জামিনে বেরিয়েই পুরোনো চক্রে

জাল নোট তৈরি ও বাজারজাত দেশের অর্থনীতির জন্যও ক্ষতিকর। ফাইল ছবি
জাল নোট তৈরি ও বাজারজাত দেশের অর্থনীতির জন্যও ক্ষতিকর। ফাইল ছবি
>
  • জাল নোট তৈরি–বাজারজাতে জড়িত ২৬টি দল শনাক্ত
  • ৭ বছরে ১০ কোটি টাকার জাল নোট উদ্ধার
  • গ্রেপ্তার ১০০, মামলা ২৫
  • নতুন নোট এলেই শুরু হয় জালিয়াতি
  • জড়িতরা নিজেদের স্বজনদের নিয়ে ব্যবসা করছেন
  • জাল নোট প্রতিরোধে সরকারের কার্যক্রম খুব কম

জাল নোট তৈরির অভিযোগে হুমায়ন কবিরকে চারবার গ্রেপ্তার করে পুলিশ। চারবারই তিনি জামিন পান। আরেকজন পলাশ গ্রেপ্তার হন দুবার। তাঁকেও বেশি দিন আটকে রাখা যায়নি।

শুধু হুমায়ন কবির আর পলাশই নন, জাল নোট তৈরি ও বাজারজাতের সঙ্গে যুক্ত যাঁদের পুলিশ আটক করেছে, সবাই জামিনে বেরিয়ে আবার ব্যবসা জমিয়ে বসেছেন। পুলিশ দাবি করছে, জাল নোট তৈরি ও বাজারজাতে জড়িত এ রকম ২৬টি দলকে শনাক্ত করেছে পুলিশ।

গত ২৯ সেপ্টেম্বর ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) রাজধানীর তুরাগের একটি জাল নোটের কারখানা থেকে আবুল হোসেনকে ৫১ লাখ টাকার জাল নোট, জাল টাকা তৈরির সরঞ্জামসহ গ্রেপ্তার করে। এর আগে জাকির হোসেন, আবদুর রশীদ, জাহাঙ্গীর আলম, সাইফুল ইসলাম, মাহবুব মোল্লা, মামুন, আয়নুল, সোলায়মান মজুমদার, পারভেজ ও আবুল কালামকে জাল নোটসহ গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাঁরাও জামিনে বেরিয়ে গেছেন।

ঢাকা মহানগর পুলিশ সূত্র জানায়, ২০১১ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৭ বছরে পুলিশ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে প্রায় ১০ কোটি টাকার জাল নোট উদ্ধার ও এর সঙ্গে জড়িত ১০০ ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে। এসব ঘটনা নিয়ে ২৫টি মামলা হয়েছে।

জাল নোটের বিরুদ্ধে অভিযান ও মামলার তদন্তের সঙ্গে যুক্ত ডিবির উত্তর বিভাগের উপকমিশনার মশিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, আবুল হোসেন নামের এক ব্যক্তি দীর্ঘদিন ধরে জাল নোটের ব্যবসা করে আসছিলেন। কিছুদিন আগে সহযোগীসহ তাঁকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তার আবুল হোসেন ও তাঁর সহযোগীরা জিজ্ঞাসাবাদে জানান, তাঁরা ১০ কোটি টাকার জাল নোট বাজারজাত করার পরিকল্পনা করেছিলেন। এ জন্য প্রতি মাসে তাঁরা ১ কোটি ৮০ লাখ টাকার জাল নোট বাজারে ছাড়তেন। পুলিশ যেসব কাগজ ও সরঞ্জাম উদ্ধার করেছে, তা দিয়ে ৭ কোটি টাকার জাল নোট বাজারজাত করা যেত।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, বাজারে নতুন নোট আসার পরই চক্রগুলোর তৎপরতা বেশ বেড়ে যায়। নতুন নোটের সঙ্গে মানুষের পুরোপুরি পরিচিত হতে সময় লাগে, আর এটাকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগায় তারা। এ ছাড়া ঈদ ও পূজার সময় তাদের তৎপরতা বেড়ে যায়।

জাল নোট মামলা তদন্তের সঙ্গে যুক্ত পুলিশ কর্মকর্তারা বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের জাল নোট প্রতিরোধে কমিটি থাকলেও সেই কমিটির সভা হয় না। কমিটি শুধু জাল নোট শনাক্তে কিছু যন্ত্র বিতরণের মধ্যে তাদের দায়িত্ব সীমাবদ্ধ রাখে। যে কারণে জাল নোটের কারবার বন্ধ হয় না। পুলিশ সূত্র জানায়, ধরা পড়া চক্রের সদস্যরা জিজ্ঞাসাবাদে বলেছেন, জাল নোটের কাঁচামাল সংগ্রহ ও তৈরির কাজে আত্মীয়-পরিজন বা ঘনিষ্ঠজনদের যুক্ত রাখেন, যাতে কলাকৌশল বেশি কেউ শিখতে না পারে। এতে গোপনীয়তাও বজায় রাখা যায়। তবে সমঝোতার ভিত্তিতে চক্রের সদস্যরা আলাদা জাল টাকার ‘কারখানা’ গড়ে তোলেন।

ডিবির এক কর্মকর্তা জানান, ধরা পড়া একটি চক্রের প্রধান হুমায়ন এর আগে তৈরি পোশাক কারখানায় কাপড়ে রং করার (ডাইং) কাজ করতেন। আরেক দলের নেতা কাউসার জিজ্ঞাসাবাদে ডিবিকে বলেন, তিনি তাঁর বড় ভাই হুমায়ন কবিরকে জাল টাকা তৈরিতে সহযোগিতা করতেন। হুমায়নের সঙ্গে বন্ধুত্বের সূত্রে এ পেশায় আসে সুমন ও বাবু। এই দুজন আগে পুরান ঢাকায় জর্দার কৌটায় রং লাগানোর কাজ করতেন। এখন সুমন নিজেই দলনেতা। একইভাবে হুমায়নের হাত ধরে আলাউদ্দিন ও পলাশ এ পেশায় যুক্ত হন। তাঁরা দুজন আগে আবাসিক হোটেলে বয় হিসেবে চাকরি করতেন। একইভাবে আরেকটি দলের প্রধান সগিরের হাত ধরে এ পেশায় আসেন তাঁরই ঘনিষ্ঠ বন্ধু রশীদ। পরে রশীদ নিজে দলনেতা হয়ে যান।

ডিবির উপকমিশনার মশিউর রহমান বলেন, গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, সাধারণত কাঁচাবাজার ও বিপণিবিতানে কেনাকাটার মাধ্যমে জাল নোট ছড়ানো হয়। এক হাজার টাকার জাল নোট খুচরা করতে এক-দুই শ টাকার কেনাকাটা করা হয়। আবার ওপরে-নিচে দু-চারটি আসল নোট দিয়ে ভেতরে জাল নোট রেখে বান্ডিল তৈরি করা হয়। এসব বান্ডিল দিয়ে দামি পণ্য কেনা হয়, যাতে কেউ সন্দেহ করতে না পারে।

জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক মুহা নুরুল হুদা প্রথম আলোকে বলেন, জাল নোট তৈরি ও বাজারজাত দেশের অর্থনীতির জন্যও ক্ষতিকর। এর সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা যাতে জামিনে বেরিয়ে যেতে না পারেন, সে জন্য তাঁদের আটকাদেশ দিতে হবে। যাঁরা জামিনে বেরিয়ে গেছেন, তাঁদের কর্মকাণ্ড স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দপ্তরে জানাতে হবে।