মানুষকে আবার জিম্মির চেষ্টা

সড়ক পরিবহন আইন সংশোধনের দাবিতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় রাস্তায় নামেন পরিবহনশ্রমিকেরা। সড়কে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে যানবাহন চলাচলে বাধা দেন। এ সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গাড়িও আটকা পড়ে। গতকাল মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ এলাকায়।  ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন
সড়ক পরিবহন আইন সংশোধনের দাবিতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় রাস্তায় নামেন পরিবহনশ্রমিকেরা। সড়কে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে যানবাহন চলাচলে বাধা দেন। এ সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গাড়িও আটকা পড়ে। গতকাল মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ এলাকায়। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন
>
  • নতুন আইনে সর্বোচ্চ সাজা ৫ বছর
  • বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সাজা পর্যাপ্ত নয়
  • সাজা কমানোই এখন বড় দাবি শ্রমিকদের
  • পরিবহনশ্রমিকেরা রাস্তায়
  • ঢাকা বিভাগে পণ্য পরিবহন বন্ধ
  • বিভিন্ন স্থানে যান চলাচলে বাধা
  • ধর্মঘটসহ বৃহত্তর কর্মসূচির হুমকি

সদ্য পাস হওয়া সড়ক পরিবহন আইন সংশোধনের দাবিতে মাঠে নেমেছেন পরিবহনমালিক ও শ্রমিকেরা। ঢাকা বিভাগের ১৭টি জেলায় সব ধরনের পণ্য পরিবহন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছেন পরিবহন শ্রমিকেরা। ১২ অক্টোবরের মধ্যে আইন সংশোধন করা না হলে পরিবহন ধর্মঘটসহ বৃহত্তর কর্মসূচির হুমকি দিয়েছে পরিবহন মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদ।

গতকাল রোববার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় রাস্তায় নামেন পরিবহনশ্রমিকেরা। যাত্রাবাড়ী ও মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ এলাকায় যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। পশ্চিম দোলাইরপাড় এলাকায় শ্রমিকেরা সড়কে পণ্যবাহী গাড়ি (পিকআপ-ট্রাক) থামিয়ে চালকদের লাইসেন্স পরীক্ষা করেন। লাইসেন্স না থাকলে চালকদের মুখে পোড়া ইঞ্জিন অয়েল মেখে দেওয়া হয়।

এদিকে গাজীপুরে শ্রমিকেরা কিছু গাড়ি ভাঙচুর করেন। এ সময় সাংবাদিকদের মারধর ও পথচারীদের হেনস্তা করা হয়। গাজীপুর সংবাদদাতা জানান, শ্রমিক ইউনিয়নের লোকজন বেলা ১১টার দিকে টঙ্গী আনারকলি সড়কের উল্টো দিকে ট্রাকস্ট্যান্ডে জড়ো হয়ে মালবাহী ট্রাক ও পিকআপের গতিরোধ করে লাইসেন্স নিয়ে যান। কোনো কোনো চালককে মারধরও করা হয়।

গত ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহত হয়। সেদিন থেকে নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় নেমে আসে বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। তাদের আন্দোলনের মুখে তড়িঘড়ি করে গত ১৯ সেপ্টেম্বর সংসদে সড়ক পরিবহন বিল পাস করা হয়। তবে রাষ্ট্রপতি এখনো এই বিলে সই করেননি।

নতুন আইনে সড়ক দুর্ঘটনায় অপরাধ প্রমাণ হওয়া সাপেক্ষে দোষী চালকের সর্বোচ্চ ৫ বছর কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। এ ছাড়া আইনে ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ারও বিধান আছে। সে ক্ষেত্রে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি হত্যাকাণ্ড প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড।

সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করেন এমন ব্যক্তিরা বলেছেন, সড়কে চলা দীর্ঘদিনের নৈরাজ্য বন্ধে আইনে রাখা শাস্তির বিধান পর্যাপ্ত নয়। মন্দের ভালো সেই আইনও মানতে রাজি নন পরিবহনমালিক ও শ্রমিকেরা।

নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) আন্দোলনের চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন প্রথম আলোকে বলেন, জনগণকে জিম্মি করে দাবি আদায়ের চেষ্টা পরিবহনমালিক-শ্রমিকদের পুরোনো অভ্যাস। ১৯৮৩ সালের আইনে সড়ক দুর্ঘটনার সাজা ১০ বছর ছিল। শ্রমিকেরা জনগণকে জিম্মি করে ধারাগুলো জামিনযোগ্য ও সর্বোচ্চ সাজা ৩ বছর করতে বাধ্য করেছিলেন।

পরিবহনমালিক ও শ্রমিকদের দাবির বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান প্রথম আলোকে বলেন, সংসদে একটি আইন পাস হয়েছে। কেউ বললেই সেই আইনে সংশোধনী আনা যায় না। দাবি জানালেই এভাবে দাবি মেনে নেওয়া যাবে না। পরিবহনমালিক ও শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনা করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বিষয়টির সমাধান করবে।

সড়কে শ্রমিকেরা

গতকাল সকাল থেকে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী-পোস্তগোলা সড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দেয় ট্রাক-লরি-কাভার্ড ভ্যান শ্রমিক ইউনিয়ন। একপর্যায়ে পণ্যবাহী গাড়ি থামিয়ে চালকদের লাইসেন্স পরীক্ষা করতে শুরু করেন শ্রমিকেরা। পশ্চিম দোলাইরপাড় এলাকায় দেখা যায়, যেসব চালকের লাইসেন্স নেই, তাঁদের নাকেমুখে পোড়া ইঞ্জিন অয়েল মেখে দেওয়া হয়। যাঁদের কাছে বৈধ লাইসেন্স পাওয়া যাচ্ছিল, তাঁদের গাড়ি চালানো বন্ধ করে আন্দোলনে নামতে বলপ্রয়োগ করা হয়। দুপুর পর্যন্ত প্রায় ১০০ ট্রাক ও পিকআপ ভ্যান সেখানে আটকে রাখেন শ্রমিকেরা।

