিয়ার রাকায় চলে যান। তিনি অস্ত্র হাতে ছবি তুলে পাঠান আকরাম হোসেন খান নিলয়কে।

পরিবারকে উদ্ধৃত করে একজন পুলিশ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, আসিফের বাবার ধারণা ছিল, ছেলে হয়তো অবৈধ উপায়ে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসিফ আজাদের সহপাঠীরা জানিয়েছেন, প্রথম সেমিস্টারে মোটামুটি নিয়মিত ক্লাস করেছেন আসিফ। দ্বিতীয় সেমিস্টারে তিনি বেশ কিছুদিনের জন্য উধাও হয়ে যান। তৃতীয় সেমিস্টারে কিছুদিনের জন্য ফিরে আসেন। তারপর আর খোঁজ নেই।

আরও যা জানা গেল
কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের উপকমিশনার মহিবুল ইসলাম খান প্রথম আলোকে বলেন, গুলশানের হোলি আর্টিজানে হামলার আগে–পরে ঢাকার গুলশান, ধানমন্ডি ও মহাখালীতে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ তরুণদের তিনটি দল ছিল। প্রতিটি দলের সঙ্গে আকরাম হোসেন খান নিলয়ের যোগাযোগের তথ্য পাওয়া যায়। এমনকি গত বছরের ২৫ মার্চ সিলেটের আতিয়া মহলে অভিযানের সময় নব্য জেএমবির সে সময়কার প্রধান ‘মুসা’র সঙ্গে তাঁর যোগাযোগের প্রমাণ পাওয়া গেছে। আকরাম একটা সময় নিজেই নব্য জেএমবির হাল ধরেন এবং হামলার প্রস্তুতি নেন।

পুলিশ রবিউল নামের ভারতে অবস্থানরত এক ব্যক্তির সঙ্গে আকরামের কথা হতো বলে জানতে পেরেছে। এই রবিউল চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত থেকে অস্ত্র সরবরাহে যুক্ত ছিল। পুলিশের পক্ষ থেকে বিষয়টি ভারতের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানানো হয়েছে। আকরাম হোসেন খানের কথোপকথন থেকে পুলিশ বিভিন্ন সময় ইউনুস কাতারদার বাংলাদেশে আসার খবর পেয়েছে। তবে ইউনুস কাতারদা কবে কখন কার মাধ্যমে বাংলাদেশে আসেন, সে সম্পর্কে এখনো কোনো তথ্য পায়নি।

আকরাম হোসেন খান এ বছরের মার্চে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। স্কলাসটিকা স্কুল থেকে ও লেভেল এবং ব্রিটিশ কাউন্সিলের মাধ্যমে এ লেভেল শেষ করে মালয়েশিয়ার লিংকন ইনে পড়তে গিয়েছিলেন আকরাম। পুলিশ জানিয়েছে, আকরাম শুরু থেকে আইএসপন্থী নব্য জেএমবির সঙ্গে যুক্ত থাকলেও তিনি অন্য সবার মতো ‘হিজরত’ করেননি। হোলি আর্টিজানে হামলার মূল পরিকল্পনাকারী তামিম চৌধুরীর সঙ্গে হাজারীবাগে নিয়মিত দেখা করেছেন আকরাম। ২০১৬ সালের ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের র‍্যালিতে হামলার পরিকল্পনা করেছিলেন। পরে পুলিশি তৎপরতায় তা ভেস্তে যায়।