গায়েবি মামলার অভিযোগ তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে আইজিপিকে নির্দেশ হাইকোর্টের

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

বিএনপির নেতা-কর্মীদের নামে পুলিশ গায়েবি মামলা করেছে, এমন অভিযোগ করে বিএনপিপন্থী তিন আইনজীবীর রিট আবেদনের ওপর বিভক্ত আদেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী রিটটি আমলে নিয়ে গায়েবি মামলা করার অভিযোগটি তদন্ত করে ৬০ দিনের মধ্যে পুলিশ মহাপরিদর্শককে (আইজিপি) প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দিয়েছেন। একই সঙ্গে ঢাকা মহানগর এলাকায় আবেদনকারীসহ ও অন্য নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে গায়েবি মামলা করার অভিযোগ তদারকি ও অনুসন্ধানে পদক্ষেপ নিতে আইজিপিকে নির্দেশ দেন বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী।

অপর বিচারপতি আশরাফুল কামাল এ রিট আবেদনটি সংবিধানবহির্ভূত আখ্যায়িত করে তা সরাসরি খারিজ করেছেন। আদেশে তিনি বলেন, ‘রিট আবেদনকারীদের বিষয়টি ফৌজদারি মামলাসংশ্লিষ্ট। এ ব্যাপারে প্রতিকারের জন্য ফৌজদারি আদালতে প্রতিকার চাইতে পারেন। সংবিধানসম্মত আবেদন না হওয়ায় শুরুতে রিট মামলা খারিজ করা হলো।’

মঙ্গলবার বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এই বিভক্ত আদেশ দেন। আইনজীবীরা বলছেন, বিভক্ত আদেশ হওয়ায় নিয়ম অনুসারে এখন বিষয়টি প্রধান বিচারপতির কাছে যাবে। প্রধান বিচারপতি একটি বেঞ্চ (তৃতীয় বেঞ্চ) গঠন করে দেবেন, ওই বেঞ্চে বিষয়টির শুনানি ও নিষ্পত্তি হবে।

জাতীয় সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী আবেদনকারীদের এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে কথিত উদ্দেশ্যমূলক ‘গায়েবি’ ফৌজদারি মামলা করা কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল দিয়েছেন বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী। একই সঙ্গে এ ধরনের ‘গায়েবি’ মামলা দায়েরের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা-ও রুলে জানতে চেয়েছেন বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি।

জ্যেষ্ঠ বিচারপতির ঘোষিত আদেশে বলা হয়, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আইন অনুসারে মুক্তভাবে তদন্তকাজ পরিচালনা করতে পারবেন। এর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বেঞ্চের অপর বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল আদেশ দেন।

গত ২৩ সেপ্টেম্বর বিএনপির তিন আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন, নিতাই রায় চৌধুরী ও সানাউল্লাহ মিঞা ওই রিটটি করেন। তাঁদের মধ্যে খন্দকার মাহবুব ও নিতাই রায় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান এবং সানাউল্লাহ মিঞা বিএনপির আইন সম্পাদক। গতকাল সোমবার ও আজ রিটের ওপর শুনানি নিয়ে আদেশ দেওয়া হয়।

এর আগে মধ্যাহ্নবিরতির পর আদালত পক্ষগুলোর বক্তব্য শোনেন। আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, সঙ্গে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিশ্বজিৎ দেবনাথ ও একরামুল হক। অন্যদিকে রিট আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন, সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী জয়নুল আবেদীন ও নিতাই রায় চৌধুরী।

পুলিশকে আরও সচেতন হতে হবে
শুনানির শুরুতে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আদালতকে বলেন, ১০ মাসের শিশুর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। ফৌজদারি বিচারিক আদালত এর জন্য দায়ী পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছেন। যদি মৃত মানুষের নামে মামলা হয়ে থাকে, তাহলে এর প্রতিকারের জন্য ফৌজদারি আদালত আছে।
এ সময় জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘এ ব্যাপারে পুলিশকে আরও সচেতন হতে হবে।’