পশ্চিম দোলাইরপাড় এলাকায় শ্রমিকদের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন ট্রাক-লরি-কাভার্ড ভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নের সহসাংগঠনিক সম্পাদক মো. এরশাদ। তিনি বলেন, ‘আইনে মৃত্যুদণ্ড আর পাঁচ বছরের কারাদণ্ডের বিধান আছে। এই বিধান মাথায় নিয়ে আমরা গাড়ি চালাব কী করে?’

সেখানে দায়িত্বরত পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) দীন ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, কারও মুখে রং লাগানো বা লাইসেন্স চেক করে সেই লাইসেন্স নিজেদের কাছে রাখার আইনি অধিকার শ্রমিকদের নেই।

বেলা সাড়ে ১১টার দিকে মোহাম্মদপুর-বছিলা সড়কের তিন রাস্তার মোড়ে গিয়ে দেখা যায়, পরিবহনশ্রমিকেরা প্রতিটি সড়কে বাঁশ, ইট, কাঠের টুকরা দিয়ে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছেন। বেড়িবাঁধ সড়ক, মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডে যাওয়ার সড়ক এবং বছিলা হয়ে কেরানীগঞ্জে যাওয়ার সড়কে যানবাহন আটকা পড়ে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়।

সকাল আটটার দিকে গাবতলী আন্তজেলা বাস টার্মিনাল থেকে দূরপাল্লার বাস ছাড়তে বাধা দেওয়া হয়। ঢাকার ভেতরে চলাচলকারী বাস ছাড়তেও বাধা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। জানতে চাইলে পুলিশের মিরপুর বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মাসুদ আহাম্মদ বলেন, একদল শ্রমিক বাস চলাচলে বাধা দিচ্ছিলেন। পুলিশ শ্রমিকদের ধাওয়া দিয়ে সরিয়ে দেয়।

গত শনিবার তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ডে সমাবেশ করে বাংলাদেশ পণ্য পরিবহন শ্রমিক-মালিক ঐক্য পরিষদ। সেখানে নেতারা সড়ক পরিবহন আইন সংশোধনসহ বিভিন্ন দাবি তুলে ধরেন। দাবি আদায়ের লক্ষ্যে গতকাল রোববার সকাল ছয়টা থেকে ঢাকা বিভাগে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতি পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়। ঐক্য পরিষদের অন্য দাবিগুলো হচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনায় ৩০২ ধারায় মামলা নেওয়া যাবে না, ৫ লাখ টাকা জরিমানার বিধান বাতিল করা, জামিনযোগ্য ধারায় মামলা করা, ভারী যানবাহনচালকদের হালকা লাইসেন্স না দিয়ে ভারী যানবাহনের লাইসেন্স দেওয়া ইত্যাদি।

বাংলাদেশ পণ্য পরিবহন মালিক শ্রমিক ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক মুকবুল আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, কিছু উচ্ছৃঙ্খল শ্রমিক সড়কে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিলেন। নেতারা তাঁদের সরিয়ে দিয়েছেন। আইন সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত কর্মবিরতি চলবে।

পণ্য পরিবহন বন্ধ থাকলে তার প্রভাব পড়বে কাঁচাবাজার, তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে। জানতে চাইলে কারওয়ান বাজার ক্ষুদ্র কাঁচামাল আড়ত ব্যবসায়ী বহুমুখী সমিতির সভাপতি ওমর ফারুক বলেন, কারওয়ান বাজারে প্রতিদিন চার শ থেকে সাড়ে চার শ ট্রাক মালামাল নিয়ে আসে। পরিবহন বন্ধ থাকলে পণ্যের সংকট দেখা দেবে।

গত শনিবার রাজধানীর ফুলবাড়িয়া বিআরটিসি বাস ডিপো প্রাঙ্গণে আলাদা সমাবেশ করে পরিবহন মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদ। এই পরিষদে রয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন। সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি নৌমন্ত্রী শাজাহান খান।

এর আগেও বারবার মানুষকে জিম্মি করে দাবি আদায়ের কৌশল নেয় পরিবহনমালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলো। সড়ক দুর্ঘটনায় চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব তারেক মাসুদ, সাংবাদিক মিশুক মুনীরসহ পাঁচজনের প্রাণহানির মামলায় গত বছর বাসচালক জামির হোসেনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেন আদালত। এরপর সাভারে ট্রাকচাপায় এক নারীকে হত্যার দায়ে চালকের মৃত্যুদণ্ডের রায় দেন আদালত। এই দুটি রায়ের প্রতিবাদে ধর্মঘট করেছিলেন পরিবহনমালিক-শ্রমিকেরা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবং সেফ রোড অ্যান্ড ট্রান্সপোর্ট অ্যালায়েন্সের আহ্বায়ক হোসেন জিল্লুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, শ্রমিকেরা জনজীবনকে জিম্মি করে দাবি আদায়ের যে চেষ্টা করছেন, তা অগ্রহণযোগ্য। জবাবদিহির ঊর্ধ্বে থাকার জন্য শ্রমিকেরা আইন সংশোধনসহ এসব দাবি করছেন। শ্রমিকদের এমন দাবির প্রতি সরকারের কোনোভাবেই সহানুভূতিশীল হওয়া উচিত হবে না।