অভিযান বিফলে, চাঁদাবাজি আছেই

প্রথম আলো ফাইল ছবি
প্রথম আলো ফাইল ছবি

মাসব্যাপী বিশেষ অভিযান চালিয়েও রাজধানীতে যান চলাচলে শৃঙ্খলা ফেরাতে পারেনি পুলিশ। এর কারণ হিসেবে চালক ও মালিকেরা বলছেন, অভিযানের মধ্যেও পুলিশের ঘুষ বন্ধ হয়নি, এর সঙ্গে আছে পরিবহন নেতাদের চাঁদাবাজি। তাঁরা ধরে নিয়েছেন, এভাবেই তাঁদের চলতে হবে।

তবে ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেছেন, একদিনে সবকিছু ঠিক হবে না। বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে উত্তরণে সময় দিতে হবে।

গত ২৯ জুলাই রাজধানীর কুর্মিটোলায় বাসচাপায় দুই কলেজ শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার পর নিরাপদ সড়কের দাবিতে সড়কে নামে হাজার হাজার শিক্ষার্থী। পুলিশ ও সরকারি দলের নেতা–কর্মীরা মারধর করে তাঁদের উঠিয়ে দেন। তবে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নাড়া দেয় সরকারের শীর্ষ পর্যায় পর্যন্ত। ট্রাফিক সপ্তাহ, ট্রাফিক সচেতনতা মাস নামে নানা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামে পুলিশ।

গত ৪ সেপ্টেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া নগরের যান চলাচলে শৃঙ্খলা আনার ঘোষণা দিয়ে সেপ্টেম্বরকে ‘বিশেষ ট্রাফিক সচেতনতা মাস’ হিসেবে ঘোষণা দেন। এতে বাস চলাচলে শৃঙ্খলা আনা, স্বয়ংক্রিয় সংকেত বাতি কার্যকর করা, লেগুনা চলাচল বন্ধসহ বেশ কিছু সংস্কারের কথা বলা হয়। এক মাসের বিশেষ অভিযান শেষে পরিস্থিতি তেমন বদলায়নি। কমিশনারের নিজের মূল্যায়ন হচ্ছে, মাসব্যাপী অভিযানে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য আসেনি।

আর পুলিশের এসব কর্মসূচি শেষ হওয়ার পর পরিবহন মালিকেরা বলছেন, নিয়ম মেনে গাড়ি চালানোর পরেও তাঁদের শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়েছে। তাই বেশির ভাগ বাণিজ্যিক যানবাহনের মালিকই আবশ্যিকভাবে পুলিশের সঙ্গে বন্দোবস্ত করে ফেলেছেন। লেগুনার চালক ও মালিকেরাও বলছেন, যে গাড়িগুলো নির্দিষ্ট পথে চলে, তাঁদের চাঁদা দিতে হয় স্ট্যান্ডগুলোতে।

রাজধানীর গাবতলী–যাত্রাবাড়ী পথে চলাচলকারী ৮ নম্বর বাসের সহকারী মো. শাহীন বলেন, প্রতিদিন প্রায় হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয় তাঁদের। এর মধ্যে মাজার রোডে ৬৬০ টাকা, সায়েদাবাদে ২২০ টাকা, শ্যামলী শিশু মেলায় ২০ ও ফার্মগেটে ২০ টাকা করে । আগস্ট মাসে বিশেষ অভিযান শুরুর পর থেকে তাঁদের গাড়ি ও চালকের বিরুদ্ধে আটটি মামলা হয়েছে। ইন্স্যুরেন্সের কপিসহ গাড়ির সব কাগজ এবং চালকের লাইসেন্স এখন পুলিশের কাছে। আবার কখনো কখনো মামলা এড়াতে ঘুষও দিতে হয়েছে এই মাসে। তিনি বললেন, গাড়ির চালক ও তিনি মিলে পুরোনো আইসার মিনিবাসটি দৈনিক ২ হাজার ৩০০ টাকা চুক্তিতে চালান। মালিক সমিতি দৈনিক চুক্তিতে গাড়ি চালানো নিষিদ্ধ করলেও গাবতলীর বেশির ভাগ মিনিবাস এভাবেই চলে বলে তিনি জানান।

চলছে অনুমোদন ছাড়া যান
আইয়ুব আলী নামে একজন অটোরিকশাচালক বলেন, তিনি ‘ঢাকা -দ’ সিরিজের একটি ছাই রঙের অটোরিকশা এক বছর আগে চার লাখ টাকায় কিনে চালাচ্ছেন। এই গাড়িগুলো ভাড়ায় চালানোর জন্য অনুমোদিত নয়। এ ধরনের অটোরিকশা পুলিশকে ‘মানতি’ দিয়ে চালাতে হয়। তিনি প্রতি মাসে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকায় চুক্তি করছেন বলে জানান।

নগরীর কারওয়ান বাজার থেকে হাতিরঝিল হয়ে রামপুরা পর্যন্ত চলাচল করে শতাধিক ভাঙাচোরা ও মেয়াদোত্তীর্ণ মাইক্রোবাস। ওই মাইক্রোবাসের একজন চালক বলেন, তাঁর সাত আসনের গাড়িটির কাগজ ছয় বছর উত্তীর্ণ। আগে একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে ভাড়ায় চালাতেন। এখন এই পথে গাড়ি চালানোর জন্য প্রতিদিন রামপুরা ও কারওয়ান বাজার প্রান্তে প্রায় ছয় শ টাকা দিতে হয়।

যেভাবে মানতি হয়
কারওয়ান বাজারের একটি দেড়টনি ট্রাকের চালক নাম না প্রকাশ করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, দেড় বছর আগে কিস্তিতে ট্রাক কিনেছেন। কিস্তির গাড়ি তাই সব কাগজই সব সময় হালনাগাদ থাকে। তাঁর গাড়িটির দিনের বেলাতেও ঢাকার রাস্তায় চলাচলের অনুমোদন রয়েছে। তবুও দিনে গাড়ি চালালেই পুলিশ ধরে। এ কারণে একজন ট্রাফিক ইন্সপেক্টরকে প্রতি মাসে আড়াই হাজার করে টাকা দিয়ে ‘মানতি’ করেছেন। ট্রাফিক ইন্সপেক্টর তাঁকে কয়েকজন সার্জেন্টের নম্বরের তালিকা দিয়েছেন। কোথাও পুলিশ গাড়ি ধরলেই তিনি ওই ট্রাফিক ইন্সপেক্টর বা তাঁর দেওয়া নম্বরগুলোতে ফোন করে দিলেই ছেড়ে দেয়।

মাঠপর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তাদের এ অনিয়ম ও দুর্নীতির ঠেকাতে কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, ব্যক্তিগতভাবে কেউ যদি কোনো অসাধু কাজ করে, এর দায় সেই ব্যক্তির। তবে এখন ‘ইলেকট্রনিক ডিভাইসে’ মামলা দেওয়া হচ্ছে। এখানে নগদ টাকার কোনো কারবার নেই।