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, পত্রিকার খবর আদালতের কাছে দিয়ে রিটকারীরা বলতে চাচ্ছেন, মৃত মানুষকে আসামি করা হয়েছে। কোনো ঘটনাই ঘটেনি। কিন্তু পত্রিকার প্রতিবেদন দিয়ে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসা যাবে না। এসব মামলার তদন্ত চলছে। যাঁরা রিট আবেদন করেছেন, তাঁরা যদি অপরাধী না হয়ে থাকেন, তাহলে মামলা বাতিল চেয়ে আদালতের কাছে আবেদন করতে পারেন।

২১ আগস্ট গ্রেনেড বোমা হামলার মামলার অভিযুক্ত সাবেক শিক্ষা উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর পরিবারের কথা তুলে ধরে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, পিন্টুর ভাই হলেন এই গ্রেনেড হামলা-মামলার অন্যতম আসামি তাজউদ্দিন। তাঁদের আরেক ভাই সুলতান সালাউদ্দিন। রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা অপরাধ করেন না, তা তো বলা যাবে না।

উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত তুলে ধরে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, রিটকারীদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হয়েছে। এজাহারকে চ্যালেঞ্জ করতে পারেন, অভিযোগপত্রের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আসতে পারেন। অভিযোগ গঠনের আদেশের বিরুদ্ধেও আসতে পারেন। কিন্তু তাঁরা রিট আবেদন করে এর প্রতিকার চাইতে পারেন না। ফৌজদারি মামলার বিষয়ে ফৌজদারি আদালত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন।

অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্যের পর রিট আবেদনকারী খন্দকার মাহবুব হোসেন আদালতে বলেন, ‘দেশে লাখ লাখ মানুষের নামে গায়েবি মামলা হচ্ছে। আমরা আদালতে এসেছি এ জন্য যে, দেশে কী হচ্ছে তা জানাতে। গায়েবি মামলার বিষয়ে তদন্ত কমিটি করার জন্য আবেদন করেছি। মিথ্যা মামলায় মানুষ ঘরে থাকতে পারছেন না। মানবাধিকার রক্ষার জন্য উচ্চ আদালতে আবেদন করেছি।’

এ সময় বিচারপতি আশরাফুল কামাল খন্দকার মাহবুবের কাছে জানতে চান, তাঁদের আবেদনটি কী জনস্বার্থে করা আবেদন? খন্দকার মাহবুব তখন জানান, হ্যাঁ। এরপর বিচারপতি আশরাফুল কামাল খন্দকার মাহবুবের উদ্দেশে বলেন, ‘আমরা সাংবিধানিক আদালত। সংবিধান অনুসারে আমরা চলব। সংবিধানের মধ্য থেকে আমাদের কথা বলতে হবে। খন্দকার মাহবুব আপনি নিজে মামলার আসামি। সংবিধান অনুসারে আবেদন না করলে আমরা কীভাবে আপনাকে প্রতিকার দেব। সংবিধান অনুসারে এ আবেদন হয়নি।’

তখন খন্দকার মাহবুব বলেন, ‘আমরা কী ১০ লাখ লোক নিয়ে হাইকোর্টে আসব? আমাদের মামলা নিয়ে তো আদালতে আসিনি।’ বিচারপতি আশরাফুল কামাল খন্দকার মাহবুবের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনি বলুন মিথ্যা মামলা দিলে কী ব্যবস্থা নেওয়া যায়?’ খন্দকার মাহবুব বলেন, আদালত বলে দেন, আমরা কোথায় যাব? আমরা কী ১০ লাখ লোক নিয়ে হাইকোর্টে আসব?’ তখন বিচারপতি আশরাফুল কামাল বলেন, ‘সংবিধানের বাইরে আমরা কীভাবে যাব?’

এ সময় রিট আবেদনকারী বিএনপি নেতা নিতাই রায় চৌধুরী আদালতে বলেন, ‘গণমাধ্যমের একটা ভূমিকা আছে। গণমাধ্যম হলো রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। গণমাধ্যমে প্রকাশ হচ্ছে, মৃত ব্যক্তিদের নামে মামলা হচ্ছে।’
বিচারপতি আশরাফুল কামাল তখন বলেন, হলফনামা ছাড়া প্রতিবেদন জুডিশিয়াল নোটিশে নেওয়া যাবে না।