আফিলের দুর্গে লিটন, তৃপ্তির বিকল্প কে

যশোর-১ (শার্শা) আসনে পরপর দুই মেয়াদে আওয়ামী লীগের সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন শেখ আফিল উদ্দীন। এ আসনে তাঁর শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী বলতে তেমন কেউ ছিলেন না। তবে এবার দলে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছেন বেনাপোল পৌরসভার মেয়র আশরাফুল আলম লিটন।

বিএনপিতে মনোনয়নের আশায় বুক বেঁধেছেন চারজন। তবে এই মনোনয়নপ্রত্যাশীদের কাছে আতঙ্কের নাম দলটির বহিষ্কৃত কেন্দ্রীয় সাবেক দপ্তর সম্পাদক মফিকুল হাসান তৃপ্তি। সংস্কারপন্থী বলে পরিচিত এই নেতার দলে ফেরার গুঞ্জনে এর আগেও বেশ কয়েকবার শার্শা বিএনপিতে ঝড় উঠেছে। তাঁকে দলে না ফেরানোর দাবিতে কয়েক দফায় সংবাদ সম্মেলনও করেছে শার্শা বিএনপি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আফতাব আহমেদ হত্যা মামলায় মফিকুল গ্রেপ্তার হওয়ার পর বিএনপির দুই নেতা জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক মহসীন কবীর ও শার্শা উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক হাসান জহির মনোনয়ন পাওয়ার জোর চেষ্টা করছেন। তবে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীদের তালিকায় উপজেলা বিএনপির সভাপতি খায়রুজ্জামান মধুর নামও শোনা যাচ্ছে।

২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন আলী কদর। আওয়ামী লীগের প্রার্থী শেখ আফিল উদ্দীনকে ১২ হাজার ভোটে পরাজিত করে আলী কদর সাংসদ নির্বাচিত হন। গত বছর তিনি যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

২০-দলীয় জোটের শরিক জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে হিসাব-নিকাশে এ আসনে বিএনপিকে চ্যালেঞ্জে পড়তে হতে পারে এবার। কারণ, নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসনে জোটের প্রার্থী ছিলেন জামায়াতের কেন্দ্রীয় শুরা সদস্য মো. আজিজুর রহমান। ওই নির্বাচনে আজিজুর ৫ হাজার ৮৫৬ ভোটের ব্যবধানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী শেখ আফিল উদ্দীনের কাছে পরাজিত হন। আজিজুরের ভোট ছিল ৮৮ হাজার ৭০০ আর আফিলের ৯৪ হাজার ৫৫৬ ভোট। ফলে জামায়াতের ভোট বিএনপির কাছাকাছি হওয়ায় স্বস্তিতে নেই বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীরা।

আসনটিতে বিএনপি ও জামায়াতের ভোটসংখ্যা সমান সমান দাবি করে জামায়াতের কেন্দ্রীয় শুরা সদস্য আজিজুর বলেন, ‘নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে আমি শঙ্কিত। তারপরও বিএনপি-জামায়াত জোট যদি নির্বাচনে আসে, তাহলে আমি এ আসনে প্রার্থী হতে চাই।’ যশোর জেলা বিএনপির একজন শীর্ষ নেতা বলেন, ‘শার্শা সীমান্তবর্তী উপজেলা। দেশের বৃহত্তম স্থলবন্দর বেনাপোলও এ সংসদীয় আসনে অবস্থিত। এখানে জোটের প্রার্থী জামায়াতের কেউ হোক, তা আমরা চাই না। জামায়াতের প্রার্থীকে রুখতে হলে বিএনপির একজন শক্ত প্রার্থী দরকার, বহিষ্কৃত হলেও মফিকুলের কথাই ভাবছেন অনেকে।

তবে চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলায় মফিকুল জড়িয়ে পড়ায় তাঁর প্রার্থী হওয়া নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। সে ক্ষেত্রে মহসীন কবীরের প্রার্থী হওয়ার পথ অনেকটা সুগম বলে মনে করছেন তাঁর অনুসারীরা। তিনি এলাকায় জনসংযোগও চালিয়ে যাচ্ছেন। মহসীন কবীর বলেন, ‘আমি সুখে-দুঃখে দলের নেতা-কর্মীদের পাশে আছি, দলেরও সংকেত পেয়েছি। রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে আমি ঢাকায় অবস্থান করে নেতা-কর্মীদের মামলায় জামিন পেতে সহায়তা করি।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এলাকায় থাকলে গ্রেপ্তার হতেই হবে, তখন নির্যাতিত কর্মীদের জন্য কিছু করতে পারব না।’

বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী শার্শা উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক হাসান জহির বলেন, বিএনপির প্রার্থী হওয়ার জন্য অনেক আগেই তিনি ঘোষণা দিয়েছেন। এলাকার নেতা-কর্মীদের সুখে-দুঃখে পাশে থেকে কাজ করে যাচ্ছেন। মফিকুলকে বিএনপির প্রার্থী করার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘তিনি ১০ বছর ধরে দল থেকে বহিষ্কৃত। দলের সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্ক নেই।’

তবে ড. আফতাব হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হওয়ার আগে মফিকুল বলেন, ‘বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার হয়েছে কি হয়নি, সেটা আপনারা বিএনপির মহাসচিবের সঙ্গে যোগাযোগ করলে জানতে পারবেন। আমি বিএনপির প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনী মাঠে আছি।’ সম্প্রতি তিনি জামিন পেয়েছেন।

২০০১ সালে নৌকা মার্কা নিয়ে রাজনীতির মাঠে আসেন শিল্পপতি শেখ আফিল উদ্দীন। যদিও তিনি বিএনপির প্রার্থী আলী কদরের কাছে ১২ হাজার ভোটে হেরেছিলেন। ২০০৮ সালে বিএনপি-জামায়াত জোটের প্রার্থী আজিজুরকে পরাজিত করে তিনি প্রথমবার সাংসদ হন। আর ২০১৪ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দ্বিতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগের সাংসদ হন। এরপর থেকেই স্থানীয় আধিপত্য নিয়ে দলটির মধ্যে বিভেদের সৃষ্টি হয়। দলের একাংশ আফিলের বিপক্ষে গিয়ে বেনাপোল পৌরসভার মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আশরাফুল আলমের অনুসারী হন।

আফিলের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছেন আশরাফুল। তিনি এলাকায় এলাকায় গণসংযোগ ও সভা সমাবেশ করে নৌকা প্রতীকে ভোট চেয়ে যাচ্ছেন। আশরাফুল বলেন, ‘সাংসদ আফিল উদ্দীনের অনুসারীদের অত্যাচার-নির্যাতনের কারণে শার্শায় আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতা-কর্মীরা ক্ষুব্ধ হয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে যান। তাঁরা রাজনীতি করার মতো আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। সেই নেতা-কর্মীরা এখন আমার সঙ্গে এসেছেন। আমি আওয়ামী লীগের কাছে মনোনয়ন চাইব। সেই লক্ষ্যে গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছি।’

বসে নেই আফিল উদ্দীনও। বিভিন্ন এলাকায় সভা-সমাবেশ করে নৌকা মার্কায় ভোট চাচ্ছেন। নির্বাচনের প্রস্তুতির ব্যাপারে শেখ আফিল উদ্দীন বলেন, ‘আমার প্রস্তুতি নেওয়ার কী আছে; প্রস্তুতি নেবে দল। শার্শা উপজেলা আওয়ামী লীগ যদি আমাকে মনোনীত করে, তাহলে আমি নির্বাচন করব। দল যাঁকে নৌকা প্রতীক দেবে, আমি তাঁর পক্ষে নির্বাচন করব।’

বেনাপোল পৌরসভার মেয়র আশরাফুল আলমের অভিযোগের ব্যাপারে মন্তব্য না করে আফিল উদ্দীন বলেন, দল যাঁকে যোগ্য মনে করবে, তাঁকে মনোনয়ন দেবে। আফিল ও আশরাফুল বলয়ের বাইরে আরেকটি ভিন্ন বলয় সৃষ্টির চেষ্টা করছেন পাসপোর্ট অধিদপ্তরের অবসরপ্রাপ্ত মহাপরিচালক আবদুল মাবুদ। তিনিও গণসংযোগে নেমেছেন। আবদুল মাবুদ বলেন, ‘আমি মুক্তিযুদ্ধ করেছি। আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন চাইব। এ জন্য নৌকা প্রতীকের পক্ষে ভোট চাচ্ছি।’

জাতীয় পার্টি থেকে এই আসনে মনোনয়নের জন্য শার্শা উপজেলা কমিটির সভাপতি আক্তারুজ্জামান মাঠে রয়েছেন। দেশের বৃহত্তম বেনাপোল স্থলবন্দর এ সংসদীয় এলাকায় অবস্থিত। সীমান্ত এলাকা হওয়ায় এখানে টাকার ছড়াছড়ি যেমন আছে, তেমনি রয়েছে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবসা ও চোরাচালান। ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং সীমান্তে চোরাচালান ও হাটের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্বন্দ্বে শার্শায় গত ১০ বছরে আওয়ামী লীগের ৩৭ নেতা-কর্মী খুন হয়েছেন। এ ছাড়া ইসলামী ছাত্রশিবিরের দুই নেতা ও বিএনপিরও অন্তত ১০ জন নেতা-কর্মী প্রাণ হারিয়েছেন।