রোহিঙ্গা তাড়ানোর ছক আড়াই বছর আগের

দীর্ঘ সামরিক শাসন থেকে আড়াই বছর আগে গণতন্ত্রে উত্তরণের সময়টিকেই রোহিঙ্গা নিধনের ‘ভালো সুযোগ’ হিসেবে নিয়েছিল মিয়ানমার সেনাবাহিনী। দেশটির রাখাইন রাজ্যের মানচিত্র থেকে রোহিঙ্গাদের মুছে ফেলার প্রথম ধাপের কাজটি তখনই শুরু হয়। ২০১৬ সালে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর হিসেবে অং সান সু চির দায়িত্ব গ্রহণের চার মাস পরই দেশটির সেনাবাহিনী নির্যাতন চালায় রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গাদের ওপর।

ঢাকার কূটনীতিকেরা বলছেন, ২০১৬ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ওই পরিকল্পনা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বুঝতে ব্যর্থ হয়। এরপর ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর থেকে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা গণহত্যায় আটঘাট বেঁধে নামে দেশটির সেনারা।

২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর কে বা কারা রাখাইন রাজ্যের সীমান্তে পুলিশের ছাউনিতে হামলা চালায়। এতে অন্তত ৯ জন পুলিশের প্রাণহানি ও অস্ত্র লুটের খবর প্রচার করে মিয়ানমার। ওই ঘটনার জের ধরে মিয়ানমারের সেনাসদস্যরা রোহিঙ্গা–অধ্যুষিত গ্রামগুলো ঘিরে ফেলে তাদের ওপর হত্যা, ধর্ষণ, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট শুরু করেন। ওই বছরের অক্টোবর থেকে পরের কয়েক মাসে অন্তত ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে।

কূটনৈতিক ও সামরিক বিশ্লেষকেরা প্রথম আলোকে বলছেন, ২০১৫ সালের নভেম্বরে (জাতীয় নির্বাচন হয়) সে দেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণের পরবর্তী সময়টাকে ‘ভালো সুযোগ’ হিসেবে বেছে নেয় সেনাবাহিনী। সেনাশাসন থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের ওই সময়টাতে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দুষ্কর্ম অনুধাবনে সচেষ্ট ছিল না আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। ২০১৬ সালের রোহিঙ্গা বিতাড়নের পর্বটাকে জাতিসংঘসহ বিশ্বনেতারা শুধু মানবিক সংকট হিসেবে দেখতে চেয়েছেন। রোহিঙ্গা সংকটের মূলে যে দেশটির সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক অধিকারের বিষয়টি যুক্ত, সে সময় তাঁরা তা এড়িয়ে গেছেন।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সি আর আবরার বলেন, পেছনে ফিরে তাকালে এটা স্পষ্ট, রোহিঙ্গাদের তাড়িয়ে দেওয়ার বড় ধরনের প্রস্তুতি মিয়ানমারের ছিল। বাংলাদেশ সব সময় মিয়ানমারকে আস্থায় নেওয়ার চেষ্টা করেছে। তাই তাদের অপকর্মের পরিকল্পনা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে।

মিয়ানমারে কাজ করছেন, এমন কয়েকজন বাংলাদেশি কূটনীতিক প্রথম আলোকে বলেছেন, ভৌগোলিকভাবে কাছের হলেও সব সময় বাংলাদেশ থেকে দূরের পড়শি হয়েই থেকেছে মিয়ানমার। দেশটির সঙ্গে সুপ্রতিবেশীসুলভ দৃষ্টিভঙ্গি বাংলাদেশ সব সময় দেখিয়ে এলেও তা কাজে লাগেনি। ২০১৬ সালে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর হিসেবে অং সান সু চির দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে ফোনে অভিনন্দন জানান, চিঠি লেখেন এবং বাংলাদেশ সফরে আসার আমন্ত্রণ জানান। প্রধানমন্ত্রীর লেখা চিঠিতে প্রতিবেশী দেশের প্রতি গুরুত্ব, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে ভূমিকা রাখা, পারস্পরিক বোঝাপড়া বাড়িয়ে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার বিষয় উল্লেখ ছিল। ২০১৬ সালের অক্টোবরে রোহিঙ্গা নিপীড়নের পর সু চিকে সেই চিঠিটি পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু চিঠির জবাব দিতে তিন মাস সময় নেন সু চি।

মিয়ানমারে কাজ করে আসা একাধিক জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক প্রথম আলোকে বলেন, সু চি ক্ষমতায় এলেও যে রোহিঙ্গাদের প্রশ্নে মিয়ানমারের প্রশাসনের কোনো হেরফের হয়নি। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার উদ্যোগও ছিল না দেশটির। মিয়ানমারের বেসামরিক নেতৃত্ব মনে করেছেন, ভারত আর চীনের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করলেই চলবে। আর দেশটির সেনাবাহিনী এগিয়ে গেছে রোহিঙ্গা বিতাড়নের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে।

বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারাও তাদের আদি নিবাসে ফেরার ব্যাপারে খুব একটা আশাবাদী নয়। টেকনাফের লেদায় অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শিবিরের বাসিন্দা আহমদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, জীবনের শেষ সময়টা নিজের দেশে কাটাতে চান তাঁরা। কিন্তু এ আশা কোনো দিন পূরণ হবে বলে মনে হচ্ছে না। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার ইচ্ছে থাকলে তিন দফায় লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে তাড়িয়ে দিত না মিয়ানমার।

ঢাকার কূটনীতিকেরা বলছেন, সম্প্রতি বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিনের মালিকানা নিয়ে মিথ্যাচারের মধ্য দিয়ে সম্পর্কে নতুন করে জটিলতা সৃষ্টির চেষ্টা করেছে মিয়ানমার। ২০১২ সালের মার্চে দেওয়া আন্তর্জাতিক সালিসি আদালতের রায়ে সেন্ট মার্টিনকে বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ দেখানো হয়েছে। এটা জেনেও দ্বীপটিকে নিজের মানচিত্রে দেখিয়েছে মিয়ানমার। বাংলাদেশের প্রতিবাদের পর মিয়ানমার তার দেশের মানচিত্রে আংশিক পরিবর্তন এনেছে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা মনে করেন, রোহিঙ্গা সংকট বিশেষ করে ২০১৬ ও ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো নৃশংসতা যে গণহত্যা, জাতিসংঘের প্রতিবেদনে তা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করার পর বিষয়টি নিয়ে মিয়ানমারের ওপর চাপ বাড়ছে। এমন এক প্রেক্ষাপটে সেন্ট মার্টিনের পরিস্থিতিকে সামনে এনে রোহিঙ্গা সমস্যা বিষয়টিকে দৃষ্টির বাইরে সরানোর একধরনের অপচেষ্টা রয়েছে দেশটির।

কূটনীতিকেরা বলছেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এখনো রোহিঙ্গা সংকটের মানবিক দিকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে, রাজনৈতিক সংকটে সেভাবে সোচ্চার হচ্ছে না। আর বাংলাদেশও মনে করছে, দ্বিপক্ষীয় ব্যবস্থায় কাজ হবে। চুক্তি অনুযায়ী রোহিঙ্গারা ফিরে যাবে। কিন্তু সেন্ট মার্টিন নিয়ে উসকানির পর বাংলাদেশের বোঝা উচিত, দুই দেশের আলোচনার প্রক্রিয়ায় রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হবে এমনটা ভাবার কারণ নেই।

মিয়ানমারের ভূমিকা নিয়ে জানতে চাইলে সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির গত সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ সব সময় মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করার চেষ্টা করলেও তাদের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়নি। কারণ, রোহিঙ্গা–অধ্যুষিত রাখাইনের জনসংখ্যার ভারসাম্য পরিবর্তনে তাদের দীর্ঘ প্রস্তুতি ছিল। ২০১৫ সালের নির্বাচনের পর মিয়ানমার সেনাবাহিনী বুঝেছে, একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর সময় হয়েছে। সেটাই তারা ধাপে ধাপে করেছে ২০১৬ ও ২০১৭ সালে